ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাতক্ষীরায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা

কয়েক শ’ সংখ্যালঘু পরিবার বাড়ি ফিরতে পারেনি

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৭ মার্চ ২০১৬

কয়েক শ’ সংখ্যালঘু পরিবার বাড়ি ফিরতে পারেনি

স্টাফ রিপোর্টার, সাতক্ষীরা ॥ নির্বাচন পূর্ববর্তী বিরোধ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় রূপ নেয়ায় সাতক্ষীরার আশাশুনি ও তালা উপজেলায় সংখ্যালঘু কয়েকশ’ পরিবার গত তিন দিনেও বাড়ি ফিরতে পারেনি। আওয়ামী লীগের উপজেলা নেতারা তাদের পছন্দের নৌকার বিপক্ষের বিদ্রোহীদের পক্ষ নেয়ায় নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে সংখ্যালঘুরা হামলা ও হুমকির শিকার হয়ে এখন বাড়ি ছাড়া। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে এ সব নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি তাদের পক্ষে আবস্থান নেয়া এবং পরাজিত প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকদের সন্ত্রাসে মদদ দেয়ার অভিযোগে তালা উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার ও আশাশুনি উপজেলা চেয়ারম্যান এবিএম মোস্তাকিমের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দলের হাই কমান্ডের কাছে দাবি জানানো হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার অভিযোগে তালা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমারের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়েছে পরাজিত চেয়ারম্যানদের পক্ষ থেকে। তবে সংখ্যালঘুদের হুমকি, নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে আশাশুনি উপজেলা চেয়ারম্যান এবিএম মোস্তাকিম শনিবার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন। আশাশুনিতে কোন সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি এবং তাদের হুমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেনি। আশাশুনিতে নির্বাচন পরবর্তী জয়-পরাজয়কে কেন্দ্র করে একটি মহল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ করে তিনি নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে ফিরিয়ে আসার আহ্বান জানান। পাশাপাশি এ ব্যাপারে পুলিশের সহায়তা কামনা করা হয়। নতুন কোন ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। এদিকে তালা উপজেলা চেয়ারম্যান ঘোষ সনৎ কুমার শনিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, খলিলনগর ইউপি চেযারম্যান প্রণবঘোষ বাবলু নৌকা প্রতীক নিয়ে ফেল করার পর তার বিরুদ্ধে বিএনপি ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করার মিথ্যা অভিযোগ তুলে প্রচার করছে। তিনি কোন বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি বলে দাবি করেন। তবে আওয়ামী লীগ নেতারা সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও এলাকার বাস্তব চিত্র ভিন্ন। শনিবার আশাশুনির খাজরা, প্রতাপনগর ও আশাশুনি সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে নৌকা প্রতীকের প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী বাহিনীর হুমকির মুখে বাড়ি ও গ্রাম ছাড়া পরিবারগুলো এখনও বাড়ি ফিরতে পারেনি। অধিকাংশ বাড়ি পুরুষশূন্য। প্রতাপনগর ইউনিয়নের কমপক্ষে ৫০টি সংখ্যালঘু পরিবার নির্বাচনের পরদিন থেকে গ্রাম ছাড়া। খাজরা ইউনিয়নের শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবার ৩দিন ধরে গ্রামে নেই। অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে অন্যস্থানে। কোথায় গেছে এমন তথ্য জানা নেই পরিবারের নারী সদস্যদের কাছে। আশাশুনি সদরের ৪টি গ্রামের প্রায় দেড়শতাধিক পরিবার গত তিনদিন ধরে গ্রামে ফেরেনি। এসব পরিবারের সদস্যরা শুক্রবার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে এসে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে স্ত্রী, কন্যা, ও স্বামীদের জীবনের নিরাপত্তা দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এদিকে তালা উপজেলায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এখনো আতঙ্ক বিরাজ করছে। উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের ওয়ার্কার্স পার্টির পরাজিত প্রার্থী হিরন্ময় ম-ল জানান, ভোটে তিনি পরাজিত হওয়ার পর নির্বাচিত প্রার্থী গণেশ দেবনাথের লোকজন একটি কালীপূজার অনুষ্ঠানে তাকেসহ পাঁচজনকে পিটিয়ে জখম করে। বৃহস্পতিবার সকালে মাগুরা বাজারে মাদরা গ্রামের ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালক ওয়ার্কার্স পার্টির কর্মী গৌর ম-লকে পিটিয়ে জখম করে। মোবাইল কেড়ে নিয়ে ভেঙে দেওয়া হয় তার মোটরসাইকেলটি। একইভাবে ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা মাগুরা গ্রামের অলোক বোসের বাড়ি ভাংচুর করে। তার অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ শীলা বসু ও ছেলে অমিত বসুকে পিটিয়ে জখম করে। এ সময় একটি খাসি ছাগল তারা পিটিয়ে হত্যা করে। পরে তারা নিমাই ম-লকে মারপিট করে তার বাড়ি ভাংচুর করে। পরে কিরণ ম-লের স্ত্রীকে মারপিট করে। এরপর তারা উজ্জ্বল রায়ের স্ত্রীকে মারপিট করে ভাংচুর করে তাদের বাড়ি। হিরন্ময় ম-লের অভিযোগ, হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ কর্মী বিশ্বনাথ বিশ্বাস, বাবু মিত্র, হান্নান গাজী, বিপ্লব দাস, দেবাশীস সরকার, মিহির দে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে সাতক্ষীরায় নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা, হুমকি ও তাদের নিরাপত্তাহীনতার জন্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃত্বের কোন্দল দায়ী। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান, নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিজয়ী করার চেষ্টার পর এখন আক্রোশের শিকার হচ্ছেন এলাকার সংখ্যালঘু ভোটার ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। ফলে নৌকায় ভোট দেয়ার পরও এ সকল সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা এখন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হুমকির মুখে বাড়ি ও গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। সমস্যা সমাধানে জরুরী ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ জরুরী বলে মনে করছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
×