ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

একে মোহাম্মাদ আলী শিকদার

ইয়াহিয়ার ইসলাম রক্ষা!

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২০ মার্চ ২০১৬

ইয়াহিয়ার ইসলাম রক্ষা!

মার্চ মাস চলছে, প্রায় শেষের দিকে। বাংলাদেশ ও বাঙালী জাতির ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় রচিত হয় এই মাসে, ১৯৭১ সালে। তাই আমরা, যারা সেই মার্চ মাসের প্রত্যক্ষদর্শী তাদের জন্য এ মাসটি বছর ঘুরে এলেই মনের ভেতরে অন্যরকম একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আজ ৪৫ বছর পর প্রৌঢ়ত্বে দাঁড়িয়ে আবার একাত্তরের পনেরো বছরের কিশোর মনের আলোড়নে রোমাঞ্চিত হই। সেই দিনগুলোর চিত্র মানসপটে ভেসে ওঠে, গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ভাবনায় আসে জীবন ও সময়কে রিওয়াইন্ড করে, যদি আবার ঠিক ওই রকম একটা সময় ফিরে পেতাম তাহলে কেমন হতো কি করতাম। অবুঝ কিশোরের কাঁধে সহযোদ্ধার রক্তমাখা মৃতদেহ, রণাঙ্গন থেকে বহন করছি। গায়ের গরম রক্ত চোখের জলে ঠা-া হেেয়ছে। মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলেছে। কিন্তু পর মুহূর্তে কমান্ডার শাসিয়েছেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করছি, মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। প্রতিহিংসাকে স্থান দেয়া যাবে না। সুতরাং আজ যারা মুক্তিযুদ্ধ ও ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে কটাক্ষ করেন, তাদেরকে অনুরোধ করব একবার ভেবে দেখুন। এমন আত্মোৎসর্গকে অবমাননা করে বাংলাদেশে রাজনীতি করতে পারবেন না। অনেক হয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর রাষ্ট্রীয় অঙ্গনের সকল ক্ষেত্রে কি ঘটেছে? তারা ক্ষমতায় ওঠে বন্দুকের জোরে পাকিস্তানী কায়দায় মুক্তিযুদ্ধকে নেই করে দিলেন। কিন্তু কেন? এই কেন- এর ভাবনায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু ভাবনার জগত বাধাহীন, সীমাহীন। যা বলছিলাম আবার একাত্তর ফিরে এলে বোধ হয় আরেকটি ৯ মাসান্তে বাহাত্তরের বাংলাদেশ ফিরে আসত। কিন্তু ভাবনার সঙ্গে বাস্তবতার মিল থেকে অমিল বেশি থাকে। তাই ভাবনার জগত থেকে লেখায় ফিরে আসি। একাত্তরের মার্চ গৌরব ও বেদনায় মিশ্রিত মাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচাইতে ভয়ঙ্কর ও বৃহত্তর গণহত্যা পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী এই মাসের ২৫ তারিখ দিবাগত রাতে শুরু করে। দেশব্যাপী এক রাতেই তারা লক্ষাধিক মানুষকে হত্যা করে। আবার ওই রাতেই ২৬ মার্চের প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাঙালী জাতির সবচাইতে গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা। বিশ্বখ্যাত ‘দ্য টাইমস্ পত্রিকায় ২৭ মার্চের হেডলাইন ছিল- Heavy fighting as Sheikh Mujibur Rahman declares East Pakistan Independent. একই দিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসের প্রধান খবর ছিল-Sheikh Mujib was arrested after a broadcast proclaiming Region's Independence. ২৬ মার্চ লন্ডনের ইভর্নিং নিউজ পত্রিকা এবং ভারতের দ্য স্টেটম্যান পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ছাপা হয়। ২৭ মার্চ দিল্লীর দ্য হিন্দু পত্রিকায় একই খবর ছাপা হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতা বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে এখন স্থান লাভ করেছে। রাজনৈতিক প-িত ও সামরিক বিশ্লেষকগণ ভেবে আকুল হন যে, এত বড় সঙ্কটময় মুহূর্তে, জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে একজন নেতা কি করে একটা অলিখিত ভাষণকে এত ছন্দময় করেছেন। কোথাও ছন্দের পতন নেই, শব্দের পুনরাবৃত্তি নেই। মাত্র ১৮ মিনিটে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক কৌশলসহ যুদ্ধ পরিচালনার সব নির্দেশনা দিয়ে দিলেন। একই সঙ্গে পাকিস্তানী সামরিক চক্রকে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ও দোদুল্যমানতায় ফেলে দিলেন। পাকিস্তানী সামরিক অফিসার ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার উইটনেস টু সারেন্ডার বইয়ে উল্লেখ করেন মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতাই শেখ মুজিবের একমাত্র লক্ষ্য। সেই স্বাধীনতা কত কম রক্তক্ষয়ে অর্জন করা যায় সেটাই এখন শেখ মুজিবের চিন্তা। ১৯৪৭ সালের জন্মের পর থেকেই প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের মৃত্যুযাত্রা শুরু হয়। ১৯৭১ সালে এসে মার্চের এক তারিখে ইয়াহিয়া খান যখন তিন মার্চের নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত ঘোষণা করেন তখন পাকিস্তান প্রকৃতপক্ষে মৃত্যু শয্যায় শায়িত হয়। ২৩ মার্চ বিশ্বের মানুষ জেনে যায় ১ মার্চ থেকে ভেন্টিলেশনে থাকা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রপতির বাঁচার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। পাকিস্তানের মৃত্যুশয্যার পাশে ঢাকায় তখন উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান, সেনাপ্রধান জেনারেল হামিদ খান, বেলুচিস্তানের কসাইখ্যাত লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো। পাকিস্তানের সব ক্ষমতাবান সেদিন ঢাকায় উপস্থিত থাকার পরেও ২৩ মার্চ ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল তার কিছু বর্ণনা প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে পাকিস্তানী লেখকদের বই থেকেই তুলে ধরছি। ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থের ৬৭ নম্বর পৃষ্ঠায় ২৩ মার্চ একাত্তরের চিত্রাঙ্কন করেছেন। তিনি লিখেছেন, বিগত তিন সপ্তাহ ধরে চলমান উত্তাল তরঙ্গের মাঝে ২৩ মার্চ সকাল হলো। গত ২৩ বছর যাবত অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও মর্যাদা সহকারে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস হিসেবে পালন করে আসছে পাকিস্তান সরকার ও জনগণ। কিন্তু আজ একাত্তরের ২৩ মার্চ ঢাকার সবকিছু যেন অন্যরকম। পাকিস্তান রাষ্ট্র এখনও আছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, সেনাপ্রধানসহ রাষ্ট্রের অন্য সব বড় বড় কর্ণধারগণ ঢাকায় উপস্থিত। কিন্তু ঢাকা শহরে কোথাও পাকিস্তানের চিহ্ন দেখতে পারছি না। সিদ্দিক সালিক আরও লিখেছেন ‘মানুষ খালি মুখে এবং রাস্তায় ও দোকানে দোকানে হাজারো মাইকের আওয়াজ সব কিছুকে ছাপিয়ে শুধুমাত্র একটি ধ্বনিই কানে আসছে, জয় বাংলা। সব মিছিলের গন্তব্য একটাই, ধানম-ির ৩২ নম্বর, শেখ মুজিবের বাড়ি। মুজিব বারান্দায় দাঁড়িয়ে মেগাফোনের মাধ্যমে মিছিলে আগত জনসমুদ্রের সঙ্গে কথা বলছেন, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সব প্রকার সরকারী বেসরকারী অফিস আদালত কলকারখানা চলছে শেখ মুজিবের নির্দেশে। সিদ্দিক সালিকের ভাষায় ভার্চুয়ালি ২৩ মার্চকে সেদিন মনে হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। ঢাকা শহরসহ বাংলাদেশের সর্বত্র উড়ানো হয়েছে বাংলাদেশের পতাকা, টাঙ্গানো হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। এই অবস্থায় ২৫ মার্চ যুদ্ধ শুরু করার হুকুম দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চুপিসারে ঢাকা থেকে পালিয়ে যান। তারপর ২৬ মার্চ সকালে জুলফিকার আলী ভুট্টো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান রূপসী বাংলা) থেকে হেভী মিলিটারি এস্কট নিয়ে বিমানবন্দরে গেলেন এবং পাকিস্তানের উদ্দেশে বিমানে ওঠার আগে সঙ্গে থাকা এস্কট পার্টির প্রধান ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক গড পাকিস্তান রক্ষা পেল। তবে পারবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বলে দেয় পাকিস্তান আর রক্ষা পায়নি। রক্ষা পায়নি জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ইয়াহিয়া খান। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তার নিজের নিয়োগকৃত সেনাপ্রধান জিয়াউল হকের হাতে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের মৃত্যু হয়েছে কুষ্ঠ রোগে। পাকিস্তানের সেনা অফিসারগণ এখনও তাকে অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়। পাকিস্তানের জন্মের বীজের মধ্যেই তার মৃত্যুর উপাদান সাম্প্রদায়িকতার বীজ ছিল। পাকিস্তানী শাসকবর্গ শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে ধর্মকে অপব্যবহারের জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষকে এমনভাবে লালন-পালন করেছে যে, ২৩ বছরের মাথায় এসে তার ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে পাকিস্তান দুই টুকরো হয়ে গেল। ধর্মের নামে কত বড় ভ-ামি ও ধৃষ্টতা পাকিস্তানের শাসকবর্গ দেখাতে পারেন তার নিকৃষ্ট উদাহরণ একাত্তরের মার্চ মাসে ঢাকায় বসে সৃষ্টি করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এই ঘটনাটির সামান্য বর্ণনা দিয়ে লেখাটি শেষ করব। পাকিস্তানের একজন প-িত ব্যক্তি হোসেন হাক্কানী। তিনি এক সময়ে প্রয়াত বেনজীর ভুট্টো, নওয়াজ শরীফ এবং মোস্তফা জাতইয়ের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ওয়াশিংটন ও কলম্বোতে। হোসেন হাক্কানী একটি অসাধারণ বই লিখেছেন। বইটির নামÑ পাকিস্তান বিটুইন মস্ক এ্যান্ড মিলিটারি। বইয়ের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন যে, সকল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও একটি রাষ্ট্র মোল্লা ও মিলিটারির কবলে পড়ে কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেল। এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনাবলীর কিছু বর্ণনা আছে। বইয়ের সর্বত্র তিনি পাকিস্তানের মোল্লা ও মিলিটারির কঠোর সমালোচনা করলেও একাত্তরের মার্চ মাসের ঘটনাবলীর বর্ণনায় সঙ্গত কারণেই তিনি পাকিস্তানের পক্ষে অনেক যুক্তি তুলে ধরেছেন। তবে অনেক সত্য ঘটনারও উল্লেখ করেছেন এবং তার পরিণতির ভয়াবহতা উল্লেখপূর্বক কঠোর সমালোচনা করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। উল্লিখিত বইয়ের ৭৫ নম্বর পৃষ্ঠায় হাক্কানী লিখেছেন-প্রথম আলোচনার দিনে শেখ মুজিবুর রহমান ডেলিগেশনসহ গবর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন) পৌঁছালে ইয়াহিয়া খান হুইস্কির গ্লাস হাতে নিয়ে স্বাগত জানানোর সুরে বলেন- জনাব শেখ মুজিব আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলাম রক্ষা করি। এতবড় ভ-ামি ও ধর্মের অবমাননা বোধ হয় স্বয়ং আল্লাহও সহ্য করেননি। ফলে মাত্র ৯ মাসের মাথায় পাকিস্তানের কবর রচিত হয় ঢাকার মাটিতে। লেখক : ভূ-রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
×