ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার

প্রকাশিত: ০৩:৩৬, ২৫ মার্চ ২০১৬

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ স্বাধীনতা জন্মগত অধিকার

স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু সৃষ্টি করেছেন তাঁর খলীফা বা প্রতিনিধি করে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোনো ইলাহ্ নেই; এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য লা মালিকা ইল্লাল্লাহ্- আল্লাহ্ ছাড়া কোনো মালিক নেই। তিনি রব্বুল আলামীন- বিশ্ব জগতের রব্। রব্ শব্দের অর্থ এক কথায় বলা যায় না। এই কারণে রব্ শব্দের অর্থ করা হয় স্রষ্টা, সংরক্ষক, বিবর্ধক, প্রতিপালক, নিয়ন্ত্রণকারী, বিধানদাতা, রিয্কদাতা, তত্ত্বাবধায়ক, সর্বশক্তিমান। সার্বভৌমত্ব একমাত্র তাঁরই। তিনি অদ্বিতীয়। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর সেরা সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : ওয়া লাকাদ র্কারামনা বনী আদাম- আমি তো আদম সন্তানদের (মানুষকে) মর্যাদা দান করেছি। (সুরা বনী ইসরাইল : আয়াত ৭০)। আরো ইরশাদ হয়েছে : ওয়া লিল্লাহি মুলকুস্ সামাওয়াতি ওয়াল র্আদ, ওয়াল্লাহু আলা কুল্লি শায়য়িন কাদীর-আকাশম-লী ও পৃথিবীর সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ্রই। আর আল্লাহ্ সর্ব কিছুর ওপর সর্বশক্তিমান (সূরা-আল-ইমরান: আয়াত ১৮৯)। ওয়া লিল্লাহি মাফিস্ সামাওয়াতি ওয়ামা ফিল্ র্আদ- আসমানসমূহে যা কিছু আছে এবং যমীনে যা কিছু আছে সব আল্লাহ্রই (সূরা নিসা: আয়াত ১৩১)। সেই মহান সৃষ্টিকর্তা খালিক মালিক আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে দান করেছেন জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা; দান করেছেন অন্যান্য সৃষ্টির ওপর কর্তৃত্ব। তিনি মানুষকে চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহের স্বাধীনতা, পছন্দ মতো ঘর-সংসার গড়ার স্বাধীনতা, সুন্দর জীবন গড়ার স্বাধীনতা, প্রকৃতি থেকে সুস্থ ও সৎ পন্থায় সম্পদ আহরণের স্বাধীনতা, জীবনের স্তরে স্তরে ক্রমবর্ধমান সমস্যা সমাধানের স্বাধীনতা, শত্রুতা নিরসন করে বন্ধুত্ব স্থাপনের স্বাধীনতা দিয়েছেন। মানুষের এই স্বাধীনতার নানামাত্রিক দিকের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ইসলাম স্বাধীনতা বলতে বুঝিয়েছে এটা কোনো যথেচ্ছা জীবনযাপন করার নাম নয়। মানুষ অবাধে, নির্বিঘেœ এবং সুখ-শান্তিতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, ভৌগোলিক নিজস্ব সীমানার মধ্যে, আপন মজবুত গ-ির মধ্যে সম্মিলিত প্রয়াসে পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে হায়াতুন্ দুন্য়া বা পার্থিব জীবন গড়ে তুলবে খালিক মালিক রব্বুল আলামীনের দেয়া বিধান অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক পন্থায়। যে কারণে ইসলাম স্বেচ্ছাচারিতা এবং স্বৈর মানসিকতা সমর্থন করে না। মানুষের ইচ্ছাশক্তি আল্লাহ্রই দান। মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করতে যে ভাষাতেই কথা বলুক না কেন, যে শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমেই মনের ভাব বোধগম্য করে প্রকাশ করুক না কেন, সে কথা বলার শক্তি, সে শব্দমালা তৈরির ক্ষমতা আল্লাহ্রই দান। পৃথিবীতে বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে, একই অর্থসহ কথা ভিন্ন ভিন্ন শব্দ বা বাক্যে প্রকাশ করার এই যে বিস্ময়কর উপস্থিতি বিশ্বজুড়ে, তা আল্লাহ্রই দান। কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে : খালাকাল ইন্সানা আল্লামাহুল বাইয়ান- তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিক্ষা দিয়েছেন মনের ভাব প্রকাশ করতে (সূরা রহমান : আয়াত ৩-৪)। মানুষকে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু যে স্বাধীনতা নামক নিয়ামত দান করেছেন তাকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচর্যা করার বিধানও তিনিই দিয়েছেন। মানুষকে পানাহার করার স্বাধীনতা দিয়েছেন তার মানে এটা নয় যে, মানুষ যা ইচ্ছা তাই করবে, জীবিকা নির্বাহের জন্য, ধন-সম্পদ সঞ্চয়ের জন্য জুলুম নির্যাতনের পথ গ্রহণ করবে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য পেশীশক্তির অপব্যবহার করবে, ন্যায়-অন্যায় বিচার করবে না, হালাল-হারামের পার্থক্য নির্ণয় করবে না। ইসলামে স্বাধীনতা হচ্ছে সৎ চিন্তার বিকাশ ঘটানো, সৎ কর্মের পথ করে দেয়া, সুন্দর পবিত্র জীবনযাপন ও মানবতার প্রসার ঘটানো, শান্তির দুনিয়া গড়ে তোলা। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা সকলে আল্লাহ্র রজ্জু সম্মিলিতভাবে মজবুত করে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ স্মরণ করো। স্মরণ করো, তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে সম্প্রীতি সঞ্চারিত করেন; ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা তো আগুনের কূপের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলে, আল্লাহ্ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করলেন। এইভাবে আল্লাহ্ তোমাদের তাঁর নিদর্শনসমূহ স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পারো (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১০৩)। এই আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট আইয়ামে জাহিলিয়াতের সেই র্শিক, কুফর, কুসংস্কার আর অন্ধ বিশ্বাস জর্জরিতকাল হলেও, সেই সরদারশাসিত শতধাবিভক্ত কাল হলেও এর মধ্যে সেই অন্ধকার কাল থেকে আল্লাহ্র মেহেরবাণীতে মুক্তি পাবার কথা বলা হয়েছে। আর এই স্বাধীনতার আলোকচ্ছটার যে ইশারা এতে বিধৃত হয়েছে তা সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য। এখানে যে আগুনের কুয়োর কথা বলা হয়েছে, যে অগ্নিকু-ের উল্লেখ করা হয়েছে, তার দ্বারা মানুষের প্রকাশ্য দুশমন শয়তান প্ররোচিত সমাজকে বোঝানো হয়েছে, পরাধীনতার ভয়াবহ চেহারা অগ্নিকু-ে এই উচ্চারণের মাধ্যমে প্রকটভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আমরা জানি ইসলাম প্রকৃত স্বাধীনতার কথা বলে। আইয়ামে জাহিলিয়াতে শুধু আরব সমাজেই নয়, জগতজুড়ে মানবতা এক মারাত্মক হুমকির মধ্যে নিপতিত ছিল। ক্রীতদাস প্রথা এমন মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল যে, গরু-ছাগল, উট-মহিষ, মেষ-দুম্বার মতো মানুষও হাটে-বাজারে বিক্রি হতো, নারী সমাজের মর্যাদা একেবারে ছিল না, তারা সাধারণ পণ্যসামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হতো, তাদের আত্মাহীনা, শয়তানের ফাঁদ, ছলনাময়ী প্রভৃতি নানা বদনামে ভূষিত করা হয়েছিল। মদ্যপান, সুদ, লুণ্ঠন, কন্যা সন্তানের জীবন্ত কবর দেয়া, গুম, খুন, হত্যা, রাহাজানি, কল্পনাপ্রসূত দেব-দেবী কাঠ-পাথর-মাটি দিয়ে বানিয়ে সেগুলোর পূজা করা প্রভৃতি মানবতাকে এক করুণ ও অপমানজনক অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। আইনের শাসন বলতে কোথাও কিছু ছিল না, মানবিক মূল্যবোধ বলতে কোথাও কিছু ছিল না; সর্বত্র বিরাজ করছিল নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য। স্বাধীনতা কল্পনাতীত বিষয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ইসলামের শান্তির বাণী, স্বাধীনতার বাণী নিয়ে আবির্ভূত হলেন হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম। তিনি আল্লাহর দেয়া পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা আল ইসলামের দিকে সবাইকে আহ্বান করলেন। তিনি সর্বস্তরের মানুষকে, নারী-পুরুষ সবাইকে একটি সুসংহত স্বাধীন সত্তা বিকাশের দিকে পরিচালিত করলেন। তিনি বললেন : প্রতিটি মানব শিশুই ভূমিষ্ঠ হয় ফিত্রতের ওপর। এই ফিত্রত বা প্রকৃতিই মানুষের স্বাধীনতা সত্তার পরিচয় বহন করে। এই স্বাধীনতাকে হরণ করা, ক্ষুণœ করা কিংবা কারও স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার অধিকার ইসলাম দেয় না, তবে স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যা ইচ্ছা তা-ই করা যাবে, অন্যের সম্পদ গায়ের জোরে আত্মসাত করা যাবে, বিনা অপরাধে কাউকে হত্যা করা যাবে, বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যাবে, দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করা যাবে। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : লা তুফ্সিদু ফিল্ র্আদ- পৃথিবীতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না (সূরা বাকারা : আয়াত ১১), কুরআন মজীদে এটাও ইরশাদ হয়েছে যে, প্রাণের বদলে প্রাণ, চোখের বদলে চোখ, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে অনুরূপ জখম। অতঃপর কেউ ক্ষমা করলে তাতে তারই পাপ মোচন হবে। আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না, তারাই যালিম (সূরা মায়িদা : আয়াত ৪৫)। স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব একটি অমূল্য সম্পদ এবং আল্লাহ্র এক মহা নিয়ামত। একে রক্ষা করার জন্য যারা সীমান্ত প্রহরায় থাকে কিংবা এর হিফাজতের জন্য সর্বস্তরের মানুষে নিজেদের গরজে এবং জনস্বার্থে দেশ গঠনমূলক কাজে ব্যাপৃত থাকে তাদের জন্যও রয়েছে অশেষ পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি। সুদ, ঘুষ, ব্যাভিচার, চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই- এ সবই স্বাধীনতার জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরের অর্থ সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকের নিকট পেশ করো না (সূরা বাকারা: আয়াত ১৮৮)। প্রিয়নবী হযরত রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : আররাশী ওয়াল মুরতাশী কিলাহুমা ফীন্নার- ঘুষ দাতা এবং ঘুষ গ্রহীতা উভয়েই জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে (ইবনে মাজা)। ঘুষ যেমন মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দেয়, সমাজরন্ধ্রে দুর্নীতির বিষবাষ্প ছড়িয়ে সমাজ জীবনকে নিশ্চিত অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যায়, তেমনি সুদও শোষণের এক মস্তবড়ো হাতিয়ার যা আর্থনীতিক জীবনে একটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির জন্ম দেয়। সাময়িক লাভের স্বপ্নদৃষ্ট হলেও এটা মারাত্মক ব্যাধির মতো হয়ে দাঁড়ায়, অনেক সময় দেউলিয়া পর্যায়ে নিয়ে যায়। কুরআন মজীদে সুদের ব্যাপারে কঠোর নিষেধসূচক বিধান দিয়ে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : যারা সুদ খায় তারা সেই ব্যক্তিটারই মতো দাঁড়াবে যাকে শয়তান স্পর্শ দ্বারা পাগল করে। এটা এই জন্য যে, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় তো সুদের মতো। অথচ আল্লাহ্ ক্রয়-বিক্রয়কে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম (সূরা বাকারা : আয়াত ২৭৫), আল্লাহ্ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানকে বাড়িয়ে দেন (সূরা বাকারা: আয়াত ২৭৬)। স্বাধীনতা মানুষের সুখী জীবনযাপনের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে, তবে ইসলাম যা হারাম করেছে, যা পানাহার করতে নিষেধ করেছে তা করার স্বাধীনতা ইসলাম দেয় না। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন: হে মানব জাতি! পৃথিবীতে যা কিছু বৈধ পবিত্র (হালালান্ তাইয়েবা) খাবার জিনিস আছে তার থেকে তোমরা আহার করো (সূরা বাকারা : ১৬৮)। ইসলাম পরনিন্দা পরচর্চা, কারও বাড়িতে বা জমিতে জোর করে অনুপ্রবেশ ইত্যাদি কর্ম করার স্বাধীনতা দেয় না। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে : তোমরা একে অপরের গীবত করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশ্ত খেতে পছন্দ করবে? না, তোমরা তো তা অপছন্দ করো (সুরা হুজুরাত : আয়াত ১২)। গীবত করাও যেমন জঘন্য কাজ, তা শোনাটাও জঘন্য কাজ। এমনিভাবে আমরা লক্ষ করি স্বাধীনতা মানে মানবাধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের একটা সুন্দর, সুশোভিত ও সুমিষ্ট ফল। যারা স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তোলে তারা মানবতাকে অপমান করে- আল্লাহ্র এই মহা নি’আমতকে অবজ্ঞা করে। লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ, উপদেষ্টা ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.), সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
×