ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রড্রেজিংয়ের নতুন প্রকল্প আসছে ;###;খনন করা হবে ৩৭ হাজার ৫১০ লাখ ঘনমিটার নৌপথ ;###;রসরকারের চলতি মেয়াদে সংগ্রহ করা হবে আরও ২০ ড্রেজার

নদীভিত্তিক অর্থনীতি চাঙ্গা করতে মহা পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২০ মার্চ ২০১৬

নদীভিত্তিক অর্থনীতি চাঙ্গা করতে মহা পরিকল্পনা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ চাঙ্গা হচ্ছে নদীভিত্তিক অর্থনীতি। দেশের পানি খাত উন্নয়ন ও নদ-নদীগুলোর নাব্য ফিরিয়ে আনতে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর ফলে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী নদীকেন্দ্রিক অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। এজন্য নদী ড্রেজিং এবং ড্রেজার সংগ্রহ সংক্রান্ত বড় সাতটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। সরকারের চলতি মেয়াদে সংগ্রহ করা হচ্ছে আরও ২০টি ড্রেজার। ছয় বছরে খনন করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নৌপথ। আরও ব্যাপক খননের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগামী ১৫ বছরে ৩৭ হাজার ৫১০ লাখ ঘনমিটার খননের লক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। চার কারণে নদীগুলো নাব্য হারাচ্ছে। নদী খাত উন্নয়নে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে পানি খাত ও ড্রেজিং সংক্রান্ত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি কাজ করছে। কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২০০৯ সালের ২৫ আগস্ট। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া পানি খাত ও ড্রেজিং বিষয়ে কাজ করছে আরও একটি উপকমিটি। নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, নৌপথে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহন খরচ কম ও পরিবেশবান্ধব। নৌপথগুলোর নাব্য ফিরিয়ে আনা গেলে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, সেই সঙ্গে নিরাপদ বিশ্বস্ত, দ্রুত ও সময় সাশ্রয়ী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। তিনি জানান, বাংলাদেশের নদীগুলো ধীরে ধীরে নাব্য হারাচ্ছে। নাব্য হারানোর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানিপ্রবাহ হ্রাস, ক্রস-বাউন্ডারি প্রবাহ হ্রাস, পলিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং জোয়ারের প্রবাহ কম ইত্যাদি। নদীর পানি কমে যাওয়ায় একদিকে মাছের উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রম ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। অপরদিকে বন্যার পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টির ফলে দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নৌপথের নাব্য উন্নয়নের লক্ষ্যে ড্রেজিং করা অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ছোট-বড় ৭০০টি নদী, জলপ্রবাহ ও খাল মিলে প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ছিল। বিগত সরকারগুলোর অযতœ ও অবহেলার ফলে এই নৌপথ বর্ষাকালে ৬ হাজার কিলোমিটারে এবং শুষ্ক মৌসুমে ৩ হাজার ৯০০ কিলোমিটারে এসে দাঁড়ায়। নৌপথের নাব্য বজায় ও উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের দিক নির্দেশনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নৌপথ খনন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২০০ কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হয়েছে। সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি নৌপথ খনন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। নৌপথ খনন ও নাব্য বজায় রাখার লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী কোম্পানির ড্রেজারও কাজ করছে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭২ সালে বিআইডব্লিউটিএতে দুটি ড্রেজার সংযুক্ত হয়। ৪৪ বছর আগের ডেল্টা-১ এবং ডেল্টা-২ নামের ড্রেজার দুটি এখনও অপারেশনে রয়েছে। এই সময়ে উল্লেখযোগ্য কোন ড্রেজার ক্রয় করা হয়নি। পরবর্তীতে বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর নদীর নাব্য ও প্রবাহ ঠিক রাখার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে ১৪টি ড্রেজার সংগ্রহ করে এবং বর্তমান মেয়াদে ২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ২০টি ড্রেজার ক্রয়ের প্রক্রিয়া চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বাংলাদেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর পলি সমৃদ্ধ একটি বৃহৎ ব-দ্বীপ। দেশের নদ-নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি নদীই সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ৫৪টি ভারত এবং ৩টি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর ১৭ দশমিক দুই লাখ বর্গকিলোমিটার ক্যাচমেন্ট এরিয়ার এক হাজার ৩৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার পলি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে পড়ে। ক্যাচমেন্ট এরিয়ার মাত্র সাত শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। বিপুল পরিমাণ পলিবহন এবং পলি দিয়ে গড়ে ওঠা অববাহিকার মধ্য দিয়ে এসব নদী প্রবাহিত হওয়ায় এগুলোর ভাঙ্গা-গড়ার প্রবণতা বেশি। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, গত তিন দশকে যমুনা নদীর প্রশস্ততা ৪ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর নতুন নতুন চ্যানেল সৃষ্টি অথবা পরিত্যক্ত হওয়া এ নদীর স্বাভাবিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। ফলে নৌ-চলাচলে বিঘœ ঘটছে। একই অবস্থা ব্রহ্মপুত্র ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে ৬০ বছর আগেও স্টিমার চলাচল করলেও বর্তমানে এটি একটি পরিত্যক্ত চ্যানেলে পরিণত হয়েছে। গঙ্গার শাখা নদী মধুমতি, ভৈরব, চিত্রা, গড়াই, চন্দনা ও ঘোড়াউত্রাসহ বিভিন্ন নদীর একই অবস্থা। এ পরিপ্রেক্ষিতে নদী ড্রেজিং সংক্রান্ত যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন ও গ্রহণ করা হচ্ছে সেগুলো হলো মাদারীপুর-চরমুগুরিয়া-টেকের হাট-গোপালগঞ্জ নৌপথ খনন প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১০৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা, বাস্তব অগ্রগতি ৭৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। বর্তমান পর্যন্ত প্রায় ৭৫ দশমিক ৮২ লাখ ঘনমিটার খনন করা হয়েছে, চলতি বছর এ প্রকল্পের আওতায় আরও প্রায় ১৯ লাখ ঘনমিটার খনন করা হবে। ১২টি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ খনন প্রকল্পের আওতায় বর্তমান পর্যন্ত প্রায় ৫৯ দশমিক ৭১ লাখ ঘনমিটার খনন করা হয়েছে। আগামী দুই বছরে এ প্রকল্পের আওতায় আরও প্রায় ২৩৮ দশমিক ৬৫ লাখ ঘনমিটার খনন করা হবে। ৫৩টি নৌপথ ক্যাপিটাল ড্রেজিং (প্রথম পর্যায়ে ২৪টি নৌপথ) প্রকল্পের ডিজাইন করার জন্য উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে। বরিশাল-বরগুনা-পাথরঘাটা, খুলনা-বরদিয়া-মানকদা, সৈয়দপুর-বান্দুরা, চামরাঘাট-নিকলী-নেত্রকোনা, গাগলা বাজার-মোহনগঞ্জ, মংলা-ঘাসিয়াখালী ও ভৈরব-ছাতক নৌপথ ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে। বর্তমান পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় ৯৯ দশমিক ৬৮ লাখ ঘনমিটার খনন করা হয়েছে। আগামী চার বছরে আরও ৯২৪ দশমিক ৩২ লাখ ঘনমিটার খনন করা হবে। বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদী হতে বর্জ্য অপসারণ এবং নদী দূষণমুক্তকরণ প্রকল্পটি এখনও অনুমোদন পায়নি। এটি অনুমোদন হলে আগামী পাঁচ বছরে ১৫০ লাখ ঘনমিটার খনন করা হবে। বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল নৌপথসমূহের খনন প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে আগামী চার বছরে প্রায় ৫০০ লাখ ঘনমিটার খনন করা হবে। কর্ণফুলী নদী এবং কাপ্তাই লেকের রাঙ্গামাটি-থেগামুখ ল্যান্ড নৌপথে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পটি অনুমোদিত হলে আগামী চার বছরে প্রায় ৪০০ লাখ ঘনমিটার খনন করা হবে। এছাড়া যমুনা নদী সোজাকরণের মাধ্যমে ভূমি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৩৬ হাজার ৮৬০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর অংশ থাকবে ১৮ হাজার ৪৩০ লাখ ঘনমিটার। প্রকল্পটি আগামী ১৫ বছরে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার ক্রয়ের মাধ্যমে নিবিড়ভাবে খনন কাজ পরিচালনা করে অভ্যন্তরীণ নৌপথসমূহের বিদ্যমান চ্যানেলগুলোর উন্নয়ন ও জলযানসমূহের নির্বিঘœ চলাচলে নির্দেশনামূলক সহায়তার কথা উল্লেখ ছিল। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও নদী খননের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। কেননা দেশের নদীভিত্তিক অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হলে নদীগুলোর ড্রেজিংয়ের বিকল্প নেই। নদীর চ্যানেল ঠিক রাখা গেলে দু’পাশে আর ভাঙ্গবে না। মানুষও নিঃস্ব হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। এজন্য শুরু থেকেই নদী ড্রেজিং বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, বর্তমানে দশটি নৌরুট ও নৌপথে নিয়মিত বিরতিতে প্রায় প্রতিবছরই সংরক্ষণমূলক ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিরুট, মাওয়া-চরজানাজাত ফেরিরুট, হরিণা-আলুবাজার ফেরিরুট, লাহারহাট-ভেদুরিয়া ফেরিরুট, ভোলা-লক্ষ্মীপুর ফেরিরুট এবং পাটুরিয়া-বাঘাবাড়ি নৌপথ, ঢাকা-বরিশাল-পটুয়াখালী নৌপথ, ভৈরব-ছাতক নৌপথ, ঢাকা-চট্টগ্রাম নৌপথসমূহ। সেই সঙ্গে পটুয়াখালী, নারায়ণগঞ্জ ও মীরকাদিম নদীবন্দরসমূহসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সংরক্ষণমূলক ড্রেজিং করা হয়ে থাকে। সূত্র জানায়, বিশ্বব্যাংকের রিভাইভাল অব ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট : অপসন এ্যান্ড স্ট্রাটেজিস শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ (১২.৩) জনসাধারণের পরিবহন ব্যবস্থা এককভাবে নৌপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। দেশের দুই লাখ ৭৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথের তুলনায় নৌপথ অপেক্ষাকৃত কম দৈর্ঘ্যরে ২৪ হাজার কিলোমিটার হলেও এর বিস্তৃতি অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি প্রবাহ হ্রাস, ক্রস-বাউন্ডারি প্রবাহ হ্রাস, পলিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং জোয়ারের প্রবাহ কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে নাব্য হারাচ্ছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড দেশীয় ও বিদেশী পরামর্শকের যৌথ উদ্যোগের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে ফ্যাজিবিলিটি স্টাডি অব ক্যাপিটাল ড্রেজিং এ্যান্ড সাসটেইনেবল রিভার ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ বিষয়ে একটি সমীক্ষা সম্পাদন করেছে। এ সমীক্ষায় দেখা যায়, দেশে মোট ২৩টি বড় ও মধ্যম প্রকৃতির নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মোট ২১৬টি কাটার সাকশন ড্রেজারের প্রয়োজন হবে। এ প্রেক্ষাপটে ড্রেজার কেনার বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০টি নতুন ড্রেজারসহ সহায়ক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম সংগ্রহ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।
×