ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাহানারা ইমাম

একাত্তরের দিনগুলো

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ২৬ মার্চ ২০১৬

একাত্তরের দিনগুলো

২৩ মার্চের উজ্জ্বল প্রতিরোধ দিবসের পর কি যেন এক কালোছায়া সবাইকে ঘিরে ধরেছে। চারদিক থেকে খালি নৈরাশ্যজনক খবর শোনা যাচ্ছে। ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টোর বৈঠক যেন সমাধানের কোন কূলকিনারা পাচ্ছে না। শেখ মুজিব প্রতিদিন প্রেসিডেন্ট ভবনে যাচ্ছেন আলোচনা করতে, বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলছেন আলোচনা এগোচ্ছে; ওদিকে আন্দোলনকারী জঙ্গী জনতাকে বলছেন দাবি আদায়ের জন্য আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যান। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন। বেশকিছু দিন থেকে মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে প্রতিদিন নাকি প্লেনে করে সাদাপোশাকে প্রচুর সৈন্য এসে নামছে বিমানবন্দরে। বিশ্বাস হতে চায় না কথাটা, তবু বুক কেঁপে ওঠে। ওদিকে চট্টগ্রাম থেকে দু’তিনজন বন্ধুর টেলিফোনে জানা গেছেÑ চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবোঝাই জাহাজ এসে ভিড়েছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। সে অস্ত্র চট্টগ্রামের বীর বাঙালীরা খালাস করতে দেবে না বলে মরণপণ করে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে। ওদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য আর্মি ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওদের ওপর। রুমীর মুখে দু’দিনের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। মাথার চুল খামছে ধরে রুমী বলল, ‘আম্মা বুঝতে পারছ না মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা ওদের সময় নেয়ার অজুহাত মাত্র। ওরা আমাদের স্বাধীনতা দেবে না। স্বাধীনতা আমাদের ছিনিয়ে নিতে হবে সশস্ত্র সংগ্রাম করে।’ আমি শিউরে উঠলাম, ‘বলিস কিরে? পাকিস্তান আর্মির আছে যুদ্ধের লেটেস্ট মডেলের সব অস্ত্রশস্ত্র। তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করবি কি দিয়ে?’ রুমী উত্তেজিত গলায় বলল, ‘একজ্যাক্্ট্লিÑ সেই প্রশ্ন আমারও। সাদা গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে শেখ রোজ প্রেসিডেন্ট হাউসে যাচ্ছেন আর আসছেন, আলোচনার কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। ওদিকে প্লেনে করে রোজ সাদা পোশাকে হাজার হাজার সৈন্য এসে নামছে, চট্টগ্রামে অস্ত্রভর্তি জাহাজ ভিড়ছে। আর এদিকে ঢাকার রাস্তায় লাঠি হাতে বীর বাঙালীরা ধেই ধেই করে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়ে হৃষ্টচিত্তে বাড়ি ফিরে পেটপুরে মাছ-ভাত খেয়ে ঘুম দিচ্ছে। পল্টন ময়দানে ডামি বন্দুক ঘাড়ে কুচকাওয়াজ করছে। আমরা কি এখনও রূপকথার জগতে বাস করছি নাকি? ছেলেমানুষিরও একটা সীমা থাকা দরকার।’ ‘তাহলে এখন উপায়?’ ‘উপায় বোধহয় আর নেই আম্মা।’ ভয় আর আতঙ্কের একটা হিমবাতাস আমাকে অবশ করে দেয় যেন, ‘না, না, ওরকম করে বলিস না। তুই শেখের রাজনীতি সমর্থন করিস না, তাই এ কথা বলছিস। তোরা হলি জঙ্গী বাঙালী, খালি মার-মার, কাট-কাট। শেখ ঠিক পথেই আন্দোলনকে চালাচ্ছেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হলেও এভাবে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে জনগণ তাদের দাবি ঠিকই আদায় করে নেবে?’ ‘আম্মা, তুমি কোন আহাম্মকের স্বর্গে বসে আছ? শুধু কয়েকটা বিষয় তলিয়ে দেখÑ পূর্ব পাকিস্তানে বর্তমানে যা যা ঘটছে, সবই পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে। স্বাভাবিক হিসেবে এগুলো সবই বিষম রাষ্ট্রদ্রোহিতা। দেশের সর্বময় কর্তা প্রেসিডেন্ট খোদ হাজির, অথচ দেশ চলছে শেখের কথায়। লোকে অফিস-আদালত-ব্যাংক সব চালাচ্ছে শেখের সময়ে। তারপর দেখ পাকিস্তান সরকারের হেনস্তা। টিক্কা খানকে কোন বিচারপতি শপথ গ্রহণ করাতে রাজি হলো না বলে বেচারা গবর্নর হতে পারল না। শুধু মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটার হয়ে কাজ চালাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ঢাকায় এসে নামল আর তার বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ। সেনাবাহিনীর জন্য কোন বাঙালী খাবার জিনিস বেচছে না। ওরা কতদিন ডাল-রুটি খেয়ে থেকেছে। তারপর প্লেনে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে খাবার আনতে হয়েছে। এতসব কা-ের পরও ইয়াহিয়া সরকার একদম মুখ বুজে চুপ করে আছে। কেন বুঝতে পারছ না? ওরা শুধু সময় নিচ্ছে। ওরা আলোচনার নাম করে আমাদের ভুলিয়ে রাখছে। শেখ বড্ডো দেরি করে ফেলছেন। এপথে, এভাবে আমরা বাঁচতে পারব না।’ আমি রাগ করে বললাম, ‘দাড়ি কামিয়ে সাবান মেখে ঠা-া পানিতে ভাল করে গোসল কর দেখি বাপুÑ মাথা বড্ড বেশি গরম হয়ে গেছে।’ রুমী নীরবে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। আমি কেমন যেন চুপসে গেলাম। নিজের মনেও যেন আর জোর পাচ্ছি না। আজ আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পী-দম্পতি আতিক ও বুলুর বাসায় রাতের খাবার দাওয়াত আছে। এরকম অবস্থায় দাওয়াত খেতে যেতে ইচ্ছে করে না, আবার ঘরে বসে থাকলেও ফাঁপর লাগে। শরীফের মিটিং ছিল ঢাকা ক্লাবে। অতএব আমি একাই গেলাম আতিকের বাসায়। সেখানে দেখা হলো এনায়েতুল্লাহ খান ও তার স্ত্রী লীনার সঙ্গে, লীনার ছোট ভাই জিল্লুর রহমান খান ও তার আমেরিকান বউ মার্গারেটের সঙ্গে। আরও এসেছে আতিকের বন্ধু হালিম ও তার স্ত্রী মণি, আতিকের ভায়রা ভাই ফাত্তাহ ও তার স্ত্রী। সকলের মুখে একই কথাÑ কি হবে? কি হবে? প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নাকি কাউকে না জানিয়ে লুকিয়ে প্লেনে চড়ে পশ্চিম পাকিস্তান চলে গেছে? রাস্তায় নাকি ইতোমধ্যেই আর্মি নেমে গেছে? আমি বুঝতে পারছি না, আর্মি কেন নামবে। সাড়ে নয়টার সময় মাসুমা ফিরল টিভি অফিস থেকে। কিছুদিন আগে বড়ভাই রফিকুল ইসলামের বাসা ছেড়ে এখন মেজভাই আতিকুল ইসলামের বাসায় থাকছে। সে এলো ঝড়েপড়া পাখির মতো বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে। সবার মধ্যে যে আশঙ্কা, তার মধ্যেও তাই। বরং টিভি স্টেশনে সে আমাদের চেয়ে বেশি কিছু শুনেছে। কিন্তু মাসুমা আমাদের সঙ্গে বসল না; বলল, ‘খুব বেশি টায়ার্ড আমি, নিজের ঘরে যাই।’ অনেক বলা সত্ত্বেও সে খেল না আমাদের সঙ্গে। আমাদেরও খিদে ছিল না। কোনমতে খাওয়া সারলাম সবাই। সাড়ে দশটায় শরীফ ফোন করল, ‘এখনও দেরি করছ কেন? শহরের অবস্থা ভাল নয়। বহু জায়গায় জনতা নতুন করে ব্যারিকেড দিচ্ছে। ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে চলে গেছে। অনেক রাস্তায় আর্মির গাড়ি দেখা যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এস।’ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ভীষণ শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চমকে উঠে বসলাম। রুমী-জামী ছুটে এলো এ ঘরে। কি ব্যাপার? দু’তিন রকমের শব্দÑ ভারি বোমার বুমবুম আওয়াজ, মেশিনগানের ঠাঠাঠাঠা আওয়াজ, চিঁ-ই-ই-ই করে আরেকটা শব্দ। আকাশে কি যেন জ্বলে-জ্বলে উঠছে, তার আলোয় ঘরের ভেতর পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠছে। সবাই ছুটলাম ছাদে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে মাঠ পেরিয়ে ইকবাল হল, মোহসীন হল, আরও কয়েকটা হল, ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টার্সের কয়েকটা বিল্ডিং। বেশিরভাগ আওয়াজ সেদিক থেকে আসছে, সেই সঙ্গে বহু কণ্ঠের আর্তনাদ, চিৎকার। বেশিক্ষণ ছাদে দাঁড়ানো গেল না। আগুনের ফুলকির মতো কি যেন চিঁ-ই-ই-ই শব্দের সঙ্গে এদিক পানে উড়ে আসছে। রুমী হঠাৎ লাফ দিয়ে কালো আর স্বাধীন বাংলা পতাকা দুটো নামিয়ে ফেলল। হঠাৎ মনে পড়ল একতলায় বারেক, কাসেম ওরা আছে। হুড়হুড় করে সবাই নিচে নেমে গেলাম। রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে উঠানের দিকের দরজাটা খুলতেই আমাদের এ্যালসেসিয়ান কুকুর মিকি তীর বেগে ঘরে ঢুকে আমাদের সবার পায়ে লুটোপুটি খেতে খেতে করুণ স্বরে আর্তনাদ করতে লাগল। উঠানের দিকে মুখ বাড়িয়ে ডাকলাম, ‘বারেকÑকাসেম।’ ওদের ঘরের দরজা খুলে বারেক, কাসেম কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। আমি বললাম, ‘তোমরা তোমাদের বিছানা নিয়ে এ ঘরে চলে এস।’ মিকিকে কিছুতেই আর ঘর থেকে উঠানে নামানো গেল না। এত গোলাগুলির শব্দ ও ট্রেসার হাউইয়ের নানা রঙের আলোর ঝলকানিতে সে দিশেহারা হয়ে গেছে। রুমী তার ঘাড়ে-মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ‘ভয় নেই, মিকি ভয় নেই। তুই আমাদের সঙ্গে উপরে থাকবি।’ তাকে উপরেও নেয়া গেল না। কি এক মরণ ভয়ে ভীত হয়ে সে খালি কোণা খুঁজছে। শেষে সিঁড়ির নিচের ঘুপচি কোণটাতে কু-লী পাকিয়ে শুয়ে রইল। বসার ঘরে ফোন তুলে দেখি, ফোন ডেড। উপরে উঠে গেলাম। বাবার গলা শুনলাম। রুমী গিয়ে বাবার হাত ধরে মৃদু স্বরে তাকে কি কি যেন বলতে লাগল। বাকি রাত আর ঘুম এলো না। আবার ছাদে গেলাম। দূরে দূরে আগুনের আভা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দিক থেকে গোলাগুলি, মেশিনগানের শব্দ আসছে, ট্রেসার হাউই আকাশে রংবাজি করে চলেছেÑ দূর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। উত্তরে, দক্ষিণে, পূর্বে, পশ্চিমে সবদিকেই দূরে আগুনের স্তম্ভ ক্রমেই স্পষ্ট ও আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। কারও মুখে কোন কথা নেই। রুমী, জামী নীরবে থমথমে মুখে সুতলির বাঁধন খুলে প্লাস্টিক ব্যাগ একে একে উপুড় করল কমোডে। একটু করে ফ্ল্যাশ করে, খানিক অপেক্ষা করে, আবার ঢালে, আবার ফ্ল্যাশ করে। এক সঙ্গে সব মালমশলা, ঢাললে কমোডের নল বন্ধ হয়ে যাবে। জামী বাসনমাজা পাউডার দিয়ে তিন চারবার করে হামানদিস্তা দুটো মাজল আর ধুল। একবার ধুয়ে শুঁকে দেখে, আবার মাজে, আবার ধোয়। এ কাজ সেরে রুমী মার্কস, এঙ্গেলসের বই, মাও-সে-তুংয়ের মিলিটারি রচনাবলী সব একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরল। আমরা চিন্তা করতে লাগলাম কোথায় বইগুলো লুকোনো যায়। মাটিতে পুঁততে চাইলে, বইগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। শেষে মনে পড়ল বারেকদের ঘরের পেছনে বাউন্ডারি ওয়ালের এক জায়গায় একটা কোটর মতো আছে। প্রতিবেশী হেশাম সাহেবের বাউন্ডারি ওয়ালের দরুন এই কোটরটার সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বইয়ের প্যাকেটটা ফেলে দিলে লুকোনোও থাকবে, নষ্টও হবে না। ভোরের আলো অল্প একটু ফুটতেই রুমী সাবধানে গুড়ি মেরে ওখানে গিয়ে বইয়ের প্যাকেটটা রেখে দিল। তার ওপর ফেলল কয়েকটা শুকনো নারকেলের পাতা। ছ’টার দিকে হঠাৎ কানে এলো খুব কাঁপা কাঁপা অস্পষ্ট গলার ডাকÑ ‘আপা, আপা’। চমকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি বাগানের একটা জবাগাছের নিচে কুঁকড়ি মেরে বসে আছেন কামাল আতাউর রহমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অনার্স পরীক্ষার্থী, মোহসীন হলে থাকে। ছুটে নিচে নেমে গেলাম। দরজা খুলে উদ্্ভ্রান্ত, প্রায় অচেতন কামালকে ধরে তুলে ঘরে নিয়ে এলো রুমী-জামী। ও সারারাত হলের একতলার একটা বাথরুমে আরও দশ-বারোটা ছেলের সঙ্গে লুকিয়ে ছিল। ট্রেসার, হাউইয়ের দরুন রাতে বেরোতে সাহস পায়নি। এখন সকালের আলো ফুটতে ট্রেসার হাউই বন্ধ হয়েছে। ওরা বাথরুম থেকে বেরিয়ে মাঠ, খানা-খোন্দল, রেললাইন পুরো এলাকাটা চার হাত-পায়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে পালিয়ে এসেছে। কামালকে সুস্থ করে রেডিও খুললাম। সুরা বাকারার পর খালি একটা বাজনাই বারেবারে বাজছেÑ আমার প্রিয় একটা গান ‘কোকিল ডাকা, পলাশ-ঢাকা আমার এ দেশ ভাইরে’Ñ এই গানের সুরে তৈরি যন্ত্রসঙ্গীত। সাতটার সময় পাশের ডাঃ এ কে খানের বাড়ি গেলাম ফোন করতে। ওদের ফোনও ডেড। ক্রমে ক্রমে আমাদের রাস্তার আরও সব বাড়ির লোকজন সাবধানে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। সবারই মুখে আতঙ্ক। সবাই সারারাত জেগেছে। কেউ কিছু বুঝতে পারছি নাÑ কি হচ্ছে। সব বাড়ির ফোনই ডেড। বাড়ি চলে এসে খাবার টেবিলে বসে রইলাম, রেডিও সামনে নিয়ে। জামীকে বললাম, ‘বারেককে সঙ্গে নিয়ে দাদাকে ওঠাও, মুখ ধোয়াও, নাশতা খাওয়াও।’ কাসেম যন্ত্রচালিতের মতো টেবিলে চা-নাশতা দিয়ে গেল। নাশতা ফেলে সবাই চায়ের কাপ টেনে নিলাম। সাড়ে ন’টার সময় হঠাৎ যন্ত্রসঙ্গীত বন্ধ হলো। শোনা গেল একটা রুক্ষ অবাঙালী কণ্ঠস্বর। প্রথমে উর্দু এবং পরে ইংরেজিতে বলল। পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত কারফিউ বলবত থাকবে। কারফিউ ভঙ্গ করে কেউ বাইরে বেরোলে কি শাস্তি, তাও বলল। আর বলল, ‘মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। তার নিয়ম-কানুনগুলো এক এক করে বলে যেতে লাগল। বেতার-ঘোষকের উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি শুনে মনে হলো লোকটা একটা সেপাই-টেপাই কিছু হবে। সামরিক সরকার আর কাউকে হাতের কাছে না পেয়ে ওকে দিয়ে ঘোষণাগুলো করাচ্ছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ, যা তা-ব হচ্ছে চারদিকে, কারফিউ না দিলেও বাইরে বের হয় কার সাধ্যি! গোলাগুলির শব্দ থামেই না। মাঝে মাঝে কমে শুধু। আগুনের স্তম্ভ দেখার জন্য এখন আর ছাদে উঠতে হয় না। দোতলার জানালা দিয়েই বেশ দেখা যায়। কালো ধোঁয়ায় রৌদ্রকরোজ্জ্বল নীল আকাশের অনেকখানিই আচ্ছন্ন। মিকির কান্নায় অস্থির হয়ে উঠেছিল সবাই। ওর এ্যালসেসিয়ান চরিত্রই বদলে গেছে যেন। অবিশ্রান্ত গোলাগুলির শব্দে এই জাতের সাহসী কুকুর যে এরকম কাহিল ও উদ্্ভ্রান্ত হয়ে পড়বে, তা কে ভেবেছিল? ওকে কিছু খাওয়ানো যাচ্ছে না। আমরা সবাই পালা করে ওকে কাছে টেনে ওর গলা জড়িয়ে ধরে সুস্থির রাখার চেষ্টা করছি, কিন্তু কোন ফল হচ্ছে না। বাবাকে নিয়েও হয়েছে মুশকিল। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কেন, কি দোষে নিজের দেশের লোকজনকে মারছে, তা ওকে বোঝাতে গিয়ে আমাদের সবার মুখ দিয়ে ফেনা উঠে গেল। আমার ভয় হচ্ছে ওর আবার ব্লাড প্রেসার না বেড়ে যায়। টেলিফোন বিকল, রেডিও পঙ্গু, বাইরে কারফিউ-গোলাগুলির শব্দের চোটে প্রাণ অস্থির, বাইরে কি হচ্ছে কিছুই জানবার উপায় নেই। এক্ষেত্রে আমাদের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী স্কুপ সংবাদদাতা কামাল আতাউর রহমান। সকাল থেকে আমার বারবার প্রশ্নে একই কথা বলতে বলতে কামালও যেন হাঁপিয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। ‘আচ্ছা কামাল, রাত বারোটার সময় তুমি কি করছিলে?’ ‘আমি? আমি একটা প্রবন্ধ লিখছিলামÑ ‘বাংলা সাহিত্যে দেশপ্রেম।’ ২৭ তারিখে রেডিও প্রোগ্রামে পড়বার জন্য। ‘কখন গোলাগুলির শব্দ শুনলে?’ ‘ঐ বারোটার দিকেই। হয়তো দু’চার মিনিট পরে। আমার এক বন্ধু এসে বলল ‘তুই এখনো হলে রয়েছিস? জানিস না শহরের অবস্থা ভয়ানক খারাপ? আর্মি আসছে ক্যাম্পাস এ্যাটাক করতে? আমি বাড়ি চললাম। তুইও বেরিয়ে যা।’ কিন্তু আমরা কেউই আর বেরোবার চান্স পেলাম না। তখুনিই কানে এলো ভয়ানক গোলাগুলির শব্দ। একটু পরেই চারদিক আলো হয়ে উঠতে লাগল। একবার করে আলো জ্বলে আর গুলিগোলা ছোটে। আমার ঘর ছিল পাঁচতলায়, তাড়াতাড়ি একতলায় নেমে এলাম। হাজী মোহসীন হলের দক্ষিণে ইকবাল হলÑ তার ওপাশে এসএম হল। মনে হল ভারি ভারি কামানের গোলা দিয়ে মিলিটারিরা ইকবাল হল উড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের হলের দিকে গুলি ছুটে আসছিল।’ ‘তোমাদের হল আক্রমণ করেনি?’ ‘না, আমরা প্রতিমুহূর্তে ভয় করছিলাম, এই বুঝি হাজী মোহসীনেও এলো। কিন্তু ওরা আসেনি।’ ‘আর কোথায় কোথায় ওরা এ্যাটাক করেছে বলে মনে হয়?’ ‘ঠিক বলতে পারবো না। মনে হয় এসএম হল, জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার। ঐদিক থেকেই শব্দ বেশি পাওয়া গেছে।’ ‘তোমার কি মনে হয়? ইকবাল হল, এসএম হল সব একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে? সব ছেলেদের মেরে ফেলেছে?’ ‘কি করে বলব? আমরা তো একতলার বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। শব্দ শুনে মনে হয়েছে ভারি ভারি গোলা। মোহসীন হলের মাথার ওপর দিয়েও গুলি ছুটে আসছিল। জানালার কাচ ভাঙার শব্দ পেয়েছি সারারাতই।’ একপর্যায়ে কামাল বাথরুমে গেলে রুমী আমাকে বলল, ‘ওকে আর জিগ্যেস কর না তো আম্মা। দেখছ না ওর কষ্ট হচ্ছে।’ ‘তাতো দেখছি। কিন্তু কি যে হচ্ছে চারদিকে, তাই বুঝবার জন্যÑ’ ‘বুঝবার আর কি আছে আম্মা? যা ঘটবার কথা ছিল, তাই তো ঘটেছে।’ চুপ করে রুমীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। রুমী চোখ ফিরিয়ে নিল। কাল রাত থেকে ও বিশেষ কথাবার্তা বলছে না। থম ধরে আছে। আমি ভাবছিÑ রুমীর কথাই ঠিক হলো। রুমী নিশ্চয় ভাবছে, কেমন জব্দ আম্মা? আহাম্মকের স্বর্গ থেকে ছিটকে পড়েছ তো। কাঁহাতক ঘরে বসে থাকা যায়। এক সময় উঠে সদর দরজা খুলে গাড়ি-বারান্দায় গেলাম। আমাদের বাসার সামনের এই গলিটা কানা। এলিফ্যান্ট রোড থেকে নেমে এসে আমাদের বাসা পেরিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। ওই বন্ধ জায়গাটার ওপরে ডাঃ এ কে খানের বাড়ি। বন্ধ গলি হওয়ার মস্ত সুবিধেÑ এখানে বাইরের লোকের চলাচল বা ভিড় নেই। এ রাস্তার বাড়িগুলোর বাসিন্দারাÑআমরাÑঅনেক সময় গলির ওপর দাঁড়িয়ে গল্প করি। গলিটা যেন আমাদের সকলের এজমালি উঠান। ১৯৫৯ সালে এখানে বাড়ি করে উঠে আসার পর থেকে এদেশে যতবার কারফিউ পড়েছে, আমরা বাড়ির সামনের এই গলিতে দাঁড়িয়ে বহু সময় গল্পগুজব করে কাটিয়েছি। আজ কিন্তু গাড়ি-বারান্দা পেরিয়ে গলিতে পা রাখতে সাহস হলো না। গোলাগুলির শব্দে এখনও আকাশ ফাটছে। মাঝে মাঝে কুকুরের চিৎকার কানে ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন মানুষেরও চিৎকার। খুব অস্পষ্ট। নাকি আমার ভুল? এত বিরামহীন গোলাগুলির পরও কোন মানুষ কি বেঁচে আছে চিৎকার দেয়ার জন্য? আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা কাক, চিল কি কোন পাখির ডাক নেই। বাউন্ডারি ওয়ালের এপাশে শরীর রেখে শুধু মুখটা বাড়ালাম গেটের বাইরে, বাঁদিকে তাকালাম মেইন রোডের পানে। জনশূন্য রাস্তা। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে হয়তো সৈন্যভর্তি জীপ বা ট্রাক চলে যেতে দেখব। কিন্তু দরকার নেই তা আমাদের দেখে। আমার মুখোমুখি বাসাটা হোসেন সাহেবের। উনি খোলা দরজার ঠিক ভেতরেই চেয়ারে একবার বসছেন, আবার উঠে বারান্দায় আসছেন, আবার তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে যাচ্ছেন। বাঁ পাশে ডাঃ রশীদের বাড়ি। উনিও অস্থিরভাবে ঘর-বারান্দা করছেনÑ এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। ফিরে, ঘুরে ঢোকার মুখে গাড়ির দিকে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলাম। কাচজুড়ে জ্বলজ্বল করছে সেই স্টিকারÑ ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালীর জীবন।’ দ্রুত ঘরে ঢুকে রুমীকে ডাকলাম, ‘রুমী, রুমী, শিগগির গাড়ির স্টিকার উঠিয়ে ফেল।’ ঠিক সন্ধ্যার মুখে কারেন্ট চলে গেল। বাঃ বেশ। এবার ষোলোকলা পূর্ণ হলো। গোলাগুলির শব্দ একটু কমেছে মনে হলো। মিকিও যেন একটু ধাতস্থ হয়েছে। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের এক পাশের ঢাকা জায়গায় তার নিজস্ব জলচৌকিটায় গিয়ে বসেছে। সামান্য কিছু খেয়েছেও। আমি চার-পাঁচটা মোমবাতি বের করে একতলা দোতলায় তিন-চার জায়গায় বসিয়ে দিলাম। আজ সারাদিন বারেক, কাসেম আমাদের চারপাশেই ঘোরাঘুরি করেছে। সন্ধ্যের সময় বারেক-কাসেমকে বললাম, ‘তোরা এখুনি তোদের বিছানাপত্র এনে গেস্টরুমে রাখ। অন্ধকারে উঠোনে বেরিয়ে কাজ নেই।’ ওরা কৃতজ্ঞমুখে দৌড়োদৌড়ি করে বিছানাপত্র এনে রেখে আমাদের কাছাকাছি মাটিতে এসে বসল। মনে হলো আমরা সবাই নূহের নৌকায় বসে আছি। বাড়িতে একটা ভাল রেডিও নেই। এবার ২০ ফেব্রুয়ারির শেষ রাতে আমরা বাড়িসুদ্ধ সবাই বাইরে ছিলামÑ সেই ফাঁকে বাসায় চোর ঢুকে অনেক জিনিসের সঙ্গে আমাদের ভাল রেডিওটাও নিয়ে যায়। এতদিন কিটির দামী রেডিওটাই ব্যবহার করতাম, ও গুলশানে চলে যাওয়াতে রুমী-জামীর নড়বড়ে টু-ইন-ওয়ানটা দিয়ে কোনমতে কাজ চালাই। কিন্তু এটাতে বিবিসি’র বাংলা সার্ভিসটা ধরা যায় না। আকাশবাণীও ঢাকার রাস্তায় আর্মি নেমেছেÑ এর বেশি কিছু বলেনি। টিভি বন্ধ। কি আর করি। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে কাজের লোকদের রেহাই দিলাম। সবাই সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছি, হঠাৎ রুমী থমকে দাঁড়াল, ‘মিকির কোন সাড়াশব্দ নেই যে? একেবারে নর্মাল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।’ জামী বলল, ‘ওকে ভেতর আনা হয়নি।’ আবার আমরা সবাই নিচে নামলাম। দরজা খুলে উঠানে নেমে মিকির জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মোমবাতির কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখলাম মিকি মরে পড়ে আছে।
×