ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

নীরবতার তীরধনুক

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ১ এপ্রিল ২০১৬

নীরবতার তীরধনুক

চারুশিল্প বিভিন্ন ধারায় বিস্তৃত। তার জমিনে নানা রূপের অভিঘাত। সেই রূপসাগরে ডুব দিয়ে শিল্পী তাঁর চিত্রপটে তুলে আনেন সৌন্দর্যের অদেখা ভুবন। আবার মানব সমাজের নানান অসঙ্গতি, নানান বৈষম্য আর অন্যায়কেও শিল্পীরা চিত্রিত করেন সমুদয় অন্যায় থেকে মানুষ ও জগৎকে বাঁচাতে। কারও কাজে ঘৃণার তীব্রতা, কারও কাজে সুন্দরের প্রশস্তি। কেউ আবার সময়ের বহমানতায় টেনশন তুলে ধরেন ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে। এক বৈচিত্র্যময় অথচ গা শিউরে ওঠা থিমের ওপর স্থাপনাকর্ম মানুষের মধ্যে নাটকীয় ও ডায়নামিক সংলাপ চালিয়ে নেয় শিল্পী। ঢালী আল মামুন প্রমাণ করলেন তিনি সময়ের বহমানতার এমনই প্রকাশবাদী এক শিল্পী। আধুনিক শিল্পী হিসেবে ঢালী ইতোমধ্যে বেশ শক্ত ভিত তৈরি করে নিয়েছেন। সমাজ বাস্তবতায় যারা নিরন্তর নিজের সৃজনকে মানবকল্যাণ ও সমাজ পরিবর্তনের পক্ষে নিয়োজিত করতে চেয়েছেন, তিনি তাঁদের মধ্যে ছিলেন নেতৃস্থানীয়। সম্প্রতি বেঙ্গল শিল্পালয়ে শেষ হয়ে গেল ঢালী আল মামুনের একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ‘টাইম, কো-ইন্সিডেন্স অ্যান্ড হিস্টরি।’ ড্রয়িং, ভাস্কর্য, স্থাপনা ও চলমান চিত্রকল্পের মাধ্যমে করা মোট ১২টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছিল এই প্রদর্শনীতে। বাংলাদেশী শিল্পীদের শিল্পকলা বিমূর্ত হওয়ার পেছনের কারণ যত না সুখ-দুঃখের অনুভূতি, তার চেয়েও বড় কারণ ভেতরে গেড়ে বসা সামাজিক ভীতি। বিমূর্ততা কখনো কখনো উন্মোচনের সহায়ক। কিন্তু অবচেতন ভীতির সঙ্গে পরিস্থিতিজাত সামাজিক ভীতির মিশেলে বিমূর্ততা হয়ে পড়ে একরকমের আড়াল। সে-আড়াল বিভিন্ন স্তরে কখনো কথিত শুদ্ধতার, কখনো দৈবের, কখনো উভয়ের আশ্রয়ে স্বস্ত হয়। এই প্রদর্শনী এমনটিই বলে। বর্তমান বৈষয়িক পৃথিবীতে সৌন্দর্যের চাইতে, ফুলের সৌরভের চাইতে, যেন নির্যাসের মূল্য বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বাস্তবতা কষ্ট দেয় ঢালীকে। শিল্পী বলেই তিনি তাঁর সেই কষ্টকে প্রকাশ করেন শিল্পের ভাষায়- এক অনন্য ভঙ্গিমায়। তিনি তাঁর সৃজন শক্তিকে নিয়োজিত করেন দেশ, সমাজ আর বিশ্ব-রাজনীতির নানা পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবাদের শিল্পিত উপস্থাপনায়। ঢালী আল মামুনের ড্রয়িং, গতিময় ভাস্কর্য ও স্থাপনা স্থানিক বাস্তবতায় জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার যে বহুবিধ প্রক্রিয়া বিভিন্ন সময়ে একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে তা উদ্ভাবনে উদ্যোগী হয়। আলো, বয়ন-বিন্যাস এবং অবয়বের স্তরান্তরের মধ্য দিয়ে তিনি জটিল ও নাটকীয় অভিজ্ঞতার রূপক নির্মাণ করেছেন। তাঁর এ প্রয়াস এ অঞ্চলের ইতিহাস ও অতীত স্মৃতির ওপর আলোর বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে। শিল্পী সমন্বয় ঘটিয়েছেন আলো, নিরেট ও তরলের। স্থাপনাকর্মের বিভিন্ন অংশের আলাদা আলাদা নাম রয়েছে, তবে কোনটিই যোগসূত্রের বাইরে নয়। সবগুলোকে নিয়ে মালাটি গাঁথতে হবে দর্শককেই। শিল্পী শুধু কিছু সূত্র রেখে গেছেন। বাংলাদেশে পেইন্টিং বা ভাস্কর্য শিল্পের বাইরে স্থাপনা শিল্পের চর্চা এখনো ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। তবে অনেকেই এর চর্চা শুরু করেছেন এবং দর্শকদের মনেও কৌতূহল জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। প্রদর্শনীতে ঢুকেই চোখে পড়ে গাছের অসংখ্য ছোট ছোট মৃত ডাল দিয়ে তৈরি একটি স্থাপনাশিল্প। আলো-ছায়ার বিন্যাসে এটি ধারণ করেছে এক পরাবাস্তব রূপ। এই শিল্পকর্মটির দুই দিকে চলমান চিত্রকল্পের উপস্থাপনই জানান দিচ্ছে মৃত ডাল সজ্জার হেতু। এক পাশের স্ক্রিনে পাতার মৃত রূপ ও নিচে তিনটি চলমান পাতার কঙ্কাল। বিপরীত স্ক্রিনে প্রাণীর শুঁড়ের চলমানতা। এ যেন ধ্বংসযজ্ঞের মাঝেও জীবনের স্পন্দন। বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি। বিশাল কাচের ট্রেতে ফুলের মধ্য দিয়ে পোড়া লুব্রিকেন্টস প্রবাহিত হচ্ছে, যা মিহি রেখায় নিচে জমা হচ্ছে। এই স্থাপনার সঙ্গে ঘ্রাণ ইন্দ্রীয়ও যুক্ত। মামুনের এই প্রদর্শনীকে বলা যায় প্রকৃতি ও জীবের অস্থি দিয়ে নির্মিত। এখানে শুকনো পাতা ঘূর্ণায়মান, মোটরচালিত। পাখির শব্দ সাউন্ড বক্সে শুনি। প্রজেক্টরে দেখি কলাপাতার দোলা বা শামুকের চলাচল। মাথার উপরে ঝুলে আছে শুকনো ডালপালা। উপাদান, উপকরণ, চিত্রকল্পের ভাব ও সূত্র এবং প্রকরণ সব মিলিয়ে একটি অর্থ বা উপলদ্ধির প্রপঞ্চ তৈরির প্রয়াস। প্রাণহীন বস্তুর মধ্যে গতির সঞ্চার করে এক মানবীয় বৈশিষ্ট্য আরোপ করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর কাগজে বিধৃত চিত্রকল্পে বিবৃত হয়েছে মূল বিষয়ের সঙ্গে উপলদ্ধির সাদৃশ্য। পঙ্কিল পারিপার্শ্বিকতার বাস্তবতায় প্রতীকী চর্চা শিল্পীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ঢালী আল মামুনের স্থাপনা শিল্পকর্ম নাটকীয়ভাবে উপস্থাপিত বিষয় বৈচিত্র্য দারুণভাবে নাড়া দেয়। অপরিণামদর্শী সভ্যতার অগ্রগতি উঠে আসে শিল্পীর কাজে। সবুজ পৃথিবী কঙ্কালসার নগরে পরিণত হয়ে উঠছে তাও তিনি বলেছেন। আবার নিসর্গের নিঃশব্দ সৌন্দর্যেও তিনি উদ্বেলিত হন। আগ্রাসী অর্থনীতির অশুভ চক্রে অবহেলার শিকার মানুষ এবং তার দলিল ও নিষ্পেশনের গল্প শিল্পীকে পীড়িত করে। ‘হারানো স্মৃতি-৪’ শিরোনামে কাগজে পেন্সিলে আঁকা ড্রয়িংয়ে শিল্পী প্রায় বিলুপ্তির পথে যাওয়া নানা প্রজাতির কঙ্কালসার মাছ, হাঁস ও শাপলা নিয়ে শিল্পীর গঠন আমাদের মনে করিয়ে দেয় সমৃদ্ধ অতীত থেকে আমরা যেন চলেছি, ক্ষয়ের দিকে, অবক্ষয়ের পথে। মামুনের কাজ খুব সহজবোধ্য নয়। তাঁর কাজের ভাবার্থ বুঝতে দর্শকদের সচেতন দৃষ্টিতে কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আর এখানেই শিল্পীর সার্থকতা। লক্ষ্য করলে বোঝা যায় তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় স্থান করে নিয়েছে। তাঁর শিল্পকর্মগুলোর মধ্যে নান্দনিকতা ছাড়াও জায়গা পেয়েছে ইতিহাস। আর প্রকৃতির সরব উপস্থিতি তো আছেই। তাঁর কাজের প্রকাশ ভঙ্গির অভিনবত্ব তাকে অন্যান্য সবার থেকে আলাদা করে। ‘লাট সাহেবের চেয়ার’ শিরোনামের কাজটি আমাদের সামনে সেই ইতিহাসকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয় ঔপনিবেশিক আভিজাত্য ও বর্তমানের ক্ষয়প্রাপ্ত অবয়ব এর মাধ্যমে। দ্বিখ-িত এই চেয়ারটি মোঘল ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশকে চিহ্নিত করেছে। নির্মাণ কৌশলও অনন্য। মোঘল আমলের অংশটুকু ঘোড়ার কঙ্কাল দিয়ে আর ব্রিটিশ আমলের অংশটুকু লবঙ্গ দিয়ে। মামুনের প্রদর্শনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রাগৈতিহাসিক কঙ্কাল। এসব কঙ্কাল আশ্রিত স্থাপনা শিল্প দেখে হয়তো মনে হবে নিছক সাজিয়ে রাখা। পানিরকলের মুখ থেকে সাপের লেজের মতো বেরিয়ে এসেছে দীর্ঘ বেণীবাঁধা চুল। মনে হয় কোন নারী যেন ভেতরে ঢুকে গেছে। কলের চাবি আবার মানুষের মুখ দিয়ে গড়া। এই শিল্পকর্মটি যে বয়ানে আমাদের জানান দেয় তা সময়ের কাকতালীয় বয়ান। অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও ইঙ্গিতময়তার মধ্য দিয়ে এই স্থাপনা শিল্পে রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি ভয়ানক চার্ট পাওয়া যাবে। এটি কোন মোটা দাগের ক্যালকুলেশন নয়, বরং ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির চেতনায় আলাদা একেকটি ইন্দ্রীয়জ উপলদ্ধির স্ফুরণবার্তা। বলা যায়, ঢালী আল মামুনের এই সব স্থাপনা শিল্পের গভীর মনস্তত্ত্ব, ইঙ্গিতময় আবাহন শিল্পী, দর্শক তথা সুধীমহলের অন্তর-বাহিরে, চিন্তা-চেতনার কিছু নান্দনিক ও নাটকীয় উপলদ্ধির সন্নিবেশ ঘটাবে।
×