ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বর্ণাঢ্য সাজ ॥ সাতরাস্তা-হলিফ্যামিলি হাসপাতাল অংশ আজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

অবশেষে মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের দ্বার খুলছে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৩০ মার্চ ২০১৬

অবশেষে মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের দ্বার খুলছে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ অবশেষে দ্বার খুলছে মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের। উড়াল সড়কের একাংশ গাড়ি চলাচলের জন্য আজ খুলে দেয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের পরই শুরু হবে সব ধরনের পরিবহন চলাচল। প্রায় নয় কিলোমিটার ফ্লাইওভারের মধ্যে সাতরাস্তা-মগবাজারের হলিফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়ক খুলে দেয়ার কথা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে। বাকিটা ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময় নেয়া হয়েছে। যদিও সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আশাবাদ চলতি বছরের শেষ দিকেই পুরো কাজ শেষ হবে। সব মিলিয়ে তিন ধাপে চালু হবে পুরো প্রকল্পটি। পুরো প্রকল্পের ৭০ ভাগের মতো কাজ শেষ হয়েছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক নাজমুল আলম বলেন, তিন ধাপে পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে। সাতরাস্তা থেকে হলিফ্যামিলি অংশ বুধবার খুলে দেয়ার পর বাংলামোটর থেকে মৌচাক অংশ জুনে খুলে দেয়া হবে। বাকিটা ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে খুলে দেয়া হতে পারে। তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন পর্যন্ত হলেও এর আগেই সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। রাজধানীর এফডিসি, মগবাজার, মৌচাক, শান্তিনগর, মালিবাগ সড়ক ও মগবাজার রেলক্রসিংয়ে যানবাহনের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে যানজট নিরসনে এ ফ্লাইওভার প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। তিনি বলেন, কাজ শেষ হওয়ায় প্রথম ধাপের অংশটি যানবাহন চলাচলে উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। এতে যানজট কিছুটা হলেও কমবে। বিশেষ করে কাকরাইল থেকে যারা হলিফ্যামিলির রাস্তা ব্যবহার করে সাতরাস্তার দিকে যাবেন তাদের এখন থেকে আর যানজটের দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। এমনিতে এই সড়কটি ভিআইপি হওয়ায় সব সময় গাড়ির চাপ থাকে। প্রচুর গাড়ি চলায় দীর্ঘ সময় সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এতে দুর্ভোগ বাড়ে। এখন থেকে তা আর হবে না। তেমনি মহাখালী থেকে যারা প্রেসক্লাব কিংবা কাকরাইলের দিকে যেতে চান তাদের জন্যও এই রাস্তাটি ব্যাপক উপকারে আসবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রকল্পের নির্মাণ কাজের জন্য এখন মগবাজার থেকে মৌচাকের দিকের একাংশের রাস্তাটি দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এই রুটে চলা যানবাহনগুলো বুধবার উদ্বোধনের পর সাতরাস্তা-হলিফ্যামিলি পর্যন্ত সড়কটি ব্যবহার করতে পারবে। চলাচলের পথ ॥ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিউ ইস্কাটন সড়কের ‘আমু ভাইয়ের গলি’-এর সামনে থেকে গাড়ি ফ্লাইওভারে উঠলে শান্তিনগর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের তিন নম্বর গেটের সামনে গিয়ে নামতে পারবে। এছাড়া নিউ ইস্কাটনের সমাজসেবা কার্যালয়ের সামনের রাস্তা দিয়ে যে কোন গাড়ি রামপুরা সড়কের আবুল হোটেল পর্যন্ত গিয়ে নামতে পারবে। সাতরাস্তা থেকে শান্তিনগর-রাজারবাগ ও আবুল হোটেল পর্যন্ত গাড়ি যেতে পারবে। শান্তিনগর ও রাজারবাগ থেকে সরাসরি সাতরাস্তা পর্যন্ত গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সোনারগাঁও হোটেলের সামনে থেকে যে কোন গাড়ি মৌচাক-শান্তিনগর এমনকি রামপুরা রোডে চলাচল করতে পারবে। তবে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর ট্রাফিক ব্যবস্থার বিষয়টি মাথায় রেখে গাড়ি নামা ওঠার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করা হবে। যা আগামী বছরের মধ্যেই। প্রস্তুতি শেষ ॥ প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী ফ্লাইওভার দিয়ে সাতরাস্তা থেকে হলিফ্যামিলিতে নামবেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, ফ্লাইওভারের ঢালাই শেষ করা হয়েছে কয়েকদিন আগেই। ল্যাম্প পোস্টের জন্য বৈদ্যুতিক তার টানা হয়েছে। গার্ডারের কাজও শেষ হয়েছে। ফিনিশিং শেষে নির্মাণ শ্রমিকরা রং দেয়াও সম্পন্ন করেছেন। ফ্লাইওভারের ওপরে টানানো হয়েছে নানা রংয়ের পতাকা। রঙিন কাপড় দিয়ে সাজানো হয়েছে বিভিন্ন অংশ। পথচারী ও অযান্ত্রিক পরিবহন উড়াল সড়ক ব্যবহার করতে পারবে না এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সাদা সাইনবোর্ডে বৃত্তের মধ্যে পথচারী ও অযান্ত্রিক যানবাহনের ছবি দিয়ে লাল রংয়ে ক্রস চিহ্ন দেয়া রয়েছে। সাদা রং দিয়ে লেন চিহ্নিত করা হয়েছে। দু’পাশে আঁকা হয়েছে বর্ডার। রয়েছে ওঠা ও নামার নির্দেশনাও। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি টানানো হয়েছে উড়াল সড়কের বিভিন্ন অংশে। ককসিটে নানা রংয়ে লেখা হয়েছে ‘শুভ উদ্বোধন’। নিচে সড়ক দ্বীপে লাগানো হয়েছে নানা জাতের ঘাস। কোথাও কোথাও গাছ লাগানোর কথাও জানালেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। নিচের অংশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজও শেষ হওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। প্রস্তুতি দেখে সাধারণ মানুষও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, দীর্ঘ সময় পরে হলেও আশার আলো জ্বলেছে। সেই সঙ্গে চলমান জনদুর্ভোগ থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তিরও কথা বলছেন তারা। প্রকল্পের একাংশের উদ্বোধন প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা থেকে হলিফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত দুই কিমি. অংশ ৩০ মার্চ যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এছাড়া ফ্লাইওভারের বাংলামোটর থেকে রাজারবাগ পর্যন্ত এবং রামপুরা আবুল হোটেল থেকে শান্তিনগর পর্যন্ত অংশ চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ শেষে হবে। তিন ধাপে চালু হবে পুরো উড়াল সড়ক ॥ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তিনটি ধাপের মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা থেকে হলিফ্যামিলি পর্যন্ত অংশটি মূল অংশ হিসেবে ধরা হয়। দ্বিতীয় ধাপে ইস্কাটন থেকে মৌচাক পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হয়েছে ৮৫ শতাংশ। যা আগামী জুন-জুলাইয়ে যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হতে পারে। আর শেষ ধাপ রামপুরা থেকে মালিবাগ-মৌচাক হয়ে রাজারবাগ-শান্তিনগরের কাজের মাত্র ৪৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। যা এ বছরের ডিসেম্বরে চালু করার আশাবাদ প্রকল্প কর্মকর্তাদের। ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছিলেন। সমন্বিত এ ফ্লাইওভারের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালের মধ্যে। পরে ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করে চালু করার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাও হয়নি। এর মধ্যে ফ্লাইওভারটির ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। আর এ সড়কে চলাচলকারী জনসাধারণের দুর্ভোগও সীমা ছাড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত সাতরাস্তা থেকে হলিফ্যামিলি হাসপাতাল পর্যন্ত ফ্লাইওভারের প্রথম অংশ খুলে দেয়ার মধ্য দিয়েই এ রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের চিত্র বদলাবে এমন আশাবাদ নগরবাসীর। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। এর আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক জানিয়েছিলেন, মার্চের মধ্যে ফ্লাইওভারটির কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছিল। রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এই প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। তবে ঠিকাদার ও তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার কারণে তিন দফায় সময় বাড়ানোর পর এখন ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৫৮ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ২১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ভারতের সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও নাভানার যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান ‘সিমপ্লেক্স নাভানা জেভি’ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান দ্য নাম্বার ফোর মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি (এমসিসিসি) ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড উড়াল সড়কটির নির্মাণ কাজ করছে। তবে এখন বেশিরভাগ অংশের কাজই করছে তমা। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিদেশী প্রতিষ্ঠান দিয়ে নক্সা করানোর কারণে এক পর্যায়ে উড়াল সড়কের জটিল ত্রুটি ধরা পড়ে। আমেরিকান প্রকৌশলীরা নিজ দেশে বাম হাতে চালকদের স্টিয়ারিং ধরার বিষয়টি মাথায় রেখেই নক্সা করেন। কিন্তু আমাদের দেশে ডান হাতে থাকে পরিবহন চালকদের স্টিয়ারিং। এ নিয়ে জটিলতা বাধে। এক পর্যায়ে ১২২ বার প্রকল্পের নক্সা বদলানো হয়। তাছাড়া ফ্লাইওভারে উঠা ও নামার অংশের ত্রুটি সমাধান করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা। নক্সার ভুলের কারণে ৬০টি পিলার ভাঙ্গার পরামর্শ দেয়া হয় এলজিইডিকে। জবাবে প্রকল্প পরিচালক মোঃ নাজমুল আলম বলেন, ফ্লাইওভারে ডানহাতি স্টিয়ারিংয়ের কথা মাথায় রেখেই ডিজাইন করা হয়েছে। নির্মাণ কাজও চলছে সেভাবে। কাজেই ডানহাতি স্টিয়ারিং অনুযায়ী যান চলাচলে ঝুঁকির কোন কারণ নেই। তিনি বলেন, অনেকে না জেনে সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ বলছেন, ৬০টি পিলার ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কিন্তু কেন? কি এমন হলো যে পিলারগুলো ভেঙ্গে ফেলতে হবে। কিছুই হয়নি। সবকিছু ঠিক আছে। কোন আতঙ্কের কারণ নেই। আমরা এখন পর্যন্ত তো কোন পিলার ভাঙ্গিনি। যত সমালোচনা চলছে, তত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।
×