ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

টেলিভিশন বিষয়ক কবিতা

প্রকাশিত: ০৭:০৫, ১ এপ্রিল ২০১৬

টেলিভিশন বিষয়ক কবিতা

আমরা যারা টিভির সাধারণ দর্শকমাত্র আছেটা কী আর দেখবোটাই বা কী, সবই তো রঙিন রঙে রঙে রঙমশাল, প্রজাপতির ডানায় উদ্যত সঙ্গিন রক্তচক্ষু কখনো নাচায়, কখনো বা ঢিলে তালে ধ্রুপদ ধামার ঝালা আলাপ মেলে ধরে-হুজুগে মাতে ধ্রুবপদ। প্রাচীন ধাঁচের বৈঠকী অভ্যাসে কারো দেয় চিত্তে চাগাড় যা গিলে তা সবই হলো বস্তাপচা-বিজ্ঞাপনে পূর্ণ ভাগাড় পাঁচফোড়নে পঞ্চব্যঞ্জনে রাঁধে হরেক কিসিমের সুখাদ্য সে সব খাদ্যে জেগে ওঠে বিবমিষা-গিলে যে কার সাধ্য। তবুও চেখে হয় যে যেতে হোক না তা যতই বর্জ্য রাবিশ অজস্র চ্যানেল দেখার জন্য রয়ে যে যায় কত্তো হা-পিত্যেশ আমরা রোজ যাই যে তা দেখে আর গন্ধ মাদন শুঁকি অযথাই চ্যানেলে চ্যানেলে গোলেমালে মারদাঙ্গা পায় আদি নিবাসটাই। বুঝি আর না বুঝি-তবু চ্যানেলে চ্যানেলে কতো কী যাই খুঁজি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান প্রাণমন-সবটুকু নাহি যে সরাসরি বুঝি বোঝার আছে ঝুট-ঝামেলা, ঝঞ্চাট কেবল বাড়তে বাড়তে যায় যেতে যেতে পাকায় গোলমাল-গোলযোগে কত কি যে জড়ায়। গোলেমালে আর হট্টগোলে চ্যানেল জুড়ে বিনোদনের রফাদফা আমরা যে হই দর্শনধারী পদবিহীন-জীবন তবু টিভিতেই সঁপা। প্রাইম টাইম নিউজে প্রাইম টাইম নিউজে আপনাকে দেখলাম, কী হাসি হাসি মুখ হেসে হেসে আপনি বলছেন, হাত নেড়ে নেড়ে ঘাড় বাঁকিয়ে ঈষৎ ঝুঁকে ক্যামেরার লেন্সমুখী-মনে হয় ফুলকলিরাই ফুটছে- ফুল ফোটার সময় যায় বহে সুবাতাসে সুবাসিত সুগন্ধীর তাপে ভিত্তিপ্রস্তরের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি, ফুলের তোড়া ধরে আছে সঙ্গে এসেছে যারা, তাদেরও বিকশিত দন্তউগারি বিগলিত ভাব নানান ধরন বরণের কত না সব অবয়ব যেন পুষ্পিত ইমেজধারি হয়ে আপনার পাশে একসঙ্গে উঠছে হেসে- মোসাহেবী ভাবসাব এই আয়োজনে টিভি ক্যামেরা আপনাতেই স্থির-প্রতিটি ফ্রেমজুড়ে প্রতিটি মুভমেন্টে আপনি, হ্যাঁ আপনার নড়ে চড়ে ওঠা হাতের তালু ক্লোজআপে কেমন মোহময় অংগুরীতে ঠাসা-হীরা-পান্নার ভ্যারাইটি- আহা কতদিন পর-কত কতদিন পর আপনি পাবলিকেরই সামনে জনতার মেলবন্ধনে এসে দাঁড়ালেন হিমালয়সম-আলেকজান্ডারের পরই দিগি¦জয়ের দ্বিতীয় স্থানে লিখে দিতে চায় যদি আপনার নামধাম পদবি বিশ্ববিজয়ী মানুষ, রবীন্দ্রনাথের পরই আপনাকে করে তোলে খ্যাতিমান প্রেজেন্টার মৃদু হেসে ঘাড় বাঁকিয়ে কী চমৎকার উচ্চারণে বলে বলে যায় আপনার পূতপবিত্র নাম ও ধাম বিশেষণে পূর্ণ মানবশাবকের প্রতি মমতায় স্ক্রলে ভেসে উঠছে পদ-পদবিসহ আপনার আপোসহীন নামধাম কর্মকা- সবকিছু কেমন জ্বলজ্বলে হয়ে জ্বলছে ক্রমাগত প্রাইম টাইম নিউজে........ আপনারা দেখছেন ‘আপনারা দেখছেন’ বলে ঘাড় বেঁকিয়ে বলল যখন প্রেজেন্টার লোলুপ চোখে তাকিয়ে থেকেও বুঝছি না আছে কী যে দেখার- ঘাড় দেখি না, পিঠ দেখি না, খোঁপার ছাদও হায় চোখের আড়াল দেখার আছে শুধু বাঁকা চাহনি, নাকছাবি আর ভাঙ্গা চাপার গাল চুলের রিবন, কানপাশা, ক্লিপ ফোন, বাঁকা ঠোঁটের ওঠা এবং নামা দেখতে দেখতে তিতিবিরক্ত মেজাজখানা, বলি ‘থামা ওরে থামা’। বললই যখন দেখতে থাকি, দেখার আছে স্ক্রীনজুড়ে অনেক কিছু জানার হয়ত নেই তেমন আর, জানতে হলে ছুটব কার সে পিছু দেখব বলে বসে থাকি, এক্কেবারেই প্রেজেন্টারের নাসিকা বরাবর দেখতে দেখতে চোখ মুঁদে যায়, ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন আনে বাসরঘর। মওলা এত দিলা জগত ভইরা- সব দেখব এমন কত যে আর এখন দেখি রঙিন স্ক্রীনেও ডাকে শুধু বায়স্কোপ নাচ দেখতে যাবার দেখতে দেখতে ঘাড়ও যায় বেঁকে, মাথায় মারে নেশার লাটিম ঝিম মারতে মারতে চ্যানেলজুড়ে বৃষ্টি ধরে আদ্যিকালের গীতল রিমঝিম। বৃষ্টিভেজা প্রেজেন্টারে পেখম তোলে ময়ূরী নাচের মুদ্রা ঘিরে ত্রিতালে ভিজিয়ে দিল এই আমাকে, না জানি কী রয়ে গেছে দর্শকেরই কপালে লেপ্টে আছে দেহের ফাঁদে, থাকুক তবে আষ্টেপৃষ্ঠে-জীবনভর রয় যেন ঘুমের ঘোরে হাই তুলে তাই বলি নিজকেই নিজে, ‘আপনারা দেখছেন...’ বিরতির পর দেখবেন ‘বিরতির পর দেখবেন’-বলে ঢংকা নিনাদ বাজাল সে যখন আমার তখন ঘুম পেয়েছে, পড়েছি ঘুম বিরতির গাঢ় কবলে বালকবেলা ইসকুল গেলে বিরতি পেতাম যে টিফিনের কালে তুঙ্গে যখন সাসপেন্স-সিনেমা হলে বিরতিরই ড্রপসিন তখন। কত কিযে যায় দেখা বিরতির পর, দেখার জন্য হাই উঠে যায় চোখ মুঁদলে দেখতে পাই খরগোশ কেমনতর লাফায়-দাফায় বেড়ালছানা ঘুরছে পাশে দেখছি বেশ নাদুসনুদুস গায়েগতরে ডোনাল্ডডাক হঠাৎ দেখি স্ট্রিপস্ট্রিজে জবরদস্ত পাকা পারদর্শী তার সঙ্গে যেই নাচতে গেল, দেখতে পাই পর্দা জুড়ে স্বর্ণকেশী লোভাতুর চাহনী মেলে বলল ডেকে-‘দেখা হবে বিরতির পরে’। বিরতির পর কেই বা আসে জাগাবে মনে কে তবে আর আশনাই নাইটক্লাবে দরদাম শেষে বনিবনা না হওয়াজন, ‘সঙ্গে যাবার চাই’ বলেই আচমকা ঘুরে গিয়ে শোনায় কী অনায়াসে বিরতির পর, ‘হাই’ দেখবেন আমি কেমন করে বিনা ম্যাসেজে শরীরজুড়ে বিরতি জড়াই। আমাদের সঙ্গে থাকুন ‘আমাদের সঙ্গেই থাকুন’-বলে স্মিত হেসে মুখ লুকালো বিজ্ঞাপনের ঢালে আমরা তার সঙ্গে যাব, সঙ সেজে রঙ্গ করে দেখব কোন দিকচক্রবালে কোন মুখটি স্মিত হেসে সঙ্গে থাকার আমন্ত্রণে ডাক দিয়ে যায় কূটকচালে এখন কোথায় মুখ লুকাল, চোখ থেকে যার ঠিকরে পড়ে ইশারা অগ্রবালে কোন ফাঁকে যে চাগাড় দিল সঙ্গে থাকার- যাবে যেথায় সঙ্গে সঙ্গে যাবার সঙ্গী হবার সাধ মেটাতে রঙ্গরসে খুনসুঁটিতে আরো বেশি কাছাকাছি পাবার সঙ্গে থেকে সেই যে আমি সঙ্গী হবার মনে মনে অযুত নিযুত কত না যুক্তি দাঁড় করিয়ে সিদ্ধান্ত নেই-সঙ্গেই আছি-থাকব সঙ্গে-সঙ্গই দেয় যে মুক্তি মুক্ত মানুষ বাধা পড়ে কবে কোথায় সঙ্গদোষে অঙ্গে তোলে ঝিলিমিলি ঢেউ বাড়াভাতে মেখে ছাই- সঙ্গদানের আসরকে এমনভাবে মাটি করে কেউ রঙ্গ দেখে প্রাণ বাঁচে না, ঢঙ্গমুখী হ্যাঁ করে না রাঁ করে না থাকে শুধুই নির্বাক আর কখনো সঙ্গে যাব? ঘাট হয়েছে বলুক যতই থাকুক না কণ্ঠ সবাক। সঙ্গে থাকার প্যাঁচ-প্যাঁচানি দিনের পর দিন যদি এমনভাবেই চলতে থাকে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া, নিজের সঙ্গে সমঝোতা-হিজাবের আড়ালেই ঢাকে। বিজ্ঞাপন বিরতির ফাঁকে বিজ্ঞাপন বিরতির ফাঁকে এসো সাঙ্গ করি চুম্বনপর্ব কী প্রয়োজন জানার-ধারাবাহিকের এটা কোন পর্ব গর্বিত হই রোমান্স জাগে রোমান্স লাগে এই ফাঁকে প্রেজেন্টারের বাঁকানো ঘাড় ক্যামেরার লেন্স ঢাকে। কাজই যাদের পেটানো ঢাক ও ঢোল, পেটাও তাদের ঢোলে মন পবনের নৌকা চলে, ধি নাক তি নাক তা ধিন বোলে বোল চালে যায় না তো কম, বেতাল গলার মাতাল চুনোপুঁটি মাথা মগজ গিলে ফেলেই স্ক্রীনেই করে হরদম লুটোপুটি। খুঁটির জোর আছে বলেই বিজ্ঞাপন বিরতির এই দীর্ঘকালে বিজ্ঞাপনের জোশ নিয়ে এসো শরীর জড়াই দেহের তন্তুজালে এ্যাড বিরতির ফাঁকফোকরে চুম্বনেরই ম্যারাথন ভোজন চলে খেলতে খেলতে পুরো খেলায় তালে তালে হংসমিথুনেরা ঢলে। ঢলুক যারা ঢলার, মডেলবালারই কণ্ঠে বাজুক তবে ফিলার গান বিজ্ঞাপনেই মজে আছি, বিজ্ঞাপনেই করে জন্ম এবং দিব্যদৃষ্টিদান।
×