সিকান্দার আবু জাফর
বাঙলা ছাড়ো
রক্ত চোখের আগুন মেখে ঝলসে যাওয়া
আমার বছরগুলো
আজকে যখন হাতের মুঠোয়
কণ্ঠনালীর খুনপিয়াসী ছুরি,
কাজ কি তবে আগলে রেখে বুকের কাছে
কেউটেসাপের ঝাঁপি।
আমার হাতেই নিলাম আমার
নির্ভরতার চাবি;
তুমি আমার আকাশ থেকে
সরাও তোমার ছায়া
তুমি বাঙলা ছাড়ো।
অনেক মাপের অনেক জুতোর দামে
তোমার হাতে দিয়েছি ফুল
হৃদয়-সুরভিত
সে-ফুল খুঁজে পায়নি তোমার
চিত্তরসের ছোঁয়া
পেয়েছে শুধু কঠিন জুতোর তলা।
আজকে যখন তাদের স্মৃতি
অসম্মানের বিষে
তিক্ত প্রাণে শ্বাপদ নখের জ্বালা,
কাজ কি চোখের প্রসন্নতায়
লুকিয়ে রেখে প্রেতের অট্টহাসি।
আমার কাঁধেই নিলাম তুলে
আমার যত বোঝা:
তুমি আমার বাতাস থেকে
মোছো তোমার ধুলো
তুমি বাঙলা ছাড়ো।
একাগ্রতার স্বপ্ন বিনিময়ে
মেঘ চেয়েছি ভিজিয়ে নিতে
যখন পোড়া মাটি
বারেবারেই তোমার খরা
আমার ক্ষেতে বসিয়ে গেছে ঘটি।
আমার প্রীতি তোমার প্রতারণা
যোগ-বিয়োগে মিলিয়ে নিলে
তোমার লোভের জটিল অংকগুলো,
আমার কেবল হাড় জুড়ালো,
হতাশ্বাসের ধুলো।
আজকে যখন খুঁড়তে গিয়ে
নিজের কবর খানা
আপন খুলির কোদাল দেখি
সর্বনাশা বজ্র দিয়ে গড়া,
কাজ কি দ্বিধার বিষণœতায়
বন্দী রেখে ঘৃণার অগ্নিগিরি?
আমার বুকেই ফিরিয়ে নেবো
ক্ষিপ্ত বাজের থাবা;
তুমি আমার জলেস্থলের
মাদুর থেকে নামো,
তুমি বাঙলা ছাড়ো।
মুজিবের গল্প লিখি
ফারুক মাহমুদ
কষ্টের গল্পটি বলি..., ভাষা জানা নেই
চিন্তার দু’পাড় ভেঙে হারিয়েছি খেই
সহমর্মী শব্দ আছে কোন অভিধানে
সুরের সামর্থ্য পাব বল কোন গানে
ভাষা ও সুরের শক্তি ব্যর্থ হল যদি
সেই গল্প কণ্ঠে নিল খাল বিল নদী
ঢেউ পরে ঢেউ ছোটে শোনে জলসুর
এসেছে বাতাস বেয়ে- ‘জয় মুজিবুর’
‘শেখ’ শব্দ আগে আছে শেষে ‘রহমান’
এই নামে গেয়ে ওঠে পাখিদের গান
অনন্ত নক্ষত্র আর চন্দ্র সূর্য তারা
নামের মহিমাগীতি গেয়ে যায় তারা
পুকুরের পদ্মহাসি শতদলদলে
মুজিবের গল্প লিখি বৃষ্টিধারাজলে
দিগন্ত নেমেছে মাঠে সবুজের কাছে
সরল সত্যটি হল- মুজিবুর আছে
ফাতেমা সিদ্দিকী ও জুলফিকার মতিন
দাউদ হায়দার
সিরাজগঞ্জের ফাতেমা সিদ্দিকী, বস্টনে নিজস্ব আস্তানায়
গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকে-যাওয়া সন্ধ্যায়
হারানো দিনের গল্প বলছিলেন। আমরা সমবেত
মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ছাত্রী কি পোশাকে যেত,
বোরখা, হিজাব ছিল না, পরনে পাবনার জোলার তাঁতের শাড়ি
কিংবা রাজশাহী সিল্ক, খোলা চুল, কপালে টিপ। শ্রেণীহীন নারী।
ছাত্রী তিনি বাংলা বিভাগের, অধ্যাপক জুলফিকার মতিন।
তাঁকে দেখিনি, না-দেখা অপরাধ কতটা বহুল, সতীন
যেমন ঝগড়া করে, বললেন, “প্রগতিচেতনার ধ্বজাধারীরা আজকাল
সমপরিমাণে নপুংসক, ছড়িয়ে আছে দিকচক্রবাল।”
গত বছর বস্টনে কবি বদিউজ্জামান নাসিমের আস্তানায়
বহুমান্য অতিথির আড্ডায়
প্রসঙ্গ উঠল জুলফিকার মতিন, ফাতেমা সিদ্দিকীর।
ফাতেমা এখন ওয়াশিংটনে। জুলফিকার মতিন মাটি আঁকড়ে রাজশাহীর।
২০ মার্চ ২০১৬
বার্লিন , জার্মানি
শামসুর রাহমান
গেরিলা
দেখতে কেমন তুমি? কী রকম পোশাক-আশাক
পরে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?
পেছনে দেখাতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?
টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং, ঢোলা
পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও
পাখির মতোই কিংবা চা-খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন?
দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে
কুলুজি তোমার আতিপাতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে
ঝানু গুপ্তচর সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন
করে খোঁজে প্রতিঘর। পারলে নীলিমা ছিড়ে বের করতো
তোমাকে ওরা, দিত ডুব গহন পাতালে।
তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া :
তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার।
আলাউদ্দিন আল আজাদ
ঘাতক ১৯৫
তিরিশ লাখ হত্যা
সাড়ে- তিন লাখ ধর্ষণ
পঞ্চাশ হাজার অগ্নিসংযোগ
এবং লুট
অগণিত
কিন্তু ঘাতক
মাত্র ১৯৫ জন :
শুভঙ্কর কোথায় জন্মেছিলো?
নিশ্চয়ই প্রাচ্যভূমি
যেখানে জীবনটা
আয়নার ওল্টাপিঠ;
এবং ইতিহাস দস্যুর উপাখ্যান।
ইতিহাসের চাকা
জাফর ওয়াজেদ
আপনার কথা ভাবলে আমাদেরও খুবই কষ্ট হয়
তবে গর্বের পাল্লাটাই ভারী আপনিই মুক্তির সোপান
বাঁচিয়েছিলেন দেশ যখন দুঃসহ জান্তাদের বরাভয়
পর্যুদস্ত জাতি, তখনই শোনালেন জাগরণের গান।
দৃপ্তকণ্ঠে সারা বাংলায় আপনিই তুলেছেন সাহস
রাস্তায় নেমেছিল ছাত্র যুবা কৃষক শ্রমিক মাতৃপ্রাণ
একে একে তারা লড়ে গেছে, ফেলেনি দীর্ঘশ্বাস
গদি উল্টে দিয়ে দেখালেন, কি ছিল পাকিস্তান।
জেগে ওঠার ডাক দিতেই কেঁপে উঠল সারাদেশ
সেই কাঁপনেই কারাগুলো ভেঙ্গেই হলো খান খান
বেরিয়ে এলেন মহান নেতা পরণে যার মুক্তবেশ
বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
সেই আপনাকেই যেতে হয় সীতার মতো অগ্নি পরীক্ষায়
যেন নাৎসী জার্মানির গ্যাস চেম্বারের মতো আদতমাখা
ক্ষমতার নেশার ঘোরে আপনাকেও দেখি উল্টাতে চায়
পার পাবে না কখনও, পায়নিও, ঘুরবেই ইতিহাসের চাকা।
হাসান হাফিজুর রহমান
তোমার আপন পতাকা
এবার মোছাব মুখ তোমার আপন পতাকায়।
হাজার বছরের বেদনা থেকে জন্ম নিল
রক্তিম সূর্যের অধিকারী যে শ্যামকান্ত ফুল
নিঃশঙ্ক হাওয়ায় আজ ওড়ে, দুঃখভোলানিয়া গান গায়।
মোছাব তোমার মুখ আজ সেই গাঢ় পতাকায়।
ক্রুরপদাতিক যতো যুগে যুগে
উদ্ধত পায়ের দাগ রেখে গেছে কোমল পলির ত্বকে,
বিভিন্ন মুখের কোটি অশ্বারোহী এসে
খুরে খুরে ক্ষতময় করে গেছে সহনীয়া মাটি,
লালসার লালামাখা ক্রোধে বন্দুক কামান কতো
অসুর গর্জনে চিরেছে আকাশ পরিপাটি
বিদীর্ণ বুকে নীল বর্ণ হয়ে গেছ তুমি, বাংলাভূমি
নত হয়ে গেছে মুখ ক্ষোভে ও লজ্জায়।
এবার মোছাব সেই মুখ শোকাক্রান্ত, তোমার আপন পতাকায়।
কে আসে সঙ্গে দেখ চেয়ে আজ
কারখানার রাজা, লাঙলের নাবিক,
উত্তাল ঢেউয়ের শাসক উদ্যত বৈঠা হাতে মাল্লা দল, এবং কামার কুমোর তাতী। এরাতো সবাই সেই
মেহনতের প্রভু, আনুগত্যে
শাণিত রক্তের ঢল হয়ে যায় বয়ে তোমার শিরাময় সারা পথে পথে।
দুহাতে সরায় দ্রুত শহরের জটিল পংকিল,
মধ্যবিত্ত অনড় আবিল। একে একে সকলকে নামায় মিছিলে।
ডাকে আপামর ভাইবোন। একসাথে মিলে নিñিদ্র
বিশাল শিলাদৃঢ় পাহাড় বানায়।
সেই কোটি হাত এক হয়ে
মোছাবে তোমার মুখ তোমার আপন পতাকার।
সমস্ত শূন্যতায় আজ বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে যায় আকাশ চাদোয়া জ্বলে রাহুমুক্ত ঘন নীলিমায়।
অকলুষ বাংলাভূমি হয়ে ওঠো রাতারাতি আদিগন্ত তীর্থভূমি।
অন্তহীন মিছিলের দেশ,
সারি সারি মানুষের আকারে হলে নূতিময়ী
সমস্ত স্বদেশ আজ রাঙা রাজপথে।
দিবালোক হয়ে ফোটে প্রাঞ্জল বিপ্লব
সাত কোটি মুখ হাসে মৃত্যুর রঙীন তীর হাতে নিয়ে।
শ্রেণীবদ্ধ এই ভিড়ে সকলেই সবার আগে
একবার শত্রুকে শেষ দেখা দেখে নিতে চায়।
দুঃসাহস চমকায় বরাভয় হিল্লোলিত তোমার আপন পতাকায়।
তুমি আছো কাজল দীঘির পাড়ে, কোকিলের মধুক্ষরা স্বরে,
হরিৎ স্বপ্নে ফুলে-ওঠা প্রান্তরের উর্বর আদরে
সিংহ প্রাণ গিরিবক্ষে এবং বঙ্গোপসাগর
নামক আকুল ঐ অস্থিরতার তুমুল গভীরে
আছো দিন-রাত্রি অগ্নিমুখ অশনির অশেষ অধীরে।
তুমি আছো আজো, ছিলে চিরকাল।
বিশ্বের সেরা সুন্দরী বলে লুটেছ প্রবাদের খ্যাতি
যদিও রতœখচা তোমার সৌন্দর্য সেই অবিরত তোমারই হয়েছে কাল।
তোমাকে মুঠোতে ভ’রে আনন্দের ঝুমঝুমি
বাজাতে এসেছে যারা
সুকালের ভোজসভার ক্ষুধার্ত অতিথি
রক্ত নিয়ে মুখে ধিক্কারে ধিক্কারে পলাতক তারা,
আবহমান বাংলার বর্বরতম দখলদারও দেখ আজ
কুৎসিততম আধারে নির্ঘাৎ হবে লীন।
তুমি ছিলে অমলিন, আজো আছো অমলিন।
শত কোটি লাঞ্ছনার তিক্ত দাগ সারা দেহে সয়ে
আজো তুমি মাতা, শূচিশুদ্ধ মাতা সাত কোটি সংশপ্তক
সন্তানের অকাতর তুমি মাতা।
প্রেম অবারিত হবে বিজয়ের ধারাজলে, রৌদ্রে জোছনায়।
শত শতাব্দীর অবগুণ্ঠিত আশা পূর্ণ করে
মোছাব তোমার মুখ তোমারই আপন পতাকায়।
প্রিয়তমা বাংলাদেশ
মারুফ রায়হান
আবার শিশুর মুখ ছুঁয়ে দেখলাম আবার নারীর মন
মাঝে পেরিয়েছি সন্দেহজনক এক অন্ধকার যুগ
মনের ভূখ- সে সময় খ- খ-, Ñআর
সেই চেনা রোমশ জন্তুটা ভয় দেখাচ্ছিলো মুহুর্মুহু
ফিরবে সে ফের, গ্রাস করে নেবে জনপদ, শিল্পের বসত
আবার শিশুর মুখ ছুঁয়ে দেখলাম আবার নারীর মন
মনে হলো ফাঁসের দড়ি ছিঁড়ে এইমাত্র
ফিরলাম জীবনের হৃৎপি-ে
বন্দুক নিশানা করছে না আর আমার মস্তক
ভুলে-যাওয়া প্রেমিকার মুখ আবার হাসছে স্বপ্নে
রাতশেষে তরতাজা নতুন একটি দিন বলছে স্বাগত
মনে হচ্ছে আঙুলের ডগা কেটে কলম বানাই
রক্তের অক্ষরে লিখি কেবল তোমার নাম
প্রিয়তমা বাংলাদেশ
মার্চের প্রতিকৃতি
রেজাউদ্দিন স্টালিন
গাছে গাছে তখন বৈশাখের পূর্বাভাস
পথের ধুলোয় বাতাসের ব্যস্ত চলাচল
মেঘ উল্টে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি
অক্ষরগুলো কালো আর ধূসর
লাইনগুলো দুমড়ে-মুচড়ে প্রতœসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ
বর্ণে বর্ণে অগ্নিক্ষরা ক্ষুধা ও খরার যন্ত্রণা
সব উচ্চারণে ঝড়ের আর্তস্বর
সব প্রত্যাবর্তনের পালে হাওয়া
সব পত্রালীর পত্রে মৃত্যুর খবর
ডাকঘরগুলো পোস্টমাস্টার শূন্য খা খা
কিন্তু রতন নির্ভয়, শিখে নিয়েছে বৃক্ষবদলের সূত্র
গাছে গাছে তখন রোদনশীল নিঃস্তব্ধতা
পূর্বাভাস বাড়িয়ে দিলো দীর্ঘ বল্লমজিহ্বা
রংধনুকে গেঁথে ফেলবে দিগন্তে
শ্বাপদ সময়ের শন্শন্ পেরিয়ে
রবীন্দ্রনাথের চুল একবার মেঘ হয়ে যাচ্ছে একবার ঝড়
এবং শ্মশ্রু বিক্ষুব্ধ মানচিত্র
শহীদুল্লা কায়সার
আজকের প্রশ্ন তা নয়
মরি কি বাঁচি
আজকের প্রশ্ন তা নয়।
জীবনের মুঠোয় পুরে
চাঁদের দেশে উধাও হব কি হব না।
পৃথিবীর সবুজে আকাশটা
ভরে দেব কি দেব না
আজকের প্রশ্ন তা নয়।
আজকের প্রশ্ন-
খুঁজে নেব মৃগনাভি
বিলিয়ে দেব সবার মাঝে।
যেন তেন এতটি নতুন জামা
আটা আধ সের
সেমাই এক পোয়া।
এক ছটাক বাদাম কিসমিস
নিম্নবিত্ত বাজেট যখন হিশশিম
তখন প্রশ্ন থাকে
এক ফোঁটা আতর।
কোন রকম একখানি গামছা
খুদ এক পোয়া
আধ ছটাক গুড়
গরীবের শিরনী
আর বড়জোর এক ছিলিম তামাক
সেখানেও প্রশ্ন থাকে
এক ফোঁটা আতর।
গেলবার ঈদে
আতরে রক্তে কী যে ছড়াছড়ি গেল
শহীদেরা একে একে আতর মেখে
সূর্যের উষ্ণীষে বিদ্রোহীর
পালক লাগিয়ে
নোঙ্গর ফেলল
উত্তমাশা অন্তরীপে।
তারপর ঈদের মেলায়
আতরের খোশবু ছড়িয়ে চলে গেল
মহাযাত্রায়।
সূর্যের উষ্ণীষ মাথায়
আজও তো আমরা হাজির
ঈদের মেলায়।
আজও সেই পুরাতন প্রশ্ন
কোথায় মৃগনাভি সুরভি।
শীর্ষ সংবাদ: