ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

বর্ণিল প্রজাপতির অন্ধকার রূপ

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১ এপ্রিল ২০১৬

বর্ণিল প্রজাপতির অন্ধকার রূপ

প্রজাপতি তাদের রং-বেরঙের পাখনা মেলে আমাদের বাগানে, আঙ্গিনায় উড়ে বেড়ায়। তাদের উজ্জ্বল, বর্ণিল ডানা আমাদের বিমোহিত করে। তবে প্রজাপতির এক বহুরূপী রূপ আছে যা শত শত বছর আমাদের বোকা বানিয়েছে, ধোঁকা দিয়েছে। আমরা হয়ত অনেকেই জানি না যে প্রজাপতির এক অন্ধকার দিক আছে। ঐ যে উজ্জ্বল, চোখ ধাঁধানো মনোমুগ্ধকর রং আমরা দেখি সেগুলো আসলে অনেক সময় হুঁশিয়ারি সঙ্কেত। প্রায় সর্বক্ষণই প্রজাপতি এক গোপন জীবন যাপন করে যা আমরা অধিকাংশ কখনই লক্ষ করি না। এই যেমন জেব্রার মতো ডোরাকাটা লম্বা ডানাওয়ালা হেলিকনিয়াস চারিথোনিয়ার কথাই ধরা যাক। দেখতে ওদেরকে যথেষ্ট নিরীহ বলে মনে হয়। তবে এরা বিষাক্ত বলে কুখ্যাতি আছে। এদের শুয়াপোকাগুলো স্বগোত্রভোজী। নিজেদের সহোদরদের খেয়ে ফেলে। স্ত্রী প্রজাপতি যখন গুটিপোকার অবস্থা থেকে স্বরূপে আবির্ভূত হতে উদ্যত হয় তখন একদল পুরুষ প্রজাপতি তার চারপাশে ভিড় করে। তারা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে একজন আরেকজনকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। এই ঠেলাঠেলির লড়াইয়ে যে জেতে সে স্ত্রী গুটিপোকা বা মুককীটের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। তবে সঙ্গমের জন্য পুরুষ প্রজাপতি এতই তাড়না অনুভব করে যে অনেক সময় সে তার ধারালো শুঁড়গুলো দিয়ে গুটি ভেদ করে ভেতরে চলে যায় এবং স্ত্রী মুককীট সেই গুটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারার আগেই তার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হয়। স্ত্রী মুককীট গুটির ভেতরে আটকে থাকে বলে তার এ ব্যাপারে কিছুই করার থাকে না। এখানে তার ইচ্ছা অনিচ্ছার কিছুই যায় আসে না। কিছু কিছু জীববিজ্ঞানী অবশ্য খানিকটা উদারতার পরিচয় দিতে চান। তারা একে জবরদস্তিমূলক সঙ্গম বলার পক্ষপাতী। তবে যেভাবেই বলা হোক না কেন তা বাচ্চাদের বইয়ে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়। জেব্রা লং উইং বাটারফ্লাই নিঃসন্দেহে অতীব সুন্দর দেখতে। সেজন্যই হয়ত এটা ফ্লোরিডা রাজ্যে প্রজাপতির মর্যাদা লাভ করেছে। তবে এক মুহূর্তের জন্য মনে করলে চলবে না যে জেব্রা লং উইংই এসব দিক দিয়ে একটা ব্যতিক্রম। মোটেও তা নয়। তাদের মতো বাজে স্বভাবের প্রজাপতি আরও অনেক আছে। যেমন, পতঙ্গবিজ্ঞানী ডিনো মার্টিনস একদিন কেনিয়ার এক অরণ্যে দুই হোয়াইট বারড চারাক্সের মধ্যে দেখার মতো এক লড়াই প্রত্যক্ষ করেন। পড়ে পাওয়া একটা গাছের গুঁড়ি থেকে রস চোয়াচ্ছে। রসটা গাঁজান ছিল বলে বলে একদল প্রজাপতি একটু একটু করে এ রসপান করছিল আর মাতাল হয়ে পড়ছিল। এক পর্যায়ে দুই মাতাল প্রজাপতির মধ্যে শুরু হয়ে গেল লড়াই । শুঁড়িখানায় যেমন দুই মাতালের মধ্যে মারামারি বেধে যাওয়া ঘটনা কখনও সখনও দেখা পায়, এও কতকটা তেমনি। এরা কখনও একজন আরেকজনকে পেঁচিয়ে ধরছে, কামড়ে পাখনা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। একসময় লড়াই শেষ হলো। পরাজিত প্রজাপতির ছিন্ন ভিন্ন ডানা পড়ে রইল বনভূমির বুকে। চারাক্সকে বলা হয় সম্রাট প্রজাপতি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর প্রাক্তন এক্সপ্লোরার ডিনো মার্টিন ইস্ট আফ্রিকায় প্রকাশিত ‘সোমারা’ ম্যাগাজিনে একবার লিখেছিলেন এই প্রজাপতি দ্রুত গতির ও শক্তিশালী। তারা মধুর চেয়েও বেশি নেশাকর রস, তাজা গোবর, পচা গলিত মাংস বিশেষভাবে পছন্দ করে। জীবজন্তুর সদ্য ত্যাগ করা গোবর খেলে তারা রীতিমতো মাতাল হয়ে যায়। তারা তাদের শুঁড় মেলে দিয়ে গবগব করে খেতে থাকে। এই গোবর থেকে তারা লবণ ও এ্যামাইনো এসিড আহরণ করে নেয় যা তারা উদ্ভিদ থেকে পায় না। এটাকে বলে কাদা খুঁটে বেরানো যা প্রজাপতির আচরণের অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এজন্য যে গোবর লাগবেই এমন কোন কথা নেই। যদিও গোবর সর্বদাই উত্তম। এমন দৃশ্য হয়ত অনেকের চোখে পড়েছে যে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি মরা পশুর শরীরে বসে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। তারা পশুর শরীরের ঘাম ও রক্তও পান করে। কিন্তু তারপরও কেউ যদি বলে যে প্রজাপতি কোন ক্ষতি করে না সে কথা কি ঠিক? এর উত্তর হচ্ছেÑ ক্ষতিকর নয় কথাটা সর্বদা সত্য নয়। প্রজাপতির জীবন শুরু হয় শুঁয়াপোকা হিসেবে। এরা নিরীহ, নির্দোষ এমনটা মোটেও নয়। সুস্বাদু কোন উদ্ভিদ পেলে ওরা সেটাকে খেয়ে ফেলে। কোন কোন প্রজাপতি পরজীবীর মতো। ম্যাকুলিমিয়া রিবেলি নামে এক জাতের প্রজাপতি আছে যেগুলো কৌশলে ও চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে পিঁপড়েদের দিয়ে তাদের বাচ্চা লালন করিয়ে নেয়। শুঁয়াপোকাগুলো রানী পিঁপড়ের অনুকরণ করে আওয়াজ করে। সেই আওয়াজে পিঁপড়েদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। পিঁপড়েরা তখন শুঁয়াপোকাকে তুলে নিয়ে তাদের কলোনিতে নিয়ে যায় সিডান চেয়ারে বসা বনেদি ব্যক্তিদের মতো করে। সেই কলোনির ভেতর তাদের সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই রাজা বাদশাহের মতো আচরণ করা হয়। শ্রমিক পিঁপড়েরা তাদের জন্য নিজেদের গলার ভেতর থেকে খাদ্য উগড়ে দেয়। খাদ্যাভাব থাকলে তাদের খাওয়ানোর জন্য সেবিকা পিঁপড়েরা অনেক সময় নিজেদের বাচ্চাদের বিসর্জন পর্যন্ত দেয়। সূত্র : লাইফ সায়েন্স, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি
×