ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রশীদ হায়দার

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ২৬ মার্চ ২০১৬

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত  তাঁর ভূমিকা

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের জন্ম ত্রিপুরায়, ২ নবেম্বর ১৮৮৬ সালে। তাঁর পূর্বপুরুষ ত্রিপুরার বনজঙ্গল কাটতে কাটতে কুমিল্লায় চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ২. এ কথা নিঃসংশয় বলা যায়, ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দেশভাগের পর নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের প্রথম ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ কিংবা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে শহীদ হননি: নিখোঁজ হয়েছেন ১৯৭১ সালর ২৯ মার্চ। অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে শহীদ হন ১৪ এপ্রিল, ১৯৭১। পাকিস্তান সৃষ্টির দিন ও মাসের হিসাবে ঠিক ছয় মাস দশদিন পর করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পরিষদের ব্যবহার্য ভাষা কি হবে, সে সম্পর্কে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়Ñ ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। প্রাথমিক চিন্তা ছিল, গণপরিষদের ব্যবহার্য ভাষা হবে উর্দু ও ইংরেজী। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকেই পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত। অধিবেশনের শুরুতে আলোচনার সূত্রপাত করে পূর্ব বাংলার কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেন : গৎ. চৎবংরফবহঃ, ঝরৎ, ও সড়াব: “ঞযধঃ রহ ংঁন-ৎঁষব (১) ড়ভ ৎঁষব ২৯, ধভঃবৎ ঃযব ড়িৎষফ ‘ঊহমষরংয’ রহ ষরহব ২, ঃযব ড়িৎফং দড়ৎ ইবহমধষবব’ নব রহংবৎঃবফ.” আলোচনা বা বিতর্কের একটা পর্যায়ে আমরা দেখব পরিষদ-নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই প্রস্তাবটিকে নির্দোষ ভেবেছিলেন, কিন্তু শ্রী দত্তের সংশোধনী প্রস্তাবের পর তিনি এর মধ্যে এমন কিছু ষড়যন্ত্রের আভাস পেলেন, যা পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করবে, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। পাকিস্তানের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দৃঢ় আস্থার সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন ‘চধশরংঃধহ যধং পড়সব ঃড় ংঃধু’. কিন্তু ২৪ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার বাঙালী প্রমাণ করে ছাড়লেন দচধশরংংঃধহ যধং পড়সব ঃড় নব ফরারফবফ’. বলাবাহুল্য এই সিদ্ধান্তে আসার মূলে কার্যকর ছিল ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির পূর্বোক্ত গণপরিষদের ব্যবহার্য ভাষাবিষয়ক আলোচনার সূচনা। বলা চলে শুভসূচনা। যদিও আমরা দেখি ১৯৪৭-১৯৭১ সালের পাকিস্তানের ইতিহাসে কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় আমাদের বার বার ভাসতে হয়েছে রক্তগঙ্গায়। আর এই রক্তগঙ্গার অন্যতম শিকার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ৮৫ বছরের বৃদ্ধ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কী অমানবিক অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন, এক সাক্ষাৎকারে সেই বিবরণ দিয়েছেন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ক্ষৌরকার রমণীমোহন শীল। রমণীমোহন শীল হিন্দু হলেও তাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল পাকিস্তানী মিলিটারিদের প্রয়োজনেই, কারণ তার মৃত্যু হলে পাকিস্তানী সৈন্যদের চুল দাড়ি কাটার মতো কোন লোক থাকবে না। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওপর যে অমানবিক নির্যাতন হয়েছে তা দেখে কোন সুস্থ ও বিবেকবান মানুষের চোখের জল সংবরণ করা সম্ভব নয়। সাখাওয়াত আলী খান প্রদত্ত এক সাক্ষাতকারে জানা যায় : ‘ধীরেন বাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে রমণী শীলের চোখের জল বাঁধন মানেনি। মাফলারে চোখ মুছে তিনি বললেন, ‘আমার সে পাপের ক্ষমা নেই। বাবু স্কুলঘরের বারান্দায় অতি কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোথায় প্রস্রাব করবেন। আমি আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় তাকে প্রস্রাবের জায়গা দেখিয়ে দিই। তখন তিনি অতি কষ্টে আস্তে আস্তে হাতে একটি পা ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠানে নামেন। তখন ঐ বারান্দায় বসে আমি এক জল্লাদের দাড়ি কাটছিলাম। আমি বার বার বাবুর দিকে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিলাম বলে জল্লাদ উর্দুতে বলে, ‘এটা একটা দেখার জিনিস নয়Ñ নিজের কাজ কর।’ এরপর বাবুর দিকে আর তাকাবার সাহস পাইনি। মনে মনে শুধু ভেবেছি বাবু জনগণের নেতা ছিলেন, আর আজ তাঁর কপালে এই দুর্ভোগ। তাঁর ক্ষতবিক্ষত সমস্ত দেহে তুলা লাগান, মাথায় ব্যান্ডেজ, চোখ ও হাত বাঁধা অবস্থায় উপর্যুপরি কয়েকদিনই ব্রিগেড অফিসে আনতে নিতে দেখি।’ (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ : পৃষ্ঠা ৩০২) আজ আমরা নিঃসংশয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যে দুঃসাহসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন তা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তথা সামরিক জান্তা ভোলেনি, ভুলতে পারেনি। তাঁর অকুতোভয় ভূমিকাই যে পাকিস্তানকে দ্বিখ-িত করার বীজ বপন করেছিল তা পরবর্তীকালে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে, প্রমাণিত হয়েছে। মুহূর্তে সমগ্র পূর্ব বাংলায় এই বেদনাদায়ক ঘটনার খবর রাষ্ট্র হয়ে যায়; যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলাবাসীর অবদান ও সমর্থন সবচেয়ে বেশি, সেই পূর্ব বাংলার ভাষাভাষীদের প্রধান অচ্ছেদ্য বন্ধন ভাষাকে মর্যাদাহীন করার চক্রান্ত পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী তথা সামরিক জান্তাদের কেউ মেনে নিতে পারেনি। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে বাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, আমার পূর্বপুরুষ, আমি এবং উত্তর পুরুষ কেউই ভুলতে পারে না এবং অনিবার্যভাবেই এক্ষেত্রে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম আসবে সবার আগে। এটা ইতিহাসের রায়। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আর কী ভূমিকা পালন করেছিলেন? তিনি বলেছিলেন বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা হলেও সমগ্র পাকিস্তানের মোট ৬ কোটি ৯০ লাখ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী বাঙালী। অথচ ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকার যে ভূমিকা পালন করেছে তা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেনÑ পোস্ট অফিসের মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গেলে যে ফর্ম পূরণ করতে হয় সেটি মুদ্রিত উর্দু ভাষায়; খাম-পোস্টকার্ডের ওপরে ছাপানো ভাষা উর্দু; জমি বেচনাকেনার জন্য ভেন্ডারের কাছ থেকে যে স্ট্যাম্প কিনতে হয়, সেটাও উর্দু ভাষায়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এই সমস্ত উদাহরণের মধ্য দিয়ে একটা মহৎ সত্য উচ্চারিত হয়; আর সেটি হচ্ছে বাংলা হতে পারে পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা, অর্থাৎ উভয় প্রদেশের মধ্যে ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগের মাধ্যম। শহীদ দত্ত এ কথা জানাতে ভোলেন না যে আজ গণপরিষদে যে ভাষায় বিতর্ক চলছে তা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের বোধগম্য নয়। আবেগতাড়িত কণ্ঠে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলার সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপস্থাপন করেন; যেটি পরবর্তীকালে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষীর প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়। যেহেতু পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লাখের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লাখই বাঙালী সেজন্য তাঁর সঙ্গত প্রশ্ন : দঝরৎ, যিধঃ ংযড়ঁষফ নব ঃযব ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ঝঃধঃব? ঞযব ঝঃধঃব খধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ঝঃধঃব ংযড়ঁষফ নব ঃযব খধহমঁধমব যিরপয রং ঁংবফ নু ঃযব সধলড়ৎরঃু ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ঃযব ঝঃধঃব.’ ভাষা-সম্পর্কিত একটি নির্দোষ সংশোধন আলোচনা যে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পর্যবসিত হয়, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত-লিয়াকত আলী খানের তর্কযুদ্ধে। শহীদ দত্ত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানান, ‘ঝড়, ঝরৎ, ও শহড়ি ও ধস াড়রপরহম ঃযব ংবহঃরসবহঃং ড়ভ ঃযব াধংঃ সরষষরড়হং ড়ভ ড়ঁৎ ঝঃধঃব ধহফ ঃযবৎবভড়ৎব ইবহমধষবব ঝযড়ঁষফ হড়ঃ নব ঃৎবধঃবফ ধং ধ চৎড়ারহপরধষ খধহমঁধমব. ওঃ ংযড়ঁষফ নব ঃৎবধঃবফ ধং ঃযব ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ঝঃধঃব. সময় এবং সঠিক সময়ই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করে। শেষ বাক্য ওঃ ংযড়ঁষফ নব ঃৎবধঃবফ ধং ঃযব ষধহমঁধমব ড়ভ ঃযব ংঃধঃব-ই ঘোষণা দেয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। সেই দাবি তুঙ্গে ওঠে ঠিক চার বছর পর; ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে। ১৯৫৬ সালে কথাকথিত ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও কার্যক্ষেত্রে তা ছিল চরমভাবে অবহেলিত; দেখেছি আরবী হরফে বাংলা লেখা, রোমান হরফে বাংলা, সোজা বাংলার নামে সওজা বাংলা, বাংলা ভাষার মধ্যে দুর্বোধ্য আরবী-ফার্সী -উর্দু ভাষার আমদানি ঘটানো হয়েছে অবাধে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। এবারে আমরা লিয়াকত আলী খানের প্রতিক্রিয়ার দিকে মনোযোগী হতে পারি। লিয়াকত আলী খানের বক্তব্য ছিল সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ; তিনি বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন পাকিস্তান যেহেতু একটি মুসলিম রাষ্ট্র, সেজন্য ভাষার ক্ষেত্রেও ধর্মীয় চারিত্র রক্ষা করার জন্য উর্দুর প্রাধান্য থাকা প্রয়োজন। যেহেতু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুই অংশেই মুসলমানদের সংখ্যা বেশি, সেজন্য রাষ্ট্রভাষার ক্ষেত্রে উর্দুর প্রাধান্য আবশ্যিক; যদিও তিনি প্রাদেশিক ভাষা হিসেবে প্রদেশের সব মানুষের কথ্য, লিখিত ও ব্যবহৃত ভাষা বাংলা ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি আপত্তি তোলেননি; কিন্তু মূল আলোচনা অর্থাৎ বাংলার রাষ্ট্রীয় অধিকার শুধু অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ভারতীয় চর, কমুনিস্ট, বিচ্ছিন্নতাবাদী ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, কোন বাঙালী মুসলিম লীগ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে সমর্থন জানাননি, বাংলার পক্ষে বক্তব্য রাখেননি। এমনকি সংসদের স্পীকার বাঙালী তমিজউদ্দিন খানও শেষে রায় দিয়েছেন : ঝরৎ, ও পধহহধড়ঃ ধপপবঢ়ঃ ঃযরং ধসবহফসবহঃ.’ ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষা-বিতর্কে শেষ বাক্যটি হচ্ছে ‘ঞযব গড়ঃরড়হ ধিং হবমধঃরাব.’ কিন্তু সেই হবমধঃরাব-ই কতখানি ঢ়ড়ংরঃরাব হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ আমরা পেলাম কয়েকদিন পরেই। করাচীতে গণপরিষদের অধিবেশন শেষে পূর্ব বাংলার সদস্যরা ঢাকা ফিরলেন। তেজগাঁ বিমানবন্দর। তেমন কোন নিরাপত্তা বা প্রহরা নেই; পূর্ববঙ্গের সংসদ সদস্যরা বিমান থেকে নেমে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ধীরেন্দ্রনাথ লক্ষ্য করলেন মূল গেটের কাছে কিছু যুবক চাদর গায়ে দাঁড়িয়ে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশটি এখানে উদ্ধৃত করা অপরিহার্য মনে করছি। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১‘-এর তৃতীয় খ-ের প্রথম রচনাটিই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনি আরমা দত্তের। ধীরেন দত্তকে উদ্ধৃত করে লিখছেন আরমা: ‘প্রথম গণপরিষদ অধিবেশন শেষে করাচী থেকে ফিরলাম। অনুন্নত তেজগাঁ বিমানবন্দরে সিকিউরিটি বলতে কিছুই নেই। প্লেন থেকে নেমে দেখলাম, প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশজন যুবক এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাদের প্রত্যেকের গায়ে চাদর। আমার ধারণা হলো, গণপরিষদে বাংলার সপক্ষে কথা বলার দরুন এরা বিক্ষোভ জানাতে এসেছে, এদের চাদরের আড়ালে অস্ত্রও থাকতে পারে। সংশয় নিয়ে এগিয়ে গেলাম। যখন ওদের একেবারে নাগালের মধ্যে চলে গেছি তখন হঠাৎ প্রত্যেকে চাদরের তলা থেকে রাশি রাশি ফুল বের করে আমার ওপর বর্ষণ করতে লাগল। ওরা সবাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’ সেই সূচনা। এর পরই ১১ মার্চ ১৯৪৮, পূর্ব বাংলায় ‘ভাষা দিবস’ পালিত হলো; এবং ওই মার্চেই ২১ তারিখে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে, বর্তমানে যেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেখানে প্রথম ঘোষণা করলেন টৎফঁ, ধহফ টৎফঁ ধষড়হব ংযধষষ নব ঃযব ংঃধঃব ষধহমঁধমব ড়ভ চধশরংঃধহ; ২৪ মার্চ তারিখে সেই একই ঘোষণা তিনি পুনরাবৃত্তি করলেন কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে; এবং ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে রেসকোর্স ময়দানে জিন্নার উক্তিতে ছাত্রদের যে নো’, ‘নো’ প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিল, তা কার্জন হলে দ্বিগুণ ধ্বনিতে উচ্চারিত হলে থমকে গিয়েছিলেন জিন্না, স্তম্ভিত হয়েছিলেন তিনি। বলাবাহুল্য, ছাত্রদের এই সাহসের গোড়াপত্তনটি করেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাজনৈতিক পরিচয়ের পাশাপাশি ব্যক্তি-পরিচয়ও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেগুলো নিঃসন্দেহে আদর্শ অনুপ্রেরণা যুব সমাজের জন্য রাজনীতিবিদদের জন্যে দেশবাসীর জন্য। শহীদ দত্তের পূর্ব পুরুষের ইতিহাস থেকে জানা যায় তাঁরা ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যের অধিবাসী। তিনি কেন কুমিল্লা চলে এলেন তার বিবরণীতে অর্থনৈতিক ও সমাজতত্ত্বের যেমন একটি চমকপ্রদ ইতিহাস আছে, তেমনি আছে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা। মানুষের জন্য রাজনীতি করতে গেলে ওই দৃঢ়তার প্রয়োজন যে সর্বাগ্রে, সেই চরম সত্য আজ প্রায় নির্বাসিত। বলছেন শহীদ ধীরেন দত্ত: ত্রিপুরা রাজ্য এক সময় জঙ্গল ছিল, চাষাবাদের উপযোগী ছিল না। এই এলাকায় কিছু কাঠুরিয়া কাঠ কেটে জীবন ধারণ করত। এসব এলাকায় তখন হাতিও ছিল। তখনকার একটা নিয়ম ছিল যে, ত্রিপুরার রাজাকে যে যত হাতি ধরে দিতে পারবেÑ সে ত্রিপুরা স্টেট থেকে তত জমি পাবে এবং মন্ত্রিপরিষদে পদও পাবে। এতে জঙ্গল পরিষ্কার হতে থাকল, স্টেটের চাষোপযোগী জমিও বাড়তে থাকল। যার যত ভাল পদ রাজা তাকে তত বেশি জমির মালিকানা দিতে থাকল। পত্তনদার থেকে জমিদারি। দাদু এরপরে সামাজিক স্তর বিন্যাস, সাম্রাজ্যবাদ, যুদ্ধনীতির ব্যাখ্যা তো দিলেনই তার সঙ্গে এই এলাকার ভৌগোলিক ও তৎকালীন সমাজের নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও দিলেন। (যদিও আমার দাদু নৃতত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব কিছুই পড়েননি) শেষে বললেন, ‘আমি ধীরেন দত্তÑ এই প্রথাকে ঘৃণা করি এবং এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে জমিদার প্রথা থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম ৮ সন্তান, ৩ বোন, বৃদ্ধ পিতা-মাতার হাত ধরে।’ আমার দাদুদের পূর্বপুরুষ এমনিভাবেই জমিদার হয়েছিলেন এবং ত্রিপুরা রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন। দাদু সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলাম। দাদু আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, জমিদার বংশের কথা কাউকে বলবে নাÑ খুব কলঙ্কময় ও লজ্জাকর অধ্যায়Ñ আমাদের পূর্বপুরুষ কাঠুরিয়া-আমরা মানুষ, এই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয়Ñ আমরা খেটে খাওয়া মানুষÑ তুমি মানুষ হতে চেষ্টা কর এটাই হবে তোমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।’ ‘মানুষ’ হওয়ার প্রধানতম শর্ত কি? আমরা ধীরেন দত্তের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, দেশপ্রেমের পরীক্ষায় তিনি শর্তহীনভাবে উজ্জ্বলতম সফলতা লাভ করেছেন, কারণ দেশভাগের পর তাঁরই অনেক আপনজন ভারতে চলে গেছেন, বন্ধুরা দেশত্যাগী হয়েছেন। কিন্তু তিনি যাননি, গেলে নিঃসন্দেহে একটা সম্মানজনক অবস্থান তিনি লাভ করতেন, বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতেন, আইনজীবী হিসেবে সুনাম অর্জন করতেন, মন্ত্রিত্বও লাভ করতেন। কিন্তু দেশের মাটির সঙ্গে বিশ্বাস ভঙ্গের কাজ তিনি করেননি। না করার ফলে তাঁকে প্রায়ই জেলে যেতে হয়েছে, রাজবন্দী হিসেবে থাকতে হয়েছে, গৃহবন্দী ও থেকেছেন একাধিকবার। তবু তিনি দেশ ছাড়েননি। কুমিল্লা থেকে ত্রিপুরা কতদূর? গোমতী নদী পার হয়ে কিছুদূর গেলেই ত্রিপুরা সীমান্ত, আর সেখানে পৌঁছলেই নিরাপদ। কিন্তু আমরা আরমা দত্তের লেখা থেকে জেনেছি, ধীরেন দত্ত মাতৃভূমি ছাড়েননি, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, তাঁর রক্তের ওপর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়বে, চেয়েছিলেন তিনি নিজ হাতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করবেন। আশ্চর্য দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন শহীদ ধীরেন দত্ত। এদেশ যে তাঁরই জীবদ্দশায় স্বাধীন হবে, সে-ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। এই বিশ্বাস পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। মানুষটিকে চিনবার জন্যে আমাদের অনেক পথ, পথের বাঁক অতিক্রম করলে তবেই চেনা যাবে, অসাম্প্রদায়িক চেতনায় তিনি কিভাবে দেশটা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম নয়; ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে মানুষ-মানুষে ভালবাসা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে বিবাহ হলে শান্তি বিরাজ করবে। নারী জাতিকে তিনি দিয়েছেন সর্বোচ্চ সম্মান গৃহস্থালি কাজের মেয়েদের তিনি ‘মা’ ছাড়া সম্বোধন করতেন না। তিনি নির্দেশ দিয়েই বলতেন গরিবের সমস্যা ও দুঃখ বুঝতে চেষ্টা করবে, নইলে মানুষ হতে পারবে না। রবীন্দ্রনাথের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন মানুষকে অবিশ্বাস করা মহাপাপ; মানুষকে অবিশ্বাস করলে, বঞ্চিত করলে আমরা হয়তো মারা যাব না, কিন্তু ওরা মারা যাবে। বাড়িতে মেয়ে-বউদের কুড়ি টাকার বেশি দামের শাড়ি পরা ছিল বারণ, সাধারণ মানুষের কাছে ওই মূল্যের শাড়িই মহামূল্যবান। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সবচেয়ে বড় অপছন্দ ও ঘৃণার বিষয় ছিলÑ ধর্ম ব্যবসা। ধর্ম ব্যবসায়ীদের তিনি বাড়ির ত্রিসীমানায় ঢুকতে দিতেন না। ধর্ম ব্যবসা করে ধর্মকে সমুন্নত রাখা যায় এ কথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। পারিবারিক অবস্থানও মানুষকে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবে, এই প্রথাও তাঁর কাছে ছিল ঘোর আপত্তিকর। একটি উদাহরণে তাঁর আপত্তির স্বরূপটি উপলব্ধি করা যাবে। বিষয়টি হচ্ছেÑ তাঁর নাতনি আরমা দত্ত শিশুকালে নূরজাহান নামে এক ধুনকরের মেয়ের সঙ্গে খেলা করত। ওই পাড়ারই এক উকিল আরমাকে শাসন করে বলেছিলেন তুমি হচ্ছো জমিদার বংশের মেয়ে, তোমার ওই ধুনকরের মেয়ের সঙ্গে খেলা করা উচিত নয়, অশোভন। বংশ মর্যাদার কথাও বলেছিলেন সেই উকিল। আর তারই প্রতিক্রিয়ায় ধীরেন্দ্রনাথ সগর্বে নাতনি আরমাকে বলেছিলেন, তারা মূলত কাঠুরিয়া, জঙ্গল সাফ করতে এসেছেন। অর্থাৎ মানুষ এবং মানুষের মর্যাদাই প্রধান ছিল বলে আরমা ও নূরজাহানে কোন পার্থক্য তাঁর নিকট ছিল না। ৩. ১৯৫৬ সালে ৮ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রে চৌধুরী মুহম্মদ আলী মন্ত্রিসভার পতন হলে ১২ সেপ্টেম্বর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিম-লী গঠন করেন। অপরদিকে প্রদেশে আবু হোসেন সরকার মন্ত্রিসভার পতন হলে ‘আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল না থাকার দরুন কোয়ালিশন মন্ত্রিম-লী গঠনে বাধ্য হয়। এই মন্ত্রিম-লীকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস, স্বতন্ত্র, তফসিল হিন্দু আর আমাদের দল গণসমিতির ৬ জন সদস্য সমর্থন করেন। তাঁহাদের সমর্থনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।’ (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা। পৃ. ১২)। আওয়ামী লীগের আইন সভার নেতা আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়, সেখানে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তও অন্তর্ভুক্ত হন। শ্রী দত্ত পেয়েছিলেন মেডিক্যাল, পাবলিক হেলথ ও সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের দায়িত্ব। মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করার আগে গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকটি তাঁর মনে আসে। মনে মনে তিনবার তিনি শ্লোকটি উচ্চারণ করে শপথ বাক্য পাঠ করেন। তিনি সংকল্প করেছিলেন ফলের আকাক্সক্ষা না করে কর্তব্য করে যেতে হবে। তাঁর সংকল্পে নিঃশব্দ উচ্চারণ ছিল : ‘আমি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করিলাম। বস্তুত যে কোন দেশের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করা, বিশেষ করিয়া অনুন্নত দেশের, সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করা ছাড়া আর কিছুই নহে।’ (শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা পৃঃ ১১৩)। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমরা চরম আত্মত্যাগী সংগ্রামীকে যথাযোগ্য সম্মান দিইনি, তাঁকে মর্যাদা দিইনি, ইতিহাসে যথোপযুক্ত স্থান দিইনি: পক্ষান্তরে যে মানুষটির দুঃসাহসিক ভূমিকার জন্যে আজ আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলছি, সরকারী কাজে বাংলা ব্যবহার করছি, তাঁর নামটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কোথাও, কোন জায়গায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে, ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে আমরা আশাবাদী থেকে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথার ‘সম্পাদকের নিবেদন’ থেকে উদ্বৃতি দিয়েই আমার বক্তব্য শেষ করব। ওই আত্মকথার সম্পাদক ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কথায় : ‘স্রোতকে যেমন আলাদা করা যায় না নদী থেকে, তেমনি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের (১৮৮৬-১৯৭১ নাম পৃথক করা যায় না বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে। সেই ইতিহাসের আগের যে ইতিহাস, সেই পর্বের ও এক শক্তিমান চরিত্র তিনি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভারতে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সংগ্রামের সৈনিক, পাকিস্তান রাষ্ট্রে, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রবর্তক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্বাপ্নিক। এর প্রতিটি পর্যায়ে নিজের বিশ্বাস ও কর্মের জন্য মূল্য দিয়েছেন তিনি সর্বাধিক মূল্য দিয়েছেন ১৯৭১ এর মার্চে। তখন তিনি নিজের হাতে কুমিল্লার বাড়িতে তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। তার কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁর রক্তে সিঞ্চিত হয়েছিল বাংলাদেশের মাটি। তাঁর আর সকল কাজের মতো সে আত্মদানও বৃথা হয়নি। যে মাটিতে বোনা হয়েছিল স্বাধীনতার বীজ, সে মাটি উর্বর হয়েছিল তাঁর রক্তেÑ ফসল ফলতে দেরি হয়নি।’
×