ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তাসকিনের নিষেধাজ্ঞায় প্রতিবাদের ঝড়

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ২১ মার্চ ২০১৬

তাসকিনের নিষেধাজ্ঞায় প্রতিবাদের ঝড়

মোঃ মামুন রশীদ ॥ সবার কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল বিষয়টি। বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষই এখন ক্রিকেট বোঝেন। তারা ক্রিকেট অন্তঃপ্রাণ এবং পাগলাটে ভক্ত। তরুণ পেসার তাসকিন আহমেদ সবার মনের মধ্যে বাসা করে নিয়েছিলেন। এশিয়া কাপ থেকে শুরু করে চলতি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচটি পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কিপটেমি করেছেন রান দেয়ার ক্ষেত্রে। টি২০ ক্রিকেটের ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিংয়েও তার বল খেলতে ঘাম ঝরেছে বিশ্বের আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানদের। সেই তাসকিনের বোলিং এ্যাকশনের ত্রুটি সন্দেহ করার পর থেকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) ওপর বিরক্ত ও নারাজ হয়েছিলেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। সেসব বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পেজ, ব্যক্তিগত প্রোফাইল ঘাঁটলেই দেখা যায়। এমনকি দেশের ক্রিকেটবোদ্ধা, দলের কোচসহ সকলেই আশ্চর্য হয়েছিলেন তাসকিনের এ্যাকশন ত্রুটিপূর্ণ এমন সন্দেহ আম্পায়াররা প্রকাশের পর। তবে এ্যাকশনের পরীক্ষা দেয়ার পর তাসকিন যেমন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তেমনি কোচ, ম্যানেজারসহ দলের সবাই এবং ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সকলেই নিশ্চিত ছিলেন সন্দেহ ভুল প্রমাণ হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হয়নি, সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ হয়েছেন তাসকিন। এরপর থেকেই আইসিসির মু-ুপাত, বিশ্ব ক্রিকেটের প্রধান ‘মোড়ল’ ভারতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে সোচ্চার হয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা। সবারই দাবি অবিলম্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এর বিরুদ্ধে আপীল করুক, যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। বিসিবিও বসে নেই আপীলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমনকি রবিবার শাহবাগে তাসকিনকে ফেরানোর দাবিতে মানববন্ধনও করেছে ক্রিকেটভক্তরা। বিশ্ব ক্রিকেটে যুগ যুগ ধরে ছড়ি ঘুরিয়ে যাচ্ছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত। আর ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজরা কোনভাবেই মানতে পারছে না বাংলাদেশ দলের দুরন্ত উত্থান। বিভিন্ন সময়ে সিরিজগুলোয় তাদের মনোভাব, অভিব্যক্তিতে সেসবই ফুটে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ দল যেন আরও বড় পরাশক্তি হওয়ার পথেই এগিয়ে চলেছে। সে কারণেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে টাইগারদের দাবিয়ে রাখার দুরভিসন্ধিমূলক আচরণ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে ম্যাচে টাইগারদের বিপক্ষে যাওয়া আম্পায়ারদের চরম বিতর্কিত সিদ্ধান্ত তো লেগেই ছিল। এবার যোগ হয়েছে ক্রিকোঁরদের ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। তাসকিনের বোলিং এ্যাকশন বৈধ এমন দাবিই এখন সবার। এমনকি বিসিবির আইন পরামর্শক মুস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেছেন, ‘হল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তাসকিন আহমেদের করা চার ওভারে কোন বাউন্সার ছিল না। কর্তব্যরত দুই আম্পায়ার ভারতের এস রবি ও অস্ট্রেলিয়ার রড টাকার তাসকিনের স্টক ও ইয়র্কার নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পরীক্ষায় এ দুটি নিয়ে ইতিবাচক ফলাফল আসে। সুতরাং পরীক্ষাগারে তাসকিনের বাউন্সারের পরীক্ষা নেয়ার কথা না। কিন্তু চেন্নাইয়ের আইসিসি অনুমোদিত ল্যাবে দ্রুত সময়ের (৩/৪ মিনিট) মধ্যে ৯টি বাউন্সার করতে বলা হয় তাসকিনকে। যার মধ্যে তিনটি অবৈধ প্রমাণিত হয়। আইসিসির ২.২.১৩ ধারার নিয়ম অনুযায়ী স্টক ডেলিভারি’ ছাড়া অন্য কোনো ডেলিভারিতে কনুই ১৫ ডিগ্রীর বেশি বাঁকা হলেও আইসিসি কোন বোলারের বোলিং নিষিদ্ধ করতে পারে না।’ রবিবার শাহবাগে তাসকিন-সানির জন্য শুরু হয় মানববন্ধন। বিকেলে শুরু হওয়া এই মানববন্ধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট ফ্যানস ইউনিটের (বিসিএফইউ) আইসিসির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। একইদিনে সকালে প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)। দু’টি সংগঠনই বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুনের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। তাদের সঙ্গে সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীরাও যোগ দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক থেকে শুরু হওয়া এই ইভেন্টে বলা হয়েছে এই মানববন্ধন চলবে সোমবারও। একই কথা কোচ চান্দিকা হাতুরাসিংহেও বলেছিলেন, ‘তাসকিনের বোলিং এ্যাকশনে কোন ত্রুটি নেই, ত্রুটি আছে আইসিসির মস্তিষ্কে।’ বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক আরও কাছে থেকে দেখেছেন এ তরুণকে। তিনিও নিশ্চিত করেছিলেন কোন সমস্যা নেই তাসকিনের বোলিংয়ে। অথচ সবাইকে ভুল প্রমাণ করলো আইসিসি বাংলাদেশ বিদ্বেষী একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে। তাসকিনের বোলিং এ্যাকশন অবৈধ এবং সাময়িকভাবে তিনি নিষিদ্ধÑ এই খবরটি ছিল পুরো বাংলাদেশের জন্যই বড় ধাক্কা ও বিস্ময়কর। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো তারপর থেকেই প্রতিবাদে সোচ্চার। অনেকেই আইসিসিকে ধিক্কার জানিয়ে, ভারতকে ধিক্কার জানিয়ে পোস্ট দিয়েছেন এবং অবজ্ঞা করে বিভিন্ন রঙ্গচিত্র শেয়ার করেছেন। মিতু নামে একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আজ তাসকিন-সানিকে নিষিদ্ধ করলো, পরবর্তী ম্যাচে মুস্তাফিজকে তারপর তামিম তারপর সাকিববে এভাবে একে একে সবাইকে নিষিদ্ধ করবে। এটা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়।’ শাহরিয়ার মজুমদার আইসিসিকে ব্যঙ্গ করে প্রোফাইল পিকচার দিয়ে সবাইকে আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, ‘শেম ইন্ডিয়া, শেম আইসিসি। চলো সবাই মিলে এটা ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানাই আইসিসির।’ অনেকে আবার বিশ্বকাপ বয়কট করারও আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ দলকে। আর মামলা করার আহ্বান জানিয়েছেন বিসিবিকে। এক্ষেত্রে বসে নেই বিসিবিও। ইতোমধ্যেই হল্যান্ডের বিরুদ্ধে ম্যাচে তাসকিনের বোলিং বিশ্লেষণ করার জন্য কমিটি গঠন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়েছেন সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। করণীয় নিয়ে তিনি বোর্ড পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনা করে জানিয়েছেন, ‘ যেহেতু পেসার তাসকিন আহমেদের সব ডেলিভারি আইন লঙ্ঘন করে না, তাই আইসিসির কাছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাসকিনকে ফেরানোর ব্যাপারে আবেদন করবে বিসিবি। আইসিসির রিপোর্টে বলা আছে, তাসকিনের স্টক ডেলিভারি ও ইয়র্কারে কোন সমস্যা নেই। তাই আমার মনে হয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে তাসকিনের সমস্যা নেই। নির্দিষ্ট কিছু ডেলিভারি না দিলেই হলো। এ ব্যাপারে আমরা আইসিসির কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন করব। আমাদের একটি টেকনিক্যাল কমিটি তাসকিনের ব্যাপারে কাজ করছে। তারা সব কাগজপত্র গুছিয়ে আইসিসির কাছে সেগুলো জমা দেবে। আমার বিশ্বাস আইসিসি তাসকিনের ব্যাপারটি পুনর্বিবেচনা করবে।’ বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও দারুণ হতাশ হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস তাসকিনের বোলিং এ্যাকশন সম্পূর্ণ বৈধ। আমি যাকে নিয়ে কথা বলছি সে আগামী ১০ বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সার্ভিস দিবে। যে ছেলেটা শেষ আটটি ম্যাচ আমাদের হয়ে দারুণ শুরু করেছে, আমাদের জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছে তাকে ছাড়া আমাদের নামতে হচ্ছে কালকের (সোমবার) ম্যাচে। এটা আমাদের জন্যে বড় আঘাত।’ জাতীয় দলের সাবেক তারকা শফিকুল হক হীরা বলেন, ‘বিশ্বকাপ চলা অবস্থায় এমনটি করাতে বাংলাদেশ দলটি বিরাট বড় ধাক্কা খেল। আমার কথা হলোÑ তারা এই সময় করলো কেন! এর আগে এশিয়া কাপ হয়েছে তখন করতে পারত, বা তার আগে এমনটি করতে পারত। এটা আমাদের জন্য বড় ধাক্কা।’ সাবেক উইকেটরক্ষক ও অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলট বলেন, ‘খবরটি শুনে অবাক হয়েছি। এই মুহূর্তে ক্রিকেটারদের সমস্যা করাটা আমার কাছে ভাল লাগেনি। আমার কাছে ভাল লাগেনি এজন্য বিশ্বকাপ চলা অবস্থায় কেন! এর আগেও করতে পারত। বিশ্বকাপের মধ্যে খেলোয়াড়রা দল নিয়ে দলের পারফর্মেন্স চিন্তা করবে। একটা দল হিসেবে তৈরি হতে সময় লাগে। এখন সেখানে আঘাত করা হয়েছে।’
×