ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুক্তিযুদ্ধ দিনের স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৭:২৭, ২৬ মার্চ ২০১৬

মুক্তিযুদ্ধ দিনের স্মৃতি

করে ভুলি! মুনীরের কথা ভুলতে পারি না। প্রত্যেক সভা শেষে মুনীর আমার কাছে এসে দাঁড়ায়: ‘চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি’-কণ্ঠ আর শুনি না। ডিসেম্বরের ১০/১২ তারিখ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ফোন করেছিলেন, আমি বাড়ি থেকে সরে কোথায় যাব কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘শুনেছি অনেককে মেরে ফেলার লিস্ট হয়েছে, তার মধ্যে আপনার আমারও নাম আছে, কি করবেন? কোথাও সরে যাবেন?... বলতে বলতেই ফোনের লাইন কেটে দেয়া হলো। আর কথা হয়নি। জালেমের দল তাকে মেরে ফেলেছে। আমি কোথাও যাইনি। কিন্তু প্রায়ই ফোনে উর্দুতে হুমকি পেয়েছি ওরা আসবে বাসায়। আমিও বলেছি মোকাবেলা করবো, আস। আমার বাসার পেছনে সোভিয়েত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কার্যালয় ছিল। একাত্তরের দুঃসময়ে ওরা অনেক সহযোগিতা করেছে। আমার বাসায় ৭ নবেম্বরে সোভিয়েত কন্সাল মিঃ নভিকভ এসেছিলেন। শহীদুল্লাহ কায়সার এসেছিল। চায়ের টেবিলে বসে কথা হচ্ছিল। শহীদুল্লাহকে ওরা বললো, ঢাকায় থাকা নিরাপদ নয়, সীমান্ত পেরিয়ে যাও। শহীদুল্লাহ হেসে উড়িয়ে দিল। বললো, খালাম্মা কোথাও যাচ্ছেন? আমি বললাম, না। আমাকে কিছু করবে না। তুমি যাও। বলল, তা হয় না। থালাম্মা থেকে গেলেন, আমিও যাব না। ৭ ডিসেম্বরের পরেও খবর দেয়া হয়েছিল সোভিয়েত বন্ধুদের কাছে গিয়ে থাকতে, গেল না। ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার আলবদরের দল ওকে মেরে ফেলল। ভুলবো কি করে গিয়াস উদ্দিনের কথা? মাথায় গামছা বেঁধে লুঙ্গি পরে গিয়াস প্রায়ই রাতে চুপিসারে পিছন পথ দিয়ে দেয়াল টপকে আসতো রিক্সাওয়ালা সেজে। চাল নিয়ে যেত বস্তায় করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। প্রতিবেশী অনেকেই ঢাকা ছেড়ে যাবার আগে আমার কাছে রেশন কার্ড রেখে গিয়েছিলেন। সেই কার্ডে আমি চাল চিনি উঠিয়ে রাখতাম। সেগুলো গিয়াস নিয়ে যেত। গিয়াসের ওপর কাপসেনা রাজাকারদের চোখ ছিল অতন্দ্র। ১৪ ডিসেম্বর ওকেও রাজাকাররা হত্যা করেছে। একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে যখন মেয়েদের ওপর পাকসেনাদের নজর পড়লো, ঘটনা ঘটতে থাকলো মেয়েদের বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া, তখন বোরহাউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বেবী মওদুদ, আইনজীবী মেহেরুন্নেসা খাতুন, নাহাস আরো অনেকে মিলে এর প্রতিকারের জন্য চেষ্টা করেছিল। এরা সবাই মিলে মেয়েদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতো। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কাপড়, খাবার এসবের যোগান দিত। ওদের সভায় আমাকেও নিয়ে ছিয়েছিল। ওদের আমাদের কারো তেমন কিছু করার ক্ষমতাই ছিল না মেয়েদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার। মার্চ-১, সোমাবার, রাত দশটা বিক্ষুব্ধ বাংলা। ভুট্টো সাহেব পরিষদে যোগ দিবেন না সিদ্ধান্তে। পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি রইল। ১২টায় এ খবর প্রচারিত হওয়ায় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। অনার্স পরীক্ষা ২ তারিখে আর ৬ তারিখে শেষ হওয়ার আশাও গেল। আজ ইন্টারমিডিয়েট কলেজে মেয়েরা শহীদ মিনার উদ্বোধন করার জন্য আমাকে নিয়ে গেল, কিন্তু গোলমালে সবই বন্ধ হয়ে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান আরও অনেক নেতার এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কাল ঢাকায় হরতাল, পরশু সারা প্রদেশব্যাপী হরতাল ঘোষণা করা হলো। মার্চ ২, মঙ্গলবার, রাত ৯টা আজ রাত ৮টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ অর্ডার হয়ে গেল। আমরা ঘরে এলাম ৭টায়। শামীম কাল রাতে অফিসে গেছে আজও আসতে পারল না, কালকেও পারবে না, পরশু বাড়ি আসবে। শুধু ঢাকায় হরতাল হবার কথা ছিল। কিন্তু প্রদেশের সব জায়গায় আজ হরতাল হলো। কালও হবে। কাল সন্ধ্যা থেকে প্লেন সার্ভিস বন্ধ। এয়ারপোর্টের আলো পানি টেলিফোন লাইন সব কেটে দিয়েছে। ট্রেন চলাচলও বন্ধ। ফার্মগেট-এ ইটের ব্যারিকেড ঘিরে দেয়ার সময় আর্মির গুলিতে একজন মরেছে, তিন জন আহত হয়েছে। এই মাত্র শোনা গেল নওয়াবপুরে খুব গ-গোল চলছে। দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন বিল্ডিং-এর পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকা পতাকা উড়িয়েছে। ভাসানী সাহেবের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের আলাপ আলোচনা প্রকাশ করা হয়নি। বায়তুল মোকাররাম এ আমেনা বেগমকে জনতা অপমান করেছে বলে জানা গেল। কারফিউ ভেঙ্গে জনতা মিছিল করছে, মরছে। মার্চ ৩, বুধবার কাল সারা রাত হট্টগোল চলেছে। জিন্না এ্যাভিনিউ, নবাবপুরে লুট মারামারি হয়েছে। আজ সকালে কাগজে তিন জনের মৃত্যু সংবাদ দিল। বিকালে পল্টনে ছাত্রদের শোকসভায় লক্ষ লোকের সমাবেশে শেখ মুজিব নিজের আদেশ প্রচার করেছেন। সমস্ত অফিস কারখানা বন্ধ করে দিতে বলেছেন। ব্রিগেডিয়ারকে বলেছেন, সে দেশ রক্ষার জন্য বেতন নিচ্ছে এখানে জনতার ওপর গুলি না চালিয়ে বর্ডারে গিয়ে দেশ রক্ষার কাজ করুক। সাবাশ! এইত চাই। জনতা উন্মাদ হয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলা করছে। ৭ তারিখ পর্যন্ত হরতাল। সকাল থেকে ২টা পর্যন্ত চলবে। ১০ তারিখে ইয়াহিয়া নাকি ঢাকা এসে সভা ডাকছে, এসেম্বলি বসবে। আজ রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা কারফিউ। ভাসানী সাহেব পলাতক। মার্চ ৪, বৃহস্পতিবার পল্টন ময়দানে শহীদদের জানাজা হলো। কত মায়ের বাছা, বধূর স্বামী, ভাইয়ের ভাই চলে গেল। লুটতরাজ আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা রোধ করছে। কারফিউ উঠে গেল। হাসপাতালে আহতের সংখ্যা ৪০; বিবিসির খবরে ২ হাজার মারা গেছে। আরও কত যাবে কে জানে; রক্ত সংরক্ষণের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। ড. আনিস রক্ত দিয়ে এলেন। সারাদিন মিছিল চলছে। মার্চ ৬, শনিবার, রাত ১০টা ইয়াহিয়া রূঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন, আর্মি নেভি তার হাতে থাকা পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গুটিকয় সুবিধাবাদীর হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন না। দেখা যাক। আগামীকাল ঘোড়দৌড় ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হবে। মার্চ ৭, রবিবার, রাত ৯টা সকাল থেকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে (ঘোড়দৌড় ময়দানের নাম বর্তমানে এটি) লোকজন জমা হচ্ছে। ১টার সময় তাড়াহুড়া করে আমরাও রিকশা করে গিয়ে পৌঁছলাম। মঞ্চের সামনেই স্থান পেলাম। মেয়ে স্বেচ্ছাসেবিকারা বলল, বসুন, আপনি আমাদের নিজের লোক, মনের মানুষ, কাছের মানুষ। এমএনএরা গিয়ে দূরে চেয়ারে বসুন। অন্তরটা জুড়িয়ে গেল শুনে। আমি দেশের মানুষের মনের মানুষ। একী কম ভাগ্যের কথা। ৩টা ২০ মিনিটে মুজিব এলেন বিমর্ষ মলিন মুখে। সৈন্যবাহিনী সামরিক আইন প্রত্যাহার না করলে তিনি অধিবেশনে যোগ দিবেন না। রেডিওতে তাঁর বক্তৃতা রিলে করে দেয়া হলো। তিনিও অফিস আদালত স্কুল কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখতে বললেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ করলেন। মার্চ ১১, বৃহস্পতিবার, রাত ১১টা মহিলা পরিষদে শান্তি কমিটি গঠনের প্রস্তাব নেয়া হলো। সারা আলীর বাড়িতে কমিটি মিটিংয়ে আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হলো মহিলা পরিষদ থেকে ১ হাজার টাকা রোকেয়া স্মৃতি কমিটিতে দেয়া হবে। আজ কাগজে আছে সামরিক রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে না চললে সামরিক আইনে বিশেষভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। রাতে হাজারীর বাড়ি নিয়োগী বাবুর সঙ্গে দেখা হলো, অনেক কথা হলো। অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছি বললে বললেন, এ অন্তর্দ্বন্দ্বের কি শেষ আছে? বহু যশ, বহু মান আরও ভাগ্যে নাকি আছে! কিন্তু মৃত্যুর চেয়ে কাম্য আর কি আছে? আজ বসন্ত পূর্ণিমা। মার্চ ১৭, বুধবার কাল রাতে ও আজ সকালে মুজিবুর রহমান-ইয়াহিয়ার বৈঠক হলো, কোন কথাই এখনও জনসাধারণের কাছে প্রকাশিত হলো না। কাল আবার বৈঠক বসবে। জাস্টিস কর্নেলিয়াসকে আনানো হয়েছে, চারজন জেনারেলও বৈঠককালে প্রেসিডেন্ট হাউসে উপস্থিত থাকেন। মুজিব বন্দী জনগণের মতামতে, ইয়াহিয়া বন্দী সেনাবাহিনীর হাতে। মার্চ ১৮, বৃহস্পতিবার আজিমপুর লেডিস ক্লাব-এ আজ মহিলা পরিষদ থেকে সংগ্রাম কমিটির সভা হলো। অনেক মেয়েরা এসেছিলেন। বেশ উৎসাহী আজ-কাল দেশের মানুষ। তাই দেখা গেল কয়েকজন পুরুষ মানুষও এসে সভায় শামিল হলেন। উৎসাহ বাক্যে সমর্থন জানালেন। সব দুঃখের মাঝে এ যে কত বড় আশা। মার্চ ২০, শনিবার, রাত ১টা (৪০ নং এনায়েত বাজার, চট্টগ্রাম) মহিলা পরিষদের সভায় চাটগাঁ আসবার জন্য বেলা ১২টায় এসে ট্রেনে বসেছি। রাত ১০টায় চাটগাঁ এসে উঠলাম। মালেকা আর আমি। দুলু, সিমিন, আব্বু স্টেশনে ছিল, নজমুল হুদা ছিলেন। কওসর, মোরাদ কেউ বাড়ি নেই। এতক্ষণে দুলুর সঙ্গে গল্প করে উঠলাম। মার্চ ২৪, বুধবার, রাত ৯টা পলাশী ব্যারাক স্কুলে আজ মহিলা পরিষদের সংগ্রাম কমিটির শাখা করে এলাম। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তবুও মেয়েদের এই উৎসাহে ভাটা পড়ে না যায়। একি সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য তা বুঝতে পারছি না। আজ সকালে মেহেরুন এসে বল্লে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে বলে কাল রাতে মিরপুর ওদের সেকশনে বিহারীরা আগুন লাগিয়েছে। এ রূঢ়, রুষ্ট বিহারীদের নিয়ে দিনে দিনে সমস্যা জমে উঠছে, বাঙালীরা এবার যথেষ্ট ধৈর্ঘ দেখিয়েছে। আজও ভুট্টো ইয়াহিয়ার কোন শুভবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া গেল না। বৈঠকের শেষ নেই। এপ্রিল ১৩, মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গা স্বাধীন বাংলার রাজধানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন। নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানকে নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়েছে। ভারতীয় বেতার থেকে প্রচারিত, অস্ট্রেলিয়ান বেতার থেকে সমর্থিত। খবর সত্য নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন। শাহজালালের দরগা ধ্বংস করারও খবর পাওয়া গেল। প্রবল গোলাবর্ষণে চাঁদপুর, সিলেট, রাজশাহী, পাবনা, চট্টগ্রাম বিধ্বস্ত। বৃষ্টির দরুন বাংলায় সেনাবাহিনীর অসুবিধার কথাও বলা হয়েছে। ভারত, রাশিয়া বাংলাকে সাহায্য করতে ইচ্ছুক। সিলেটে বিমানবন্দরে শালুটিকরের রাডার যন্ত্র বাংলাবাহিনী নষ্ট করে দিয়েছে। দিনাজপুরে প্রচ- বোমাবর্ষণ চলেছে। এপ্রিল ১৭, শনিবার, রাত ১০টা দুপুর ৩টা থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, এও আল্লাহর রহমত। কসবা, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রচ- গোলাবর্ষণ হচ্ছে। কোথাও কোন পথ ঘাট খোলা নেই। কাগজে জঘন্য মৃত্যুর প্ররোচনা, মিথ্যা প্রচার চলছে। মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার কথা শোনা গেল। যে যেখানে আছে যেন আল্লাহ হেফাজতে রাখেন। বড় দুঃখ, বড় শোকের ব্যাপার, মেহেরুন নেসা, তার মা, দুই ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। আল্লাহ যেন এই নিষ্পাপ অসহায়দের রক্তের বিনিময়েই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেন। আর কত রক্ত, কত প্রাণ দিতে হবে! বাংলার লাখ লাখ মানুষ কাদের হাতে কোন মোনাফেকের হাতে মরছে। আল্লাহ কি দেখছে না! মে ১, শনিবার, রাত ১০টা আজ মে দিবস। সারা দুনিয়ার মেহনতি মানুষেরা এক হোক, জাগুক মানবতা! বিশ্ব নবীর উদাত্ত আদেশÑসব মানুষ এক , এ সত্য মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান যে দম্ভে পদদলিত করছে তার সে দম্ভও যেন জন জাগরণের পদতলে পিষ্ট হয়। মে ১৭, সোমবার আশপাশের বাড়িতে মৃত্যুর বিভীষিকা, সন্তানহারা জননী, স্বামীহীনা স্ত্রী, পিতৃহীন শিশুর মুখ দেখি। গ্রামে গ্রামে মরণ লীলা। শহরের পথে সন্ত্রস্ত পথিকের নিঃশ্বব্দ পদচারণা। তবুও হারামজাদারা স্বাভাবিক অবস্থাই বলে যাচ্ছে। শুনি নারী দেহ নিয়ে কামার্ত পশুরা ছিনিমিনি খেলছে। তরুণ তাজা কিশোর যুবকের রক্ত শুষে নিচ্ছে। আল্লাহ আর কত শোনাবে, কত দেখাবে। এবারে শেষ কর প্রভু। আজ ইডেন বিল্ডিংয়ে, মতিঝিলে ২টি ব্যাংকে ও নিউমার্কেটে টাইম বোম ফেলে গেছে। কোন কাগজে খবর বের হবে না জানি। জুলাই ১, বৃহস্পতিবার, রাত ১০টা দিনে দিনে এ মাসও এসে গেল। দুর্বিষহ দিনরাত কেটে যাচ্ছে। কি করে যে কাটায়, সেই অকরুণই শুধু সে খবর জানে আর কেউ জানে না। হত্যার শেষ নেই, নারীর লাঞ্ছনার সীমা নেই। জুলুম ধর-পাকড় অব্যাহত। দেশের মানুষ পরাশ্রয়ী, তবু এর কোন সুরাহা করছে না শাসক দল। ইসলাম, মুলমানের নাম শুনে আজ সবাই ঠাট্টা করে, ঘৃণাও করে, কি পরিতাপ। লিখতেও ইচ্ছা করে না। গ্রাম থেকে নিত্য নতুন অত্যাচারের খবর আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল সব খালি। জুলাই ১৫, বৃহস্পতিবার, রাত ১০টা বাংলাদেশে পরীক্ষা শুরু হয়েছে, কে যে কি পরীক্ষা দিচ্ছে আল্লাহ জানে। ঘর ছাড়া মা বাপ ছাড়া মরা আধ মরারা পরীক্ষা দিচ্ছে। এও এক প্রহসন। আজ ১৫ তারিখ ঠিক এমনই সময়ে ওরা ঘর ছেড়ে গেল। সমুদ্রে কত তরঙ্গ। নদীতে কত স্রোত। বৃষ্টির কত ধারা। মায়ের বুকের কত ব্যথা। জুলাই ২০, মঙ্গলবার, রাত ৯টা কাল থেকে দিনে রাতে কতবার যে বোমার শব্দ হলো। চামেলী বাগ, হাতিরপুল, ধানম-ি স্কুলে গত রাতে বোমা পড়েছে। আজ বোমারু বিমান উড়েনি। জুলাই ৩০, শুক্রবার, রাত ৯টা বিকালে বৌমা আমি হাসিনার ছেলে দেখতে হাসপাতালে গেলাম। কি ভীষণ দুর্র্ব্যবহার যে করল ওখানের মিলিটারি পাহারাদারটা। হাসিনার মা মাত্র ১০ মিনিটের জন্য গতকাল ওদের দেখতে পেয়েছিলেন। আজ হতে কড়া নিয়ম চালু করা হলো, কোন মানুষই আর ওদের দেখতে যেতে পারবে না। এ যে কী অমানুষিক ব্যবহার। জেলখানার কয়েদীও সাক্ষাতের জন্য সময় পায়। আগস্ট ২১, শনিবার, রাত ৯টা আমার সন্তান, আমার দেশ, দেশের মাটি,মাটির মানুষেরা সামরিক নির্যাতন, বন্যা, মহামারীতে আর কতো মরবে। আল্লাহ ভালো কর। রহম কর। মুজিবের হায়াত দাও, বাংলাদেশের ভালো কর। আমারও ভালো হোক। আজ স্বাধীন বাংলা বেতারে বদরুন (বদরুন্নেসা আহমেদ) বলল। সবাই চলে গেলো, আমিই রইলাম। ডিসেম্বর ৬, সোমবার আজ ১১টায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশকে স্বাধীন গণতন্ত্রী বাংলাদেশ বলে স্বীকৃতি দান করলেন। বাংলার এক মুঠো মাটি রক্তসিক্ত শহীদের খ- হৃদপিন্ড। জানিনা আজকের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর এ স্বীকৃতির মর্যাদা বাংলার মানুষেরা সঠিকভাবে নিয়ে সত্যই গণতন্ত্রী এক মহান বাংলাদেশকে সদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে রাখার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করবে কিনা। সন্দেহ, শঙ্কা সবই আছে। আমার যাদুধনদের বুকের রক্তে রাঙা এ মাটি। বড় পবিত্র। আল্লাহ এর মর্যাদা রক্ষা করুন। বিমান আক্রমণ চলছে। পাকিস্তানী একটি বিমানও উড়তে দেখা গেল না। ডিসেম্বর ১৬, বৃহস্পতিবার আজ ১২টায় বাংলাদেশ যুদ্ধ বিরতির পর মুক্তিফৌজ ঢাকার পথে এসে আবার সোচ্চার হল জয় বাংলা উচ্চারণে। আল্লাহর কাছ শোকর। বুক ভেঙে যাচ্ছে। সুখ-দুঃখের অনুভূতি কমে গেছে যেন, তবুও একি শিহরণ। আল্লাহ! তোমার দানের অন্ত নেই। ইন্দিরা গান্ধী শতায়ু হোন। শতবার কৃতজ্ঞতা জানিয়েও তার ঋণ শোধ হবে না। জয়যুক্ত হোক সোভিয়েত রিপাবলিক। আমার বাবা আমার কাহহার আজ বেঁচে নেই। আজ ২৯ দিন হল, সে শুয়ে আছে মাটির কোলে। আর আজ কি শোকাবহ ঘটনা। জয় মিছিল দেখতে গিয়ে হাতেম আলীর শালীর মেয়ে জলির বড়বোন ডলি ১৮ নং রাস্তায় গিয়ে মিলিটারির উন্মতার দরুন গুলিতে মারা গেল। আহা! মা বেঁচে আছে যে। এ যে কী করুণ দৃশ্য।
×