ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমার বাবা ॥ শহীদ বুদ্ধিজীবী

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২৬ মার্চ ২০১৬

আমার বাবা ॥ শহীদ বুদ্ধিজীবী

এস এম এ রাশীদুল হাসান রোকাইয়া হাসিনা নীলি বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে বাবাকে ধরে নিয়ে যায় এবং ২২ দিন পরে বাবার গলিত লাশ মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে বাবাকে সমাহিত করা হয়। সারা জীবনে বাবা দু’বার মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। কিন্তু পাকিস্তানের দোসর রাজাকারদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিলক্ষেত আবাসিক এলাকায় পাক বাহিনী আক্রমণ করে। আমাদের বাসায় ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। আমরা একটি ছোট রুমে লুকিয়ে ছিলাম; তারা আমাদের অবস্থান বুঝতে পারেনি। আমি ছিলাম বাবার নেওটা, ছিলাম তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমার বয়স তখন মাত্র বারো বছর। বাবা কোথাও গেলে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন, না নিলে আমি কান্না শুরু করতাম। বাবাই ছিলেন আমার খেলার সাথী, আমার সকল আব্দার বাবাই মেটাতেন। পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া রেডিও ও টেলিভিশনে নিষিদ্ধ ছিল। সরকার বরীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করত না। সে সময়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থাকতে হতো। তবুও বাবা আমাকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলছিলেন। আমার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন বাবা বাড়িতে আমার গানের শিক্ষক রেখেছিলেন। বাবাকে হারানোর বেদনা আমি আজ বহন করে চলেছি। স্মৃতিপটে আজও বাবার সঙ্গে আমার অনেক ঘটনা ভেসে ওঠে। বড় হয়ে তাঁর ডায়রি পড়েছি, ডায়রিতে আমাকে নিয়ে অনেক ঘটনার উল্লেখ আছে। এখানে আমি ডায়রি থেকে তাঁর লেখা একটি ঘটনা বলছি, “৮:৩০-৯:৩০ সকাল: মা হাসীনাসহ নিউমার্কেটে তার বই কিনে, তরকারির বাজারে শাকসবজি ও গোশতের দোকানে গোশত নিলাম। তার আর একটি বই নিলাম না বলে মা রাগ করে আমার সঙ্গ ছেড়ে অভিমানে একাকী পালিয়ে যেতে চায়, তাকে পিছু ধাওয়া করে সঙ্গে নিলাম। সেই অভিমানী আবার হাটে কুল দেখে প্রার্থনার সুরে বলল : আব্বা আমাকে কুল কিনে দাও। ভেবেছিলাম, সে আজ আর আমার সঙ্গে কথাই বলবে না। কিন্তু জানি তো, এ পর্যন্ত সে কোনোদিনই আমার সঙ্গে এক ঘণ্টাও আড়ি দিয়ে থাকতে পারেনি।” বাবা ১৯৬৯ সাল থেকে ডায়রিতে প্রতিদিনের ঘটনাবলী লিখতেন। ১৯৭১-এর ডায়রিটি জাতীয় জাদুঘরে থাকায় ১৯৬৯ সালের ডায়রি থেকে বাবার লেখা কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ বাবা লিখলেন, “দেশের জনগণ ও তাদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে কেহই বেশিদিন শাসকের আসনে টিকে থাকতে পারে না। সত্যিকার দেশ শাসক হবে জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতীক, তার ওপর জনগণের আশা আস্থাই হবে তার শক্তির ভিত্তি। সত্যকার শাসক সব সময় জনগণের সেবক, প্রকৃত প্রস্তাবে খাদেম বা সেবক।” ছয় দফা দাবি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন তখন উত্তপ্ত। বাবা তার চিন্তা ভাবনা ও অনুভূতির কথা ডায়রিতে লিখে রাখতেন। পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপি-িতে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক চলছে। ফলপ্রসূ কোন সংবাদ দেশের মানুষ পাচ্ছে না। বাবা ১২ মার্চ ১৯৬৯ লিখলেন : “সারাদেশে অশান্তি ও বেদনার্ত ভাব। দেশ জননী যেন নতুন জন্ম বেদনার প্রহর গুনছে। ড: শামসুজ্জোহার হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে আমাদের (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি) ধর্মঘট অব্যাহত রয়েছে। ওদিকে পি-িতে গোলটেবিল বৈঠক চলছে। কোন অগ্রগতির খবর এ পর্যন্ত পাচ্ছিনে। তবে শুভেচ্ছা ও প্রত্যাশার খবর পাচ্ছি। গভীরতর কোন লেখাপড়ার কাজ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় কাজ করাও বুঝি সম্ভব নয়। অন্তরের প্রার্থনা দিয়ে দেশের মঙ্গল কামনা করছি।” ১৪ মার্চ বাবা আবার লিখলেন: “গোলটেবিল বৈঠক সমাপ্ত। তবে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানতম দাবি ‘পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন’ মেনে নেওয়া হয়নি।” আমার মনে আছে বাবা ডিসেম্বরে এদেশ স্বাধীন হবে ভেবে প্রতিদিনই স্বাধীন দেশ কেমন হবে আমাদেরকে বলতেন, জানাতেন স্বাধীন দেশকে নিয়ে তাঁর চিন্তা-ভারনার কথা। স্বাধীনতার মর্মকথা বোঝার মতো বয়স তখন আমার নয়। তবে এটা বুঝতাম তিনি মনে প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালী ছিলেন। বড় হয়ে যখন তাঁর ডায়রি পড়েছি, তখন এটা আর স্পষ্ট হয়েছে। এখানে আমি ডায়রি থেকে তাঁর লেখা কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি, “এখন আমার দেশ আমার অশ্রুজলে আমার দেশ আমার অন্তরে নিরন্তর বিব্রত বিষয় আমার দেশ আজ বিক্ষুব্ধ সাগর বন্দর সব ভেসে গেছে জাহাজ হেথা ভেসে ভেসে ফেরে অথবা জাহাজ ডুবে গেছে ডুবুরিরা উধাও হয়েছে।” ইংরেজী সাহিত্যের শিক্ষক হয়েও আচার-আচরণে, চিন্তা ভাবনায়, বেশভুষায়, কথাবার্তায় পুরোপুরি তিনি একজন খাঁটি বাঙালী ছিলেন। বাংলা সাহিত্য ও সংগীত বাবার প্রিয় বিষয় ছিল। বাবার স্বপ্ন ছিল তাঁর মেয়ে বড় হয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হবে। বাবা সারাক্ষণ গুনগুন করে গান গাইতেন। একটু বড় হবার পর বুঝলাম এগুলো রবীন্দ্রনাথের গান। বাবা উপলদ্ধি করেছিলেন বাঙালী জাতিসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং বিশ্বের দরবারে বাঙালী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করতে রবীন্দ্রনাথ একটি বড় মাধ্যম। বাবাই ছিলেন আমার সঙ্গীতের প্রথম অনুপ্রেরণা। বাবার ইচ্ছা পূরণে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হয়েছি। আমাদের পরম সৌভাগ্য রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। আজ রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে আমাদেরকে কেউ নিষেধ করছে না, রবীন্দ্রনাথকে আমরা অন্তরে ধারণ করতে পারছি। স্বাধীনতার সুফল হিসেবে এটা আমাদের বড় অর্জন। দেশ স্বাধীন হলে আমরা বিশ্বের দরবারে বাঙালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব বলেই আমার বাবা বিশ্বাস করতেন। আমাদের দায়িত্ব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাঙালীর ঐতিহ্যকে লালন করবার প্রক্রিয়ায় আমাদের সোচ্চার হওয়া। আমার মনে হয় বাবা দেশাত্মবোধের তাগিদে মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যিনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন তিনি এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, “রাশীদুল হাসান নীড়ের সন্ধানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে এদেশে এসেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এবং শহীদ হন; নিরাশ্রয় হয়েই তিনি চলে গেলেন।” আমার বাবাকে ১৯৭১ সালে ২১ সেপ্টেম্বর হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। আমার মা পাগলের মতো প্রভাবশালী শিক্ষক ও সেই সময়ের উপাচার্যের কাছে ধরনা দেন এবং বাবাকে মুক্ত করার ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্য আবেদন এবং নিবেদন করেন। মা বুঝতে পেরেছিলেন এরা বাবার মুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী নন। আসলে এঁরাই বাবাকে হানাদারদের হাতে তুলে দিয়েছে। পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার পর এই সব শিক্ষকরাই দোর্দ- প্রতাপের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন এবং শহীদ পরিবারকে বাসা ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। আমার বাবা কয়েকদিন পর তাঁর এক বন্ধুর সহযোগিতায় মুক্তি পান। কিন্তু তিনি এদেশের বিশ্বাসঘাতক রাজাকারদের হাত থেকে রেহাই পাননি। আমরা প্রায়ই বলে থাকি দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ যে এ দেশে থাকা যাবে না। অনেকে দেশান্তরী হয়েছেন আবার অনেকে দেশান্তরিত হবার চিন্তা ভাবনা করছেন। কিন্তু বাবার লেখায় পাই তাঁর দেশের প্রতি কতটা আস্থা ও ভালোবাসা। ॥১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সাল॥ ডায়রিতে বাবা লিখলেন : “স্বদেশ ও স্বদেশ প্রতিভার উপর আস্থা হারানো পাপ। আমরা সে আস্থা হারিয়েছি। তাই এখনো বিদেশী ডিপ্লোমা ডিগ্রী এবং বিদেশের ভিক্ষালব্ধ তকমার উপর এত জোর দিই। কোন কিছু বিদেশের ছাপমারা হলেই আমরা অজ্ঞান হই। - এ আমাদের অজ্ঞতা, অজ্ঞানতা ।” আমরা ওপার বাংলায় চলে গেলে আমার বাবাকে হয়ত হারাতাম না। ওপারেই আমরা জন্মেছি এবং আত্মীয়স্বজন ও ভিটামাটি সবই আছে। কিন্তু আমার বাবা সাধারণ মানুষদের মতো ছিলেন না যে শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন ভাল মানুষ। দেশের মুক্তিযুদ্ধে যদি তিনি সামান্যতম অবদান রাখতে পারেন তাতেই তাঁর তৃপ্তি ছিল বেশি। বাবা সব সময় সত্যের পথে থেকেছেন, তাতে যদি নিজের ক্ষতিও হয় তাতে তিনি পিছপা হননি। এ প্রসঙ্গে বাবার লেখা একটি কবিতার কয়েকটি লাইন উল্লেখ করছি : “যা সত্য তা বেঁচে রবে আমি বাঁচি বা না বাঁচি সত্য যদি বেঁচে থাকে কি বা আসে যায় আমি আছি বা না আছি” একজন মহৎ মানুষের পক্ষেই এমন বলা সম্ভব। এসব মানুষরা তাঁদের আদর্শিক জীবন যাপন, দেশপ্রেম ও অন্যের জন্য মমত্ববোধের প্রকাশের মাধ্যমে আমাদের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এঁদের কথা আমরা বলে যাই। শহীদের সন্তান হিসেবে আমি স্বপ্ন দেখি নতুন প্রজন্ম একদিন মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ইতিহাস জানতে আগ্রহী হবে, তারাই দেবে শহীদদের যথাযথ সম্মান। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আধুনিক উদার মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নেবে।
×