ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রিট খারিজ

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৯ মার্চ ২০১৬

রিট খারিজ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে এর বিরুদ্ধে করা রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতি নাঈমা হায়দারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ সোমবার শুনানি শেষে আবেদনটি খারিজ করে দেন। তিন সদস্যের এই বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল। ২৮ বছর আগে ১৫ বিশিষ্টজনের করা একটি রিট আবেদনের ২৩ বছর পর রুলটি জারি করা হয়। আর রুল জারির প্রায় ৫ বছর পরে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রুল শুনানির দিন ধার্য হয় ২৭ মার্চ। সংবিধানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বদলে দেয়া হচ্ছে, গেল কয়েক দিন সকল আলোচনাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল বিষয়টি। প্রচারণার এমন বাহার তাতে অনেকের মনে হয়েছে বিষয়টি একেবারে নতুন। অনেকেই মনে করেছেন সরকার বুঝি সংবিধান বদলে ইসলামের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করছে। কিন্তু সোমবার রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট আবেদনটি খারিজ করে দিয়েছে উচ্চ আদালত। হেফাজতে ইসলাম তো কয়েক দিন আগেভাগে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে। এমনকি সোমবার শুনানির আগেও তারা প্রধান বিচারপতির কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। চট্টগ্রাম, সিলেট এমনকি ঢাকাও বিশাল মিছিলে মিছিলে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। আর জামায়াতে ইসলামী হরতাল ডেকে বোঝাতে চাইল তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে রক্ষা করতে প্রাণ দেবে এবার। যদিও সোমবার যে হরতাল ছিল নিতান্ত রবিবার রাতে যারা টিভি স্ক্রলে চোখ রেখেছেন আর গেল দিন সকালে উঠে পত্রিকা পড়েছেন তারা ছাড়া কেউ জানেন না। সম্প্রতি জামায়াতের সব থেকে দুর্বল হরতাল হয়েছে সোমবার। দেশের কোথাও কোন পিকেটিং মিছিল করা আগে থেকে ছেড়ে দিয়েছে জামায়াত। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক কাজ করত সোমবারের হরতালে তাও উবে গেছে বলে মনে হয়েছে। হরতালের দিন স্বাভাবিক রাজধানীর যানজট মানুষকে ভুগিয়েছে নিত্যক্ষণ। সাধারণ মানুষ বলছে এর আগে হরতাল দিতে জামায়াত আদালতের আদেশের অপেক্ষা করত। আদালত তাদের প্রত্যাশিত রায় না দিলে হরতাল দিয়ে রায় চ্যালেঞ্জ করত। আদালতে গিয়ে আদালতের রায় পরিবর্তনের বৈধ পন্থার সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে না মেনে বহুবার হিংসাত্মক জামায়াতের রূপও দেখা গেছে। তবে এবার রায় তো দূরের কথা শুনানির জন্য অপেক্ষাও করেনি। আকস্মিকভাবে রবিবার দুপুরে হরতাল আহ্বান করল। প্রচারণায় দীর্ঘ ২৮ বছর আগের ইস্যুটিকে একেবারে নতুন করে সকলের সামনে আনা হলো। মনে হলো ৯০ ভাগ মুসলিম ধর্মের মানুষের দেশে উস্কানি দেয়ার নতুন চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ খুব একটা এই প্রচারণায় সাড়া দেয়নি। সোমবার আবেদনটি খারিজ হওয়ার পর অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বহাল থাকার পাশাপাশি অন্য ধর্মের অধিকারও বহাল থাকল। এটা সংবিধানেও রয়েছে। সোমবার শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষে অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা আদালতকে উদ্দেশ করে বলেন, এটা অনেক আগের মামলা। দু’টি রুল হয়েছে। অনেক পুরনো ম্যাটার। ১৯৮৮ সালের রিট। পরে দু’টি সম্পূরক আবেদনের রুল। এ জন্য আমাদের কিছু সময়ের প্রয়োজন। এ সময় আদালত বলেন, ঠিক আছে, আপনি বসেন। আগে আমরা আবেদনকারীর আইনজীবীকে শুনব। এরপর সুপ্রীমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিচারপতি টিএইচ খান, এবিএম নুরুল ইসলামসহ কয়েক আইনজীবী রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বহালের পক্ষে পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদন নিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু আদালত বলেন, আপনারা এখন বসেন। এখনও শুনানিই শুরু হয়নি। আগে রিট আবেদনের আইনজীবীকে শুনব। পরে পক্ষভুক্ত হওয়ার বিষয়। এ সময় আদালত আবেদনকারীদের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরীকে বলেন, আপনাকে আমরা দেখে আসতে বলেছিলাম ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে এ রিটটি দায়েরের লোকাস স্ট্যান্ডি (রিট করার এখতিয়ার) ছিল কি? জবাবে সুব্রত চৌধুরী বলেন, সংগঠন ছাড়াও আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকে রিটে বাদী হয়েছেন। আদালত বলেন, আমরা দেখছি, ওই সংগঠনটির পক্ষে রিট আবেদন করা হয়েছে। তখন সুব্রত চৌধুরী বলেন, শুনানির সময় আমরা বিস্তারিত বলব। সন্তোষজনক জবাব দেব। আদালত বলেন, ওই সংগঠনের লোকাস স্ট্যান্ডি নাই। রিট খারিজ, রুল ডিসচার্জ। পরে আদালত থেকে বের হয়ে সুব্রত চৌধুরী বলেন, আমরা পূর্ণাঙ্গ রায় দেখব, কেন খারিজ হয়েছে। এরপর আপীল করব। মুরাদ রেজা বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম বহাল থাকার পাশাপাশি অন্য ধর্মের অধিকারও বহাল থাকল। এটা সংবিধানেও রয়েছে। রিট মামলটি করা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্তির বিধান করার পর। স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে রিটকারী ১৫ বিশিষ্টজনের মধ্যে অনেকে ইতোমধ্যে মারা গেছেন। ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে জাতীয় সংসদে অষ্টম সংশোধনী অনুমোদন হয়। একই বছরের ৯ জুন এতে অনুমোদন দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ। এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২(ক) যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ এ বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৮৮ সালে ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’র পক্ষে রিটটি (নম্বর ১৪৩৪/১৯৮৮) দায়ের করেন বরেণ্য ১৫ জন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, সাবেক বিচারপতি কেএম সোবহান, অধ্যাপক খান সরওয়ার মুর্শিদ, আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, মেজর জেনারেল (অব) সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এ রিট দায়েরের দীর্ঘ ২৩ বছর পর ২০১১ সালের ৮ জুন একটি সম্পূরক আবেদন করা হয়। ওইদিনই বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। পাশাপাশি শুনানির জন্য এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তারা হলেনÑ টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ড. এম জহির, মাহমুদুল ইসলাম, এএফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আখতার ইমাম, ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল মতিন খসরু, ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, এএফএম মেসবাহ উদ্দিন। তাদের মধ্যে ড. এম জহির ও মাহমুদুল ইসলাম ইন্তেকাল করেছেন। এ রুল জারির কিছুদিন পর একই বছরের ২৫ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়। এতে ২ অনুচ্ছেদ আবারও সংশোধন করা হয়। সংশোধনীতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খীস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে।’ এ সংশোধনীর পর আবারও সম্পূরক আবেদন করা হয়। এ আবেদনের পর ২০১১ সালের ১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ সম্পূরক রুল জারি করেন। এরপর এ রুলের ওপর হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানির জন্য গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর আবেদন করেন রিট আবেদনকারীপক্ষ। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন প্রধান বিচারপতি।
×