ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঊর্মি রহমান

কলকাতার চিঠি

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২১ মার্চ ২০১৬

কলকাতার চিঠি

বসন্ত এসেছে বেশ কিছুদিন আগে। কিন্তু সেই ফুরফুরে আমেজ পাওয়া যাচ্ছে না। গরম পড়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গ অবশ্য বসন্ত উৎসবের জন্য তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে যেমন ১ ফাল্গুন বসন্ত উৎসব, এখানে কিন্তু তা নয়। এখানে দোলের দিন বসন্ত উৎসব। তবে সেটা পালনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ক্যাম্পাসে এই উৎসব পালিত হয়েছে। বাকিরা তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে বড় উৎসব অবশ্য হয় শান্তিনিকেতনে। সে উৎসব দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে মানুষ আসে। বেশ কয়েক মাস আগে বুকড না করলে সেখানে কোন হোটেলে জায়গা পাবেন না। কলকাতার অনেকেই তখন সেখানে হাজির হয়। এদিকে সর্বত্র দোকানপাটে দোল বা হোলির সেল শুরু হয়েছে। নানারকম অফার রয়েছে। এখন তো সবকিছুতে পণ্যের ব্যবসাটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে কথা এখন থাক। অন্য কথা আপনাদের জানাই। সম্প্রতি নারী দিবস উপলক্ষে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবীবিদ্যা (উইমেনস্ স্টাডিজ) বিভাগের একটি সুন্দর অনুষ্ঠানে যাবার সুযোগ ঘটে। সেটার কথা বলার আগে এই বিভাগটি সম্পর্কে আপনাদের কিছু কথা জানাই। এটি এ ধরনের উদ্যোগে অগ্রগণ্য বলা চলে, যা শুধু এই অঞ্চলে নয়, জাতীয়ভাবেও স্বীকৃত। এই বিভাগের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৮ সালে, যশোধরা বাগচী, আমাদের সবার প্রিয় যশোধরাদি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক। এই বিভাগ একাডেমিক ক্ষেত্রে তো বটেই, বৃহত্তর সমাজের নারীবাদ ও লিঙ্গ-সাম্য তুলে ধরে আর সেজন্য বিভাগটি শুধু শিক্ষাবিদ নয়, সমাজকর্মী ও এ্যাকটিভিস্টদের মধ্যেও কাজ করে। এবারের আলোচনাচক্রটি বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে করা হয়েছে। প্রায় প্রতিবছর প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে এই দুই সংগঠন। এবারের বিষয় ছিল ‘মেয়েদের কলমে কারাজীবন।’ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয়। বক্তা ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান গোপা দত্ত ভৌমিক। তিনি এর আগে গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এই আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং কারাবাসের অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। মূলত বীণা দাস ও মীনাক্ষী সেনকে নিয়ে আলোচনা হলেও অন্য মেয়েদের কথাও এসেছে। জয়া মিত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যার ‘হন্যমান’ বইটি আপনাদের অনেকের পড়া। এ কথা বলা হয় মেয়েরা নাকি শহীদ হয় না। প্রীতিলতা হয়েছিলেন। ইউরোপীয় ক্লাবে হামলার ঘটনার সময় সকলকে নিরাপদে পার করে দিয়ে বিষপান করেন, ধরা দেননি। মেয়েরা স্বাধীন ভারত চেয়েছিল। প্রীতিলতা ও বীণা দাসের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে। দুজনই চট্টগ্রামের মেয়ে এবং দুজনই বেথুন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। বেথুন কলেজের কড়া শাসনের মধ্যেও মেয়েদের মাঝে বিপ্লবী চেতনার সঞ্চার হয়। বীণা দাসকে কারাবরণ করতে হয়, তখন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তার পাশে। অন্য রাজবন্দীরাও কারা কাহিনী লিখে গেছেন। কিন্তু সেসব গ্রন্থে সাধারণ কয়েদিদের কথা সেভাবে আসেনি। ব্যতিক্রম বীণা দাস আর তার উত্তরসূরি মীনাক্ষী সেন ও জয়া মিত্র। বীণা দাসের লেখা থেকে আমরা সে সময়কার অনেক কথা জানতে পারি। সে সময় বিপ্লবীদের আন্দামানে পাঠানো হতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও এ্যান্ড্রুজের জন্য মেয়েদের সেখানে পাঠানো হয়নি। বীণা দাস তার সময়ের সমস্ত ঘটনাকেই নিরপেক্ষভাবে দেখেছেন। তিনি দাঙ্গার পর নোয়াখালী যান আর সেখানকার দাঙ্গার দায়ভাগ যে জমিদারদের অত্যাচারও ছিল সে কথা লিখে যান। শুধু কোন একটি সম্প্রদায়কে দায়ী করেননি। বীণা দাস স্বাধীনতার পর অবসরভাতা নেননি। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কাজ করেছেন। সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে যখন নির্যাতনের শিকার হয় সেখানেকার মানুষ তাদের মধ্যেও কাজ করেছেন। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতার ইতিহাস সঠিকভাবে লেখা হয়নি। তিনি বলেছিলেন, ‘সবটাই গান্ধীজী করেননি, আমরাও ছিলাম।’ পুরুষ বন্দীদের কেউ কেউ ডিভিশন নিয়েছিলেন, যা তাদের দুধ, মশারি ইত্যাদি পাবার অধিকার দিয়েছিল। কিন্তু মেয়েদের কেউ ডিভিশন নেননি। পুরুষ কারাবন্দীদের লেখার সঙ্গে তাদের লেখার মৌলিক পার্থক্য আছে। তারা কারাজীবনকে ভিন্নভাবে দেখেছেন। মীনাক্ষী সেনের ‘জেলের ভেতর জেল’ গ্রন্থে তার জেলের ভেতর আর একটা জেলকে দেখার যে মর্মদৃষ্টির পরিচয় আমরা পেয়েছি তার তুলনা হয় না। এইখানে আমার নিজের কথাই বলি। আমি যখন এই বইটি পড়ি তখন কারাজীবন তথা জেলের ভেতর জেলের যে মর্মস্পর্শী ও করুণ চিত্র দেখতে পেয়েছি সেটা আমার মনের ওপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে, আমি রাতে ঘুমাতে পারিনি। বড় আশা ছিল কিছুদিনের মধ্যেই মীনাক্ষী সেন অবসর নিয়ে কলকাতা চলে আসবেন, তখন তাঁর সঙ্গে আলাপ করব। তিনি আমার বন্ধু রাজশ্রীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। সেটা আর হতে পারেনি। তার আগেই মীনাক্ষী সেন চলে গেলেন। যা হোক, সেদিন বক্তারা বললেন, মীনাক্ষীর কলম ছিল তুলির মতো। জেলের ভেতরের পাগলদের নিয়ে মামলায় বিচারক মীনাক্ষীর বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। কারাবন্দীদের যেসব শিশুসন্তান কারাগারে থাকত তাদের কথা এসব লেখায় এসেছে। তারা লিখেছেন, ‘বদ্ধ কারায় এক মুঠো বাতাসের মতো ছিল এসব শিশু।’ তাদের নিয়েও যে করুণ কাহিনীর বর্ণনা আমরা মীনাক্ষীর বইতে পাই তা আমাদের মনকে ছুঁয়ে যায়। গোপা দত্ত ভৌমিকের বক্তব্যের পাশাপাশি কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় অন্য নারী কয়েদিদের কথা তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তারা যখন কারাগারে ছিলেন তখন তাদের সঙ্গে মেলামেশা, এমনকি কথা বলাও নিষেধ ছিল। কিন্তু তারা ছুটে আসত তাঁদের কাছে। নকশাল আন্দোলনের কারণে যারা কারাবন্দী হয়েছিলেন তারা ছিলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছেলেমেয়ে। তাদের ভেতরে সুপ্ত ছিল লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ বা সেরকম কিছু হবার সম্ভাবনা। তারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারতেন। তাই তারা যা দেখেছেন, যা শুনেছেন, যা বুঝেছেন সেসব তাদের মনে রেখাপাত করেছে। পরবর্তী জীবনে তাদের কেউ কেউ সে অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছেন। তাই আমরাও জানতে পেরেছি কারাজীবনের কথা। পুরুষ কারাবন্দীদের কলমের চেয়ে তাদের কলম কোন অংশে কম নয়, বরং আরও জোরালো বলেই আমার মনে হয়েছে। তাদের দেখার দৃষ্টি ছিল ভিন্ন ও সংবেদনশীল। সেদিনের আলোচনা শুনতে শুনতে তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করেছি। সবশেষে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও বীণা দাসের ডিপ্লোমা আটকে রাখা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের সময়। আশ্চর্যের বিষয়, দেশ স্বাধীন হবার পরও সেগুলো পাওয়া যায়নি। অবশেষে স্বাধীনতার ৬৫ বছর পর সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
×