ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযোদ্ধাকে আর অসম্মান নয় -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:৩৬, ২৪ মার্চ ২০১৬

মুক্তিযোদ্ধাকে আর অসম্মান নয় -স্বদেশ রায়

স্বাধীনতার মাসেও যখন দেশবাসীকে দেখতে হয় মুক্তিযোদ্ধারা অসম্মানিত হচ্ছেন, কোন উচ্চাসনে বসে কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টিটকারি করছেন, তখন দেশবাসীর গৌরবের আর কী থাকে? বাঙালী জাতি পৃথিবীর ইতিহাসে আরও হাজার বছর পরে আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে। তখন দেখা যাবে অনেক বাঙালী বিজ্ঞানী নোবেল পেয়েছেন, অনেক বাঙালী কন্যা মানব সেবার জন্য নোবেল পেয়েছেন, শুধু নোবেল নয়, খেলায়, সঙ্গীতে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, ব্যবসায়ে নানান ক্ষেত্রে ততক্ষণে আমাদের নানান আইকন দাঁড়িয়ে যাবে। সেই হাজার বছর পরেও বাঙালী শুধু এই মার্চ মাসে নয়, জীবনের প্রতিটি সাফল্যের মুহূর্তে যেমন বুকে হাত দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাবে ওই একই সময়ে তারা বিনম্র শ্রদ্ধা জানাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি। সেদিনের সন্তানরা থাকবে অনেক উন্নত বাংলাদেশের সন্তান, তারপরেও তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই কৃষকের কথা, যিনি গামছা পরে, লুঙ্গি পরে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। মনে পড়বে সেই সব তরুণের কথা, যারা মাকে সালাম জানিয়ে বলেছিল, মাগো দেশমাকে মুক্ত করতে যাচ্ছি, যদি ফিরে না আসি মুক্ত দেশে তুমি বুক ফুলিয়ে বলো তোমার সন্তান জান কোরবানি দিয়েছে দেশমাকে মুক্ত করতে। তুমি বীরের মাতা। হাজার বছর পরের সেই বাঙালী সন্তান, মনে করবে সেই মায়ের মুখ, যিনি চোখের সকল অশ্রু চেপে রেখে হাসি মুখে বলেছিলেন, জয়ী হও তুমি। তেমনি সেদিনের ছেলেরা যখন ফরিদপুরের সেই বাবার ইতিহাস পড়বে, যিনি তাঁর তিন ছেলের দুই ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, এমনও মানুষ আছে যাদের একটি ছেলেও নেই। আমার তিনটি দিয়েছেন আল্লাহতালা। আমি তোমাদের দু’জনকে দেশের জন্য উৎসর্গ করলাম। হয় দেশকে মুক্ত করে বীরের বেশে ফিরে আসবে না হয় যুদ্ধক্ষেত্রে জান কোরবানি দেবে। এই বলে ষোলো ও আঠারো বছরের দুই ছেলেকে সেই বাবা মাথায় হাত রেখে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। হয়ত হাজার বছর পরে কোন তরুণ থমকে যাবে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে গিয়ে- দেখবে, যেখানে তিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে রেখে গেছে হাজার বছরের তরুণের জন্য তিন তরুণ বীরের ছবি। এমনি সারাদেশে ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, ছড়িয়ে আছে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথা। বাঙালী জাতির দুর্ভাগ্য হলো, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধ অপমানিত, অপসারিত হতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কী কালোরাত যে নেমেছিল এই বাংলায় তা আজও আমরা সঠিকভাবে বুঝতে পারিনি। কারণ, আসলে আমরা আমাদের দুঃখ রাতের রাজা বঙ্গবন্ধুকে এখনও চিনতে পারিনি। তিনি আমাদের দুয়ারে দুয়ারে কড়া নেড়ে জাগিয়ে ছিলেন, অথচ আমরা সকলে তাঁকে এখনও চিনিনি। চিনিনি, আমাদের চিরকালের রাজা, রবীন্দ্রনাথের সেই সেই দুঃখ রাতের রাজা এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু হয়ে আমাদের মাঝে। আমরা এখনও দুয়ারে তাঁর কড়া নাড়া শুনি, আর আমরা ভাবি, ‘বাতাস বুঝি হবে!’ তাঁকে আমরা এখনও বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারি না কী গভীর কালোরাত ৩২ নম্বরের সিঁড়ি গড়িয়ে লাল রক্ত বেয়ে নেমে এসেছিল এই বাংলায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকে এ দেশে নানানভাবে মুক্তিযুদ্ধের, দুঃখ রাতের রাজার কড়া নাড়ার প্রতিটি শব্দ হয়েছে নিষিদ্ধ। প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করেই ফিরে পেতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি অর্জন, প্রতিটি আইকন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি গৌরবগাথা ১৯৭৫-এর পর থেকে সংগ্রাম করে আমাদের ফিরিয়ে আনতে হচ্ছে। কারণ, পঁচাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশের হাজার হাজার চেয়ারে বসে গেছে মুনতাসীর মামুনের ভাষায় ‘আটকে পড়া পাকিস্তানীরা’। অর্থাৎ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল, যারা ঘৃণিত রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটির সদস্য ছিল। তারা ১৯৭৫-এর পর থেকে কখনও ছদ্মবেশে, কখনও প্রকাশ্যে বসে গেছে দেশের নানান চেয়ারে। তারা সুযোগ পেলেই মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করে। কারণ, যারা একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করতে নেমেছিল, তারা তো এ কাজ করবেই। এ কারণেই ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর থেকে শুরু হয়েছে আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ, সে পথ ছিল অনেক দুর্গম। প্রথমে কিছু তরুণ এ যাত্রা শুরু করেন। এর পরে এসে ওই যুদ্ধের নেতৃত্ব নেন, আজকের অকুতোভয় নেতা, সেদিনের তরুণী শেখ হাসিনা। তাঁর ২৬ বছরের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক বড় অধ্যায়। যে অধ্যায় শত বর্ষ পরে হয়ত পূর্ণাঙ্গ লেখা হবে। আর এই পথে চলতে গিয়ে দেশবাসী দেখেছে রাষ্ট্রীয় নানান চেয়ার থেকে পদে পদে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অপমান। জিয়া-এরশাদ আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর রাজপথেও করা হয়েছে চরম নির্যাতন। কিন্তু যে তরুণ জীবন উৎসর্গ করতে গিয়েছিলেন তাঁকে রোখা যায় না। এমনকি তিনি যদি যুদ্ধাহত হয় তারপরেও তাঁকে রোখা যায় না। তিনি তাঁর মুক্তিযুদ্ধকে উর্ধে তুলে ধরার জন্য, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির সদস্য এই সব ঘৃণ্য জীবদের প্রতিহত করতে জীবন বাজি রাখেন। তাই আমরা দেখেছি, শান্তি কমিটির প্রধান গোলাম আযমকে জিয়াউর রহমান দেশে ঢুকতে দেয়ার পরে, দম্ভভরে গোলাম আযম গিয়েছিল বায়তুল মোকাররমে। সেদিন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পায়ের জুতো খুলে তাকে জুতোপেটা করেছিলেন। আর ওইদিন কিন্তু ওই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অনাগত তরুণদের জন্য এই উদাহরণ রেখে গেছেন যে শান্তি কমিটির সদস্যদের শাস্তি কি? ওদের জন্যে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাই কিন্তু রায় দিয়ে গেছেন যে তাদের জন্য কী করতে হবে। তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগারের গুলি খরচ করো না, তাদের জন্য জল্লাদের মঞ্চ তৈরি করে রাষ্ট্রীয় কাজের সময় নষ্ট করো না। জর্জ ওয়াশিংটন যেমন তার দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা ইংরেজদের দালালি করেছিল তাদের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করেছিলেন, রাষ্ট্রীয় টাকায় কেনা গুলি খরচ নয়, তাদের গায়ে গরম আলকাতরা ঢেলে হত্যা করতে হবে। আমাদেরও কিন্তু শান্তি কমিটির সদস্যদের জন্য যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা রায় দিয়ে গেছেন, দেখিয়ে দিয়ে গেছেন যে তাদের প্রতি কী ব্যবস্থা নেবে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণরা। তরুণ প্রজন্ম জানে এদেশের মানুষ কত কষ্ট করে দেশকে সমৃদ্ধ করছে। তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা দিনরাত কী পরিশ্রম করছেন। তাই ওই ঘৃণিতদের জন্য জনগণের কষ্টের অর্থ ব্যয় নয়, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখিয়ে দেয়া ওই পথই যথেষ্ট। আর তরুণদের তাদের এই দেশকে ওই পাকিস্তানী দালালমুক্ত করার পরিবেশ কিন্তু সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা। এখন সব দায় তাঁর ঘাড়ে চাপানো নয়, এদেশের স্বাধীনতার পক্ষের প্রতিটি মানুষকে যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী এই দায় বহন করতে হবে। সেজন্য অনেককে অনেক দুঃখ নিতে হবে, কষ্ট নিতে হবে। কারণ, শেখ হাসিনা ২০০৯ থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পরে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার জন্য তিনি তাঁর ২৬ বছরের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে এখন শুদ্ধিবিপ্লবের পথ পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এ পথেই জাতিকে শুদ্ধিবিপ্লব শেষ করতে হবে। অর্থাৎ এই দেশ ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট যে পাকিস্তানী দালালদের হাতে চলে গিয়েছিল, দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে পাকিস্তানী দালালরা আছে তাদের হাত থেকে দেশ মুক্ত করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স হয়ে যাচ্ছে, তারা হয়ত আর বেশিদিন সকল দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তরুণ প্রজন্মকে এ দায় কাঁধে নিতে হবে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর কালোরাত বেয়ে এ দেশকে চলতে দেখেছে এদেশের মানুষ। শেখ হাসিনার এই শুদ্ধিবিপ্লবের পথ পরিষ্কার করার পরে যখন দেখা যায় তরুণ প্রজন্ম আবার ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি কণ্ঠে তুলে নিয়েছে তখন দেশবাসী আবার মুক্তিযুদ্ধের সেই সোনার বাংলা ফিরে পাবার আশা দেখে। আশা জাগে- আবার পরিপূর্ণরূপে আসবে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। আর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে সব থেকে সম্মানিত নাগরিক হবেন এ দেশের মুক্তিযোদ্ধারা। আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ. ক. ম মোজাম্মেল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিকভাবে যাবতীয় সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করছেন। এর আগের মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইসলামও করেছিলেন। এ কারণে বর্তমান মন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ থাকবে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জাতি যাতে সর্বোচ্চ সম্মান দেখায়, সকল মুক্তিযোদ্ধা -তাই তিনি গ্রামের কৃষক আর শহরে রিক্সা চালিয়ে জীবন ধারণ করুন না কেন, তিনি যাতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানিত একজন হন সেই কাজটি যেন বর্তমান মন্ত্রী করেন। তরুণ প্রজন্মকে আজ সে দাবিই তুলতে হবে। কারণ, মুক্তিযোদ্ধাদের যতক্ষণ এ জাতি সম্মানিত না করতে পারবে ততক্ষণ জাতি নিজেকে সম্মানিত করতে পারবে না। এটা নিশ্চিত হতে হবে, যেই হোক না কেন- কেউ যেন দম্ভভরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কোন উপহাস না করতে পারে। কেউ যেন তাদেরকে নিয়ে এমন টিটকারি না করতে পারে, আমরা জানি কে কেমন মুক্তিযোদ্ধা! কে কী করেছে? এই অপমান যেন এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি দ্বিতীয়বার আর না ঘটে। যে যেখানে যে পদেই থাকুন না কেন, মুক্তিযোদ্ধা, আ.স.ম আব্দুর রব, মঈনুদ্দিন খান বাদল বিরোধী দলে আছেন, মুক্তিযোদ্ধা কামরুল ইসলাম, আ.ক. ম মোজাম্মেল সরকারের মন্ত্রী, আবার মংলা পোর্টে মাইন বেঁধে পাকিস্তানী জাহাজ ধ্বংসের একজন রমেন সরকার এখন অতি স্বাভাবিক গ্রামীণ জীবন যাপন করছেন। সবাইকে সব স্থানেই যেন দেশ সমান সম্মান করে। কোন ক্ষমতার দম্ভ যেন তাদেরকে কোন অপমান করার সুযোগ না পায়। শেখ হাসিনার বাংলাদেশে সম্মানিত থাকবে মুক্তিযোদ্ধারা। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কারণ, তিনি এদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের নেতা, তিনি শুদ্ধিবিপ্লবের নেতা। সম্মানিত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর প্রতি স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এই আবেদন রাখব- মুক্তিযোদ্ধারা যেন কোনভাবেই আর এ দেশে টিটকারি না শোনে, আর কোনরূপ অপমানিত না হয়। আর যে যত বড়ই হোন কেন, বাংলাদেশে বাস করতে গেলে তাদের প্রতি মুহূর্তে মনে রাখতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের, শহীদের রক্তে কেনা এ দেশ। এ দেশে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বাজে মন্তব্য করা যাবে না, বাজে মন্তব্য করা যাবে না মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান দেশের কৃতী সন্তান বিচারপতি খায়রুল হক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকরণ অপরাধ আইন তৈরি করছেন। তাঁর কাছেও বিনীত অনুরোধ, মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ অপমান করলে সে যেন শাস্তির আওতায় আসে তার বিধানের বিষয়ে বিবেচনা করবেন। [email protected]
×