ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

ভবিষ্যতের কম্পিউটার

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২২ মার্চ ২০১৬

ভবিষ্যতের কম্পিউটার

১৯৭১ সালের নবেম্বর মাসে ইন্টেল বিশ্বে প্রথম বাণিজ্যিক মাইক্রোপ্রসেসর চিপ ৪০০৪ চালু করে। এক একটি চিপে ছিল ২৩০০টি ক্ষুদ্র ট্রানজিস্টর যার প্রতিটির সাইজ লোহিত কণিকার সমান। তারপর থেকে ক্রমশ চিপের উন্নতি বা উৎকর্ষতা ঘটতে থাকে ঠিক সেভাবে যেমনটি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ইন্টেলের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা গর্ডন মুর। মুরের সেই সূত্র অনুযায়ী মোটামুটিভাবে প্রতি দুই বছর পরপর আরও ক্ষুদ্রতর সাইজের ট্রানজিস্টর সিলিকন ওয়েফারগুলোতে আরও বেশি ঠেসে ঢোকানোর ফলে প্রসেসিং ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়ে যায়। তাতে এগুলোর কার্যক্ষমতা যেমন বেড়ে যায় তেমনি খরচও কমে আসে। ইন্টেলের আধুনিক স্কাইলেক প্রসেসরে থাকে প্রায় ১৭৫ কোটি ট্রানজিস্টর। এর ৫ লাখ ধারণ করা যাবে ৪০০৪ এর একটি মাত্র ট্রানজিস্টরে। সম্মিলিতভাবে এগুলো কম্পিউটিং শক্তির পরিচয় দিতে পারবে প্রায় ৪ লাখ গুণ বেশি। এই বিস্ময়কর শক্তিকে ভৌত জগতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করতে পারা কঠিন। ১৯৭১ সালে মাইক্রোপ্রসেসর চিপে ছিল ২৩০০টি ট্রানজিস্টর। সে সময় বিশ্বের দ্রুততম গাড়ি ‘ফেরারি ডেটোনার’ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৮০ কিলোমিটার। আর বিশ্বের উচ্চতম ইমারত ছিল টুইনটাওয়ার যা ১৩৬২ ফুট উঁচু। আজ মাইক্রোপ্রসেসরের কম্পিউটিং শক্তি যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সেই হারে ১৯৭১ সালের পর থেকে গাড়ি ও স্কাইস্ক্রেপারের বিকাশ লাভ ঘটে থাকলে দ্রুততম গাড়িটি আলোর গতির এক-দশমাংশ ক্ষমতা অর্জন করত। আর উচ্চতম ভবনটি এখান থেকে চাঁদের দূরত্ব যতখানি তার প্রায় মাঝামাঝি অবস্থায় পৌঁছত। মুরস্ ল্য বা মুরের সূত্রের প্রভাব আমাদের চারদিকেই দৃশ্যমান। আজ প্রায় ৩শ’ কোটি লোক পকেটে স্মার্টফোন বহন করে। প্রতিটি স্মার্টফোন ১৯৮০-এর দশকের রুমের সাইজের সমান সুপার কম্পিউটারের চাইতেও বেশি শক্তিশালী। অসংখ্য শিল্পে ডিজিটাল ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে। কম্পিউটিং শক্তির প্রাচুর্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পারমাণবিক পরীক্ষার হারও মন্থর হয়ে গেছে। কারণ, আজ সত্যিকারের পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর পরিবর্তে কম্পিউটারে সিমুলেশন বা অনুকরণমূলক বিস্ফোরণের দ্বারা অধিকতর সহজে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা কাজ সম্পন্ন করা যায়। কম্পিউটিং ক্ষমতার এত বিস্ময়কর বিকাশ ঘটার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু আজ পাঁচ দশক পর মুরস্ ল্য বা মুরের সূত্রের অবসান দৃশ্যমান হতে চলেছে। ট্রানজিস্টর ছোট করলেই যে সেগুলো অধিকতর সস্তা ও গতিসম্পন্ন হবে তেমন আর গ্যারান্টি নেই। তবে তার মানে এই নয় যে, কম্পিউটিংয়ের অগ্রগতি বা বিকাশ সহসা থমকে দাঁড়াবে। বরং প্রকৃত ব্যাপারটা হলো এই অগ্রগতি বা বিকাশের প্রকৃতিই এখন বদলে যাচ্ছে। চিপের বিকাশ এরপরও হতে থাকবে তবে সেটা হবে অপেক্ষাকৃত মন্থর গতিতে। অবশ্য ইন্টেল জানিয়েছে যে কম্পিউটিং শক্তি এখন প্রতি আড়াই বছর পর পরই কেবল দ্বিগুণ হচ্ছে। ভবিষ্যতে কম্পিউটিংয়ের উন্নতি নির্ধারিত হবে আরও তিনটি ক্ষেত্রে যেখানে সাধারণ হার্ডওয়্যারের কিছুই করার নেই। প্রথম ক্ষেত্রটি হচ্ছে সফট্ওয়্যার। এ প্রসঙ্গে ‘আলকাগো’ নামে একটি সফ্টওয়্যারের কথা বলা যেতে পারে। এটি এমন এক প্রোগ্রাম যা ‘গো’ নামে প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা একটা খেলা খেলতে পারে। সম্প্রতি সিউলে অনুষ্ঠিত এক প্রতিযোগিতায় আলকাগো ‘গো’ খেলার সেরা খেলোয়াড় লী সিডলকে হারিয়ে দিয়েছে। মেশিনের কাছে কোন খেলোয়াড়ের হেরে যাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। ১৯৯৭ সালে বিশ্বের সেরা দাবাড়ু বরিস কাসপারোভও এক কম্পিউটার সফটওয়্যারের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। ‘গো’ খেলাটার সঙ্গে দাবা খেলার খানিক মিল আছে। তবে এই খেলাটি কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের কাছে বিশেষ আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এর জটিলতার কারণে। মহাবিশ্বে যত বস্তুকণিকা আছে ‘গো’ বোর্ডে সম্ভাব্য অবস্থানগুলোর সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। তার ফলে মুরের সূত্রানুসারে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে কম্পিউটেশনের যে শক্তি দেয়া আছে ‘গো’ খেলায় জেতার জন্য শুধু সেই শক্তির ওপর নির্ভর করা যায় না। ‘আলকাগো’ নামে যে সফটওয়্যার আছে সেটি এর পরিবর্তে ‘ডীপ লার্নিং’ প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে। মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে ‘ডীপ লার্নিং’ প্রযুক্তিটি অংশত তারই অনুকরণে উদ্ভাবিত। লী সিডলকে হারিয়ে দিয়ে আলকাগো প্রমাণ করে দিয়েছে যে, এই প্রযুক্তির দ্বারা অর্থাৎ নতুন এলগোরিদমের মাধ্যমে বিশাল বিশাল সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। অগ্রগতির দ্বিতীয় ক্ষেত্রটা হলো ‘ক্লাউড’, অর্থাৎ ড্যাটা সেন্টারের যেসব নেটওয়ার্ক ইন্টারনেটের মাধ্যমে সার্ভিস প্রদান করে থাকে সেগুলো। মেইনফ্রেমের হোক আর ডেস্কটপ পিসি হোক, কম্পিউটার যখন স্থির একটি যন্ত্রমাত্র ছিল তখন সেগুলোর পারদর্শিতা সর্বোপরি সেগুলোর প্রসেসর চিপের গতির ওপর নির্ভর করত। আজ কম্পিউটার হার্ডওয়্যারগুলোর কোনরূপ পরিবর্তন না ঘটিয়ে কম্পিউটারকে অনেক বেশি শক্তিশালী করে তোলা হয়েছে। কম্পিউটার আজ ই-মেইল বা অন্য কিছুর মাধ্যমে অনুসন্ধানের মতো কাজ করার সময় ক্লাউডের বিপুল পরিমাণ সম্পদ টেনে আনতে পারে। বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ততার ফলে কম্পিউটারের শক্তিসামর্থ্য বেড়ে গেছে। যেমন স্যাটেলাইট পজিশনিং, মোশন সেন্সর এবং ওয়্যারলেস পেমেন্ট ব্যবস্থার মতো যেসব বৈশিষ্ট্য আজ স্মার্টফোনে আছে সেগুলোর প্রসেসরের গতির মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অগ্রগতির তৃতীয় ক্ষেত্রটা হলো কম্পিউটিংয়ের নতুন আর্কিটেকচার যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। তখন কম্পিউটারের শক্তিসামর্থ্য যথেষ্ট বেড়ে যাবে। সুতরাং, মুরস ল্য বা মুরের সূত্রের দিন শেষ হতে চলেছে। এখন কম্পিউটার প্রযুক্তির লক্ষ্য গত না প্রসেসরের গতি বাড়ানো তার চাইতে বেশি বিভিন্ন ধরনের কার্য সম্পাদনের সামর্থ্য বা ক্ষমতা বৃদ্ধি। এখন বেশি করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হবে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের ওপর। ইতোমধ্যে গুটিকয়েক বড় কোম্পানি যেমন এ্যামাজন গুগল, মাইক্রোসফট, ‘আলীবাবা, বাইদু ও টেনসেন্ট ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এরা এদের ক্লাউড অবকাঠামোর পারদর্শিতা বৃদ্ধির জন্য কঠোর পরিশ্রম করে চলেছে। গত ৫০ বছর যাবত অপ্রতিরোধ্য গতিতে ট্রান্সজিস্টরগুলো ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত করে দেখার ফলে কম্পিউটার একদিকে যেমন অধিকতর শক্তিসামর্থ্যরে অধিকারী হয়েছে তেমনি দামেও হয়েছে সস্তা। এখনও কম্পিউটার ও অন্যান্য উপকরণ অধিকতর শক্তিসামর্থ্য অর্জন করে চলবে। তবে সেটা ভিন্নভাবে এবং ভিন্নপথে। সূত্র: দি ইকোনমিস্ট
×