ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

মার্কিন-কিউবা সম্পর্কে নব অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ৩০ মার্চ ২০১৬

মার্কিন-কিউবা সম্পর্কে নব অধ্যায়

গত ২১ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ঐতিহাসিক কিউবা সফরের মধ্য দিয়ে দুদেশের সম্পর্কে নব অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। ৮৮ বছরের মধ্যে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই প্রথম কিউবা সফর। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ওবামা ও কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রো সমঝোতার যে প্রক্রিয়া সূচনা করেছিলেন এই সফর তারই এক প্রতীকী পরিণতি। ওবামা এই সফরে তার সঙ্গে ৪০ কংগ্রেস সদস্যকে নিয়ে আসেন। সেদিনই তিনি প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে দুই নেতা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, দুদেশের মধ্যে এখনও সুগভীর মতপার্থক্য রয়ে গেছে। তথাপি সম্পর্কোন্নয়নের মধ্য দিয়ে এক অভিন্ন ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাবে বলে তারা আশা করেন। ওবামা বলেন, মার্কিন-কিউবা সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দিনের আগমন ঘটেছে। তিনি উল্লেখ করেন যে, তার সঙ্গে কংগ্রেস সদস্যদের এত বিশাল এক দলের আগমন কিউবার ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিতে মার্কিন কংগ্রেসের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের পরিচায়ক। দুটি দেশ সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া শুরু করার পর উভয়ের মধ্যে সরাসরি ডাক সার্ভিস, বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালুসহ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধার সম্প্রসারণ ঘটেছে। এসব পদক্ষেপকে গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিহিত করলেও প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রো বলেন, কিউবার ওপর দীর্ঘদিনের অবরোধের অবসান ঘটতে হবে। কারণ কিউবার অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনগণের কল্যাণ সাধনের পথে এই অবরোধই সবচেয়ে বড় বাধা। সে কারণেই এটা তুলে নেয়া এত জরুরী। অন্যদিকে ওবামা বলেন, অবরোধ তুলে নেয়া হবে বলে তিনি আস্থাবান তবে কখন হবে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। কিউবায় বিপুলসংখ্যক রাজবন্দী জেলে আছে। তাই মানবাধিকারের ইস্যুটা দুদেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় মতানৈক্যের বিষয়। অবশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে ক্যাস্ট্রো তার দেশে রাজবন্দী থাকার কথা অস্বীকার করেন। তিনি বরং মানবাধিকার প্রশ্নে রাজনৈতিক কারসাজি ও দ্বিমুখীনীতি অনুসরণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন। ক্যাস্ট্রো যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগের অভাব এবং সমান বেতনের অনুপস্থিতিকে ক্ষমার অযোগ্য আখ্যায়িত করেন। তবে এ ধরনের অভিযোগ পাল্টা-অভিযোগ সত্ত্বেও এ কথা স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, ২০১৪-এর ডিসেম্বর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দুদেশের সম্পর্কে লক্ষণীয় অগ্রগতি ঘটেছে। অর্ধশতাব্দী যাবত কিউবার ওপর আরোপিত মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধ শিথিল হয়েছে। সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকা থেকে কেটে দেয়া হয়েছে কিউবার নাম। ১৯৬১ সালে ছিন্ন হওয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার উদ্দেশ্যে মার্কিন নাগরিকদের কিউবায় যেতে আর বাধা নেই। ওবামা ও তার সফরসঙ্গীরা কিউবায় এসে আশাবাদী হওয়ার মত লক্ষণ নিশ্চয়ই কিছু দেখতে পেয়েছেন। কারণ কিউবা দৃশ্যতই বদলে যাচ্ছে। অংশত এর কারণ হলো ওবামার সঙ্গে সমঝোতা হওয়ার আগে রাউল ক্যাস্ট্রোর সূচিত অর্থনৈতিক সংস্কার। তবে সেই পরিবর্তনটা যতটা না হয়েছে অধিকাংশ কিউবানের স্বাধীনতা ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি হয়েছে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের জীবনধারার ক্ষেত্রে। প্রায় ৫ লাখ কিউবান স্ব-পেশায় নিয়োজিত। এরা মূলত ট্যুরিস্টদের চাহিদা মেটায় রেস্ট হাউস ও রেস্তরাঁ মালিক এবং ট্যাক্সিচালক হিসেবে। এতে তাদের আয় অনেক বেড়ে গেছে। গত দুবছরে হাভানায় প্রায় তিন শ’ রেস্তরাঁ ও বার চালু হয়েছে। অথচ এক দশক আগেও অর্থবিত্ত আছে এমন মুষ্টিমেয় কিইবান তাদের বিত্তের পরিচয় দিতে সাহস পেত না। এখন পারে। তারা ভিআইপি এলাকায় থাকে। তাদের জীবনের ভোগ-বিলাস আছে। তবে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যারা কিউবায় রেস্তরাঁ বারের চেয়ে ঢের বেশি উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে চায় তাদের জন্য কিউবার পরিবেশ এখনও তেমন আকর্ষণীয় নয়। সরকার বিদেশী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে কিউবায় ব্যবসা করার অনুমতি দিলেও সেটা কিভাবে ঘটতে দিতে হবে সে ব্যাপারে সরকারী কর্মকর্তাদের প্রায়শই কোন ধারণা থাকে না। এ কারণেই সম্ভবত কিউবান কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদলগুলোর আলোচনা অনেক সময় ঘোলাটে রূপ ধারণ করে। চিনি শিল্প পরিদর্শনকারী একটি দলের অভিজ্ঞতা ছিল এতই ভয়াবহ যে, তাদের মনে হয়েছিল তারা ভুল জায়গায় হাজির হয়েছে। তাছাড়া ব্যবসা করার আইন-কানুনও আশাব্যঞ্জক নয়। বিদেশীদের ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত আর্থিক সুবিধা খাতে শ্রমিকদের পকেটে না গিয়ে সরকারের পকেটস্থ হয় কিছু কিছু আইনে তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে। যৌথ উদ্যোগ প্রকল্পে বিনিয়োগকারীরা শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন মার্কিন ডলারের সমমূল্যে রূপান্তর যোগ্য পেসোতে সরাসরি সরকারকে পরিশোধ করে। সরকার তখন ঐ অর্থের একাংশ পেসোতে শ্রমিক-কর্মচারীদের পরিশোধ করে। বাকিটা পকেটস্থ করে। এত সব নিরানন্দ পরিবেশ-পরিস্থিতিতেও আশা করা হচ্ছে যে, ওবামার এই সফরের পর দু’একটি মার্কিন কোম্পানি সম্ভবত জ্বালানি, টেলিকম ও হোটেল শিল্পে বিনিয়োগ করবে। এইভাবে ধীরে ধীরে দুদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হবে। তাতে কিউবার অর্থনীতিতে তেজীভাব আসবে আর অর্থনীতি তেজী হলে সমাজতান্ত্রিক কিউবার রাজনৈতিক সংস্কারেরও গতি সঞ্চারিত হবে।
×