ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দিতি সম্পর্কে আরও খবর সংস্কৃতি অঙ্গন পাতায়

ক্যান্সারের কাছে হেরে গেলেন চিত্রনায়িকা দিতি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২১ মার্চ ২০১৬

ক্যান্সারের কাছে হেরে গেলেন চিত্রনায়িকা দিতি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ থেমে গেল সেলুলয়েডের রঙিন পর্দায় দর্শককে বিনোদিত করা মিষ্টি মুখের নায়িকা দিতির জীবনস্পন্দন। ব্রেইন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে জীবনের কাছে হেরে গেলেন চলচ্চিত্র ও নাটকের এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী পারভীন সুলতানা দিতি আর নেই। রবিবার বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আশির দশকের এই জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। রেখে গেছেন মেয়ে লামিয়া চৌধুরী ও ছেলে দীপ্ত চৌধুরীসহ অসংখ্য ভক্ত ও গুণগ্রাহী। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুসহ চলচ্চিত্র ও সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দিতির মৃত্যু দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের একটি অপূরণীয় ক্ষতি। দিতির মৃত্যুতে শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। মৃত্যুর খরর পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালে ছুটে আসেন তার সহযাত্রী শিল্পীরা। তাদের মধ্যে ছিলেনÑ অভিনয়শিল্পী ববিতা, সুবর্ণা মোস্তফা, মৌসুমী, রিয়াজ, ওমরসানী, মিশা সওদাগর, অরুণা বিশ্বাস, নাট্য নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা মুশফিকুর রহমান গুলজার। মৃত্যুপরবর্তী কার্যক্রম প্রসঙ্গে দিতির দুই সন্তানের পক্ষে অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা বলেন, লামিয়া ও দীপ্ত কথা বলার মতো পরিস্থিতি না থাকায় ওদের পক্ষে আমি কথা বলছি। আজ (রবিবার) বাদ এশা গুলশান আজাদ মসজিদ প্রাঙ্গণে দিতির প্রথম জানাজা হবে। রাতে তার মরদেহ রাখা হবে ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে। সোমবার সকালে প্রথম মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে দিতির গুলশানের বাসভবনে। পরবর্তীতে চলচ্চিত্র শিল্পীদের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে বিএফডিসিতে। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হবে জন্মস্থান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। বাদ জোহর দ্বিতীয় জানাজা শেষে মায়ের কবরের পাশে দিতিকে সমাহিত করা হবে। ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিকেশন এ্যান্ড মার্কেটিং বিভাগের প্রধান ডাঃ সাগুফা আনোয়ার জানান, দিতি ভারতের চেন্নাইয়ে মস্তিষ্কে ক্যান্সারযুক্ত টিউমারে আক্রান্ত অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই রোগেই গত ৮ জানুয়ারি সন্ধ্যায় তিনি এখানে ভর্তি হন। তিনি নিউরোসার্জারি কনসালট্যান্ট ডাঃ সৈয়দ সাঈদ আহমেদের তত্ত্বাবধানে ভর্তি ছিলেন। গত ১০ মার্চ তার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। এ সময় উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল করে তিনি রবিবার বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। মস্তিষ্কে ক্যান্সারজনিত কারণে চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব অর্থোপেডিকস এ্যান্ড ট্রামাটোলজিতে (এমআইওটি) ভর্তি হয়েছিলেন দিতি। প্রথম দফার চিকিৎসা শেষে ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দেশে ফেরেন জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী। কিন্তু কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাকে ভর্তি করা হয় রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে। অবস্থা অপরিবর্তিত থাকার কারণে গত বছরের ৩ নবেম্বর দ্বিতীয় দফায় তাকে চেন্নাই নেয়া হয়। টিউমার অপসারণ করা হলেও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি। অস্ত্রোপচারের পর কেমোথেরাপি দেয়া হচ্ছিল তাকে। পরে দেশে ফেরার পর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দেশে ফেরার পরই দিতির চিকিৎসার্থে তার মেয়ের হাতে চিকিৎসার সহায়তায় ১০ লাখ টাকার চেক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৬৫ সালের ৩১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেন দিতি। ১৯৮৪ সালে নতুন মুখের সন্ধানের মাধ্যমে দেশীয় চলচ্চিত্রে পদার্পণ করেন তিনি। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র উদয়ন চৌধুরী পরিচালিত ‘ডাক দিয়ে যাই’। কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। দিতি অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ছিল আজমল হুদা মিঠু পরিচালিত ‘আমিই ওস্তাদ’। আর প্রথম ছবিতেই বাজিমাত। দর্শকের মন জয় করে নেন সুন্দরী ও সুঅভিনেত্রী দিতি। জীবদ্দশায় দুই শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন দিতি। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘স্বামী স্ত্রী’ চলচ্চিত্রে আলমগীরের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ১৯৮৭ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ছোট পর্দায়ও দিতি ছিলেন নিয়মিত। অনেক একক নাটক, টেলিফিল্ম ও ধারাবাহিক নাটকে দেখা গেছে তাকে। এছাড়া রান্না বিষয়ক অনুষ্ঠানও উপস্থাপনা করেছেন। গায়িকা হিসেবেও প্রশংসা কুড়িয়েছেন দিতি। বেরিয়েছে তার একক এ্যালবামও। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রয়াত সোহেল চৌধুরীকে বিয়ে করেছিলেন। তাদের ঘরে দুই সন্তান প্রিন্স চৌধুরী ও লামিয়া চৌধুরী। সোহেল চৌধুরী প্রয়াত হন অনেক আগেই। সোহেল চৌধুরীর অপমৃত্যুর পর বিপতœীক ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে বিয়ে হয় দিতির। তবে পর্দায় সফল জুটি হলেও বাস্তবে দিতি ও কাঞ্চনের সংসার খুব স্বল্পদিন স্থায়ী হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। দিতি অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ দুই জীবন, উছিলা, লেডি ইন্সপেক্টর, খুনের বদলা, আজকের হাঙ্গামা, স্নেহের প্রতিদান, শেষ উপহার, অপরাধী, কালিয়া ও কাল সকালে। তার অভিনীত শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা হচ্ছে সুইটহাট। ছোট পর্দায়ও দিতি ছিলেন নিয়মিত। অভিনয় এবং নির্মাণ দুটোই একসঙ্গে করতেন দিতি। অপূর্ব ও মোনালিসাকে নিয়ে রুম্মান রশীদের গল্পে দিতি প্রথম ডিএলডি নামক নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা থেকে নির্মাণ করেন ‘খুনসুটিকে দিলাম ছুটি’ নাটকটি। এরপর বিশেষত মা দিবস এলেই তিনি ‘মা’ বিষয়ক গল্প নিয়ে বিশেষ বিশেষ নাটক নির্মাণ করেন। তার ওপর তিনি অনেক একক নাটক, টেলিছবি নির্মাণ করেন। তার সর্বশেষ অভিনীত ধারাবাহিক নাটক রুদ্র মাহফুজের রচনায় ও সাখাওয়াত মানিকের পরিচালনায় ‘মেঘে ঢাকা শহর’। তার সর্বশেষ প্রচার চলতি ধারাবাহিক নাটক ছিল এটিএন বাংলায় প্রচার চলতি রুদ্র মাহফুজ রচিত ও বিইউ শুভ পরিচালিত ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’। দিতির প্রযোজনা সংস্থা ডিএলডি থেকে সর্বশেষ নির্মিত নাটক ছিল রাশেদ শামীম শ্যাম পরিচালিত ‘বৃষ্টির কান্না’। এতে দিতি অভিনয় করেন গত বছরের ২২ জুলাই। ২৪ জুলাই রাতে তিনি অসুস্থ হন এবং ২৫ জুলাই তিনি চেন্নাই যান চিকিৎসার জন্য। মডেল হয়েও তিনি কাজ করেছেন অসংখ্য বিজ্ঞাপনে। একজন গায়িকা হিসেবেই ছোটবেলা থেকে নিজেকে গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন দিতি। কিন্তু বড় হয়ে তিনি নায়িকা হলেন। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে অনুপম রেকর্ডিং মিডিয়া থেকে তার প্রথম গানের এ্যালবাম বের হয়। সর্বশষ লেজার ভিশন থেকে তার দ্বিতীয় একক গানের এ্যালবাম ‘ফিরে যেন আসি’ বাজারে আসে প্রায় তিন বছর আগে। এটিও দর্শকনন্দিত হয়।
×