ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইউপি নির্বাচনে ভোটের অনেক পর সহিংসতা হয়েছে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৪ মার্চ ২০১৬

ইউপি নির্বাচনে ভোটের অনেক পর সহিংসতা হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইউপি নির্বাচনের প্রথম দফায় ব্যাপক সহিংসতার কথা বলা হলেও তা ঘটেছে মূলত ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার অনেক পরে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে সারাদিন ভোট গ্রহণের পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই শান্ত। বেশিরভাগ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে রাতে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে ও নির্বাচন পরবর্তীতে। ভোট গ্রহণের সময় কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সহিংসতার ঘটনা ছিল না। মানুষকে উৎসবমুখর পরিবেশেই ভোট দিতে দেখা গেছে। যে কয়েকটি কেন্দ্রে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তাৎক্ষণিকভাবে কমিশনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নিয়ে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে ভোট গ্রহণ শেষে সন্ধ্যার পরই পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে যায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার কারণে। এ কারণে নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও সহিংসতার ঘটনায় এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে। নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। সব মিলিয়ে ৭১২ ইউপির মধ্যে বিএনপির নির্বাচিত হয়েছে মাত্র ৪০ এর বেশি ইউপিতে। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে এ নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির কথা বলা হলেও তারা ৭শ’টির মধ্যে ৫০টি ইউপির নির্বাচন বাতিলের দাবি জানিয়েছে। বিএনপির দাবি অনুযায়ী ৫০ ইউপি বাদ দেয়া হলে বাকি ভোট সুষ্ঠু ধরা হলেও সেখানেও তাদের ফল বিপর্যয় ঘটেছে। ইসির হিসাব অনুযায়ী এসব ইউপিতে বিএনপি ভোট পেয়েছে ১০ শতাংশের কিছু বেশি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে ৩৪ শতাংশের বেশি। এর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ভোটের হিসাবও বিএনপির চেয়ে অনেক বেশি। এছাড়া ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা বিএনপির চেয়ে বেশি ইউপিতে নির্বাচিত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে কারচুপি হলে এত বেশি মাত্রায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার প্রশ্নই আসে না। অথচ সেখানে স্বতন্ত্র ও অন্যান্য মিলে ১শ’র কাছাকাছি ইউপিতে জয়লাভ করেছে। আগের সব নির্বাচনে বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করা হলেও ইউপি নির্বাচনেও দলটির বিশ্লেষণ ছিল মাত্র ৫০টি ইউপিতে অনিয়ম হয়েছে। এ কারণে তারা ৭১২ ইউপির মধ্যে মাত্র ৫০ ইউপিতে ভোট গ্রহণ বাতিলের দাবি জানিয়েছে। বিএনপির এই বিশ্লেষণটাও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে ইঙ্গিত দেয়। ফল ঘোষণার পরে তাদের প্রতিক্রিয়াও পাল্টে যায়। অথচ ভোটের মাঠে ভোটারদের উপস্থিতিও বলে দেয় কতটা সুষ্ঠু পরিবেশে ভোট গ্রহণ হয়েছে। বিকেল ৪টায় ভোট গ্রহণ শেষ পর্যন্ত দেশের কোথাও বড় ধরনের সংঘর্ষের খবর যেমন পাওয়া যায়নি। নিহতের ঘটনাও ছিল না বললেই চলে। তবে সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। তবে এসব সহিংসতা ঘটেছে প্রতিদ্বন্দ্বী সদস্য পদের সমর্থকদের মধ্যে বিরোধকে কেন্দ্র করে। আবার কোথাও তা আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে। পিরোজপুরে মঠবাড়িয়ায় যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে তা মূলত আওয়ামী লীগ সমর্থক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে একটি গুজবকে কেন্দ্র করে। ঘটনার বিবরণে জানা যায় ধানি চাপায় একটি কেন্দ্রে ভোট গণনা শেষে যখন ফল ঘোষণার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল তখন আওয়ামী প্রার্থীর লোকজন জানতে পারেন যে তারা পরাজিত হতে চলেছেন। ফলে তারা ক্ষিপ্ত হয়েই কেন্দ্র ঘিরে ফেলে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি ছুড়লে ৬ জনের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া ঝালকাঠিতে প্রতিপক্ষের হামলা একজন মেম্বর প্রার্থীর ভাই নিহত হয়েছেন। এর বাইরে কক্সবাজার, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে রাতে নির্বাচনের অনেক পরে। অথচ এসব এলাকায় ভোট গ্রহণের সময় পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই শান্ত। সারাদিন উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরের সারাদেশে ভোট গ্রহণের পরিস্থিতি ছিল একই ধরনের। নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল অতীতে যে কোন নির্বাচনের চেয়ে বেশি। তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে দেখা গেছে। কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ইউপি নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট পড়েছে ৭৩.৮২ শতাংশ। তবে যেসব কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে সেসব কেন্দ্রে তাৎক্ষণিকভাবে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কমিশন জানিয়েছে অনিয়মের অভিযোগে সারাদেশের ১৩টি জেলার ৬৫টি কেন্দ্র ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলায় ১৪টি, খুলনায় দুটি, পিরোজপুরে ১০টি কেন্দ্রে, লক্ষ্মীপুর ও বরগুনায় ১টি করে কেন্দ্রে, ভোলায় ৭টি কেন্দ্রে, কুমিল্লায় দুটি কেন্দ্রে, নোয়াখালীতে ২টি, পটুয়াখালীতে ১২টি কেন্দ্রে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কক্সবাজারের একটি করে কেন্দ্রে ও বরিশালের ১১টি কেন্দ্রে এবং সিলেটের একটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেয়া হয়েছে। সারাদিন মূলত এসব কেন্দ্রে মঙ্গলবার ভোট গ্রহণ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনিয়মের অভিযোগ আসে। তবে এসব কেন্দ্রে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলেও বড় ধরনের কোন সংঘর্ষের ঘটনা নির্বাচন শেষ হওয়ার পর্যন্ত ঘটেনি। কমিশন জানিয়েছে নির্বাচন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চার কমিশনার চারটি বিভাগের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সর্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখেন। কোন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়। এ কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে বড় ধরনের কোন অভিযোগ দেয়া হয়নি। বিএনপির দাবি অনুযায়ী ৫০ ইউপির নির্বাচন বাদে বাকিগুলোর নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে ধরে নিলে বাকিগুলোতে নির্বাচনী ফলে বিএনপির শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। বুধবার ইসির সর্বশেষ দেয়া হিসাবে আওয়ামী লীগ যেখানে ভোট পেয়েছে ৩৩.৩৪ শতাংশ, অপরদিকে বিএনপি ভোট পেয়েছে মাত্র ১০.২৮ শতাংশ। ইসি জানিয়েছে বুধবার পর্যন্ত পাওয়া নির্বাচনী ফলে আওয়ামী লীগ ৩৯৪টি ইউপিতে, বিএনপি ৩৫টি, জাতীয় পার্টি ৭টি, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি ২টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৩টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৭৯টিতে চেয়ারম্যান পদে জয় পেয়েছেন। কমিশন জানিয়েছে ৭১২ ইউপিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৮১ লাখ ২৯ হাজার ৯ জন। এর মধ্যে ৬০ লাখ ৮২৬ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। প্রদত্ত ভোটের বাতিল হয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৪৬৫টি ভোট। এসব ইউপিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে ৩৪ লাখের বেশি ভোট পড়েছে। বিএনপির ধানের শীষে পড়েছে ১০ লাখের বেশি। এসব ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে রায় দিয়েছেন ১৪ লাখ ৪৪ হাজার ৭৮১ জন ভোটার। যা মোট ভোটারের ১৩ দশমিক ৮২ শতাংশ। জাতীয় পার্টির লাঙ্গলে পড়েছে মাত্র দশমিক ৬২ শতাংশ ভোট। ইসি সচিব বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, যেসব জায়গায় ভোট বন্ধ করা হয়েছে সেগুলোতেও তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে। দায়িত্বে অবহেলার কারণে সাতক্ষীরার যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে সেখানে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া সাতক্ষীরায় দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ও সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কমিশনে এসে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
×