ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তানজীনা ইয়াসমিন

শাশুড়িও একদিন বউ ছিলেন!

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১ এপ্রিল ২০১৬

শাশুড়িও একদিন বউ ছিলেন!

নারী দিবস চলে গেল, বছর ঘুরে আবারও আসবে যাবে। অনেকেই এসব দিবসগুলোকে নাগরিক আদিখ্যেতা মনে করলেও আমি ভিন্ন কোণ থেকে দেখার চেষ্টা করি। জীবনের নানা ঝামেলা, যাতনার তিতিবিরক্তিতে একেকটি দিন বিশেষ দিবস হিসেবে পালিত হলে অন্তত সেই দিনটি নির্দিষ্ট সেই ‘তাঁদের’ খুব বিশেষই হয়ে যায়। আনন্দের একটা উপাত্ত হয়ে আসে। গ্লাসের এই ভরাট অর্ধেকটার দিকে তাকালেই সব সাদা। তবে, নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ভাল হয় যদি প্রতি বছর একেকটা দিবসসংশ্লিষ্ট চিরকালীন দ্বন্দ্ব বা সমস্যা নির্মূল করবার প্রত্যয় নেয়া হয়। ফি বছর দিবস প্রতি একটা করে দ্বন্দ্ব মিটে যায়। নারী দিবস মাথায় রেখে চিরকালীন এক দ্বন্দ্ব মেটাবার প্রস্তাব করি। প্রায়ই বলতে শুনে এসেছি, মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু মেয়েরাই, ঘরে-বাইরে সর্বত্রই। বরাবর চাকরিজীবী নারী হিসেবে দুইয়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বোধোদয় হলো, ঘর শান্ত তো দুনিয়া শান্ত। ঘরে অশান্তি থাকলে বাইরের হাজারো প্রাপ্তিতেও চেহারায় মেকওভারের লেয়ার ফুঁড়ে ক্লেষ ভেসে উঠবেই। আর ঘরে শান্তি থাকলে, ঘর সত্যিই সবার জন্য ‘সুইট হোম’ হয়ে উঠলে বাইরের হাজার প্রতিকূলতাও মোকাবেলা করা যায়। অনেকেই ধুম করে মন্তব্য করেন, ‘আরে ফ্যামিলিকে ম্যানেজ করে চলে’– তো এতে দোষের কি হলো? নীতিবিবর্জন না করে পারিবারিক বন্ধনটা মজবুত রাখাতেই তো শান্তি। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এর সবচেয়ে চিরন্তন দ্বন্দ্বটা দিয়েই ব্যাখ্যা করি। ‘কিউ কি সাস ভি কাভি বাহু থি’- ‘ কারণ শাশুড়িও একদিন বউ ছিলেন’– বহুলশ্রুত এক হিন্দী সিরিয়ালের নাম। কোনদিন দেখা হয়নি বলে দুর্ভাগ্যক্রমে জানতে পারিনি এই নামকরণের উৎস কি ছিল। ‘শাশুড়ি একদিন বউ ছিলেন’ বলে আজ তাঁর আঙিনায় যেই বউটির নতুন পা পড়েছে তার অস্বস্তি, আনাড়িপনা, কাঠিন্যগুলো তাঁর অতি পরিচিত অনুভব বলে এই চৌকাঠ পেরুতে মায়াময় হাত বাড়িয়ে দেন? নাকি জীবনে শ্বশুরবাড়ির অনেক জ্বালা সইতে হয়েছে বলে বউয়ের ওপর সব ঝেড়ে এতটা জীবনের তুষের আগুনের তাপ জুড়াতে চান? অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও দ্বিতীয়টাই প্রচলিত! আমি আমার অতি প্রিয়জন মুরব্বিকেও দেখেছি তীব্র মায়াবতী রমনী ছেলের বউ এর ক্ষেত্রে কতটা অবিবেচক হয়ে যান। ছেলের বউয়ের নির্মমতার কথাও আজকাল অনেক শোনা যাচ্ছে, কম-বেশি, আগে-পরে; হিসেব হয়ত ইতিহাসের ঝাঁপি খুলে শত বছরের বাংলা সাহিত্য পড়লে বেশিই জানা যাবে। আলোচ্য হলো, এই দ্বন্দ্বের অব্যক্ত কারণটা কি? ছেলে বউ নিয়ে ঘুরতে যায়, অফিস ফিরেই বউয়ের খোঁজ- কেন? ছেলের বাবা তো কোনদিন নিমন্ত্রণ– অনুষ্ঠান ছাড়া কস্মিনকালেও আমাকে নিয়ে কোথাও যায়নি, অফিস থেকে সোজা ক্লাবে, চ্যাম্বারে, বন্ধুদের আড্ডায় কাটিয়ে সেই রাত করে ফেরা! কি আছে বউয়ের যা আমার ছিল না? না পারে পদের কিছু রাঁধতে, না পারে সংসার সামলাতে, না জানে আপ্যায়ন আতিথেয়তা! অন্যদিকে এই তীব্র প্রতিকূলতার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে কেউ প্রতিবাদী হয়ে হয়তো সাপে- নেউলে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেন, আলাদা বাড়িতে উঠে যান স্বামী নিয়ে। অন্যথায় দিনের পর দিন একা মানসিক চাপে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন কিংবা স্বামীর ওপর রাগ উগরে যান। বেশিরভাগ স্বামী বেচারার কিন্তু উভয়মুখী চাপে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দশা। বিদ্ধস্ত শরীর মন নিয়ে বাড়ি ফিরে একবার মায়ের নালিশ একবার বউয়ের নালিশের মাঝে ফুটবলের মতো দুই কোর্টে পাস খেতে খেতে সালিশে বসে আখের রস নিংড়ানো ছোবড়ার অবস্থা! এই অবস্থায় তার পক্ষে দাঁড়িপাল্লা মেপে কোন দিকে ঝুঁকতে হবে নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে মায়ের দিকে পাল্লা ঝোঁকে, শহরাঞ্চলে সচরাচর বৌয়ের। অসম কালের দুই মানুষ নিমেষেই নিজেদের জীবন-মরণ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। একটা বিষয় বিশেষ প্রণিধানযোগ্য, ‘বউ আমাদের ছেলের যোগ্য নয়, কিংবা, শ্বশুরবাড়ি আমার ক্লাসের নয়” খুব তাৎপর্যহীন ভাবনা। পণ্যের দাম তাই যেই দামে সে বিক্রি হয়- এটাই নির্জলা সত্যি, সে আপনি যতই মূল্যবান বা মূল্যহীন নিজেকে জেনে থাকুন। ইসমাইল–মার্চেন্ট প্রডাকশনের ১৯৬৩ সালের ছবি ‘ঞযব ঐড়ঁংবযড়ষফবৎ’ এ দেখেছিলাম আনাড়ি বউকে সুনিপুণা করতে দূরে ছেলের কর্মস্থলের বাড়িতে এসেছেন মা। সারাদিনের প্রশিক্ষণ শেষে ঘড়িতে চোখ গেলে শ্বাশুড়ির চোখ কপালে, “আরে আমার ছেলের ফেরার সময় হয়ে এসেছে, তুমি এখনও স্নান সেরে শাড়ি পাল্টাওনি? কি শিখিয়ে পাঠিয়েছে তোমাকে? আমার স্বামী ফেরার আগে স্নান সেরে শাড়ি পাল্টে চোখে কাজল পরে সুগন্ধি মেখে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। স্বামী ফিরলে, তা যত সময়মতোই ফিরুন, মিথ্যেমিথ্যি অভিমান করে বলতাম, ‘এতো দেরি করেছ কেন? হবে না— হবে না’ এইসব! আরে এই না করলে স্বামী কিসের মোহে জলদি বাড়ি ফিরবে?’ ডিশ এন্টেনার শুরুর যুগে ‘সনি গোল্ড’ চ্যানেলে দেখা এই ছবি কয়েকবার দেখেছি- শুধু এই মজার দৃশ্যটির জন্য। আপাতভাবে মনে হতে পারে মা ছেলের বউকে কি মায়া করে সব শেখাচ্ছেন! কিন্তু এই শেখা শেষ হয় না, তিনি সংসারের চাবিও বউকে তুলে দেবার ‘যোগ্য হয়েছে’ মনে করেন না। বারংবার সব শিখিয়ে সব কিছুতেই প্রমাণ করতে চাইতেন তিনিই শ্রেষ্ঠা এবং সমস্যা শুরু হয় তখনই। আর এই শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের অব্যক্ত কারণটা হলো অনিশ্চয়তা; সংসারে অপ্রয়োজনীয়, অপাঙ্ক্তেয় হয়ে যাওয়ার মর্মাœ্তকি আশঙ্কা। একটা সম্পর্কে যখন কে বড়– কে ছোট, হার-জিতের বিষয়টা চলে আসে, তখনই দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কেউই হারতে চায় না। একজন রিকশাওয়ালাকে যখন যাত্রী তার মনমতো ভাড়া না দিয়ে চড় কষিয়ে চলে যায় তখন একটু দূরে গিয়ে রিকশাওয়ালাটা অবশ্যই মুখখিস্তি করে গালি দেবে, নইলে দিনশেষে পরাজিত সে নিজের কাছে দাঁড়াবে কিভাবে? আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ছিল এমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় পড়ছি, পজিশনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দিনরাত জটিল সমীকরণে ডুবে থাকার মাঝখানে বিয়ে হয়ে গেল। ২ বছর পর বড় ছেলে এলো ৩য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার সময়। বাবার বাড়িতে আক্ষরিক অর্থেই চা বানানোও শিখেনি। কি এক অকুল পাথার! এই সংসার থেকে পালিয়ে কিভাবে বাঁচা যায় তাই সময়-অসময়ে ভাবতাম। ঘরকন্নায় শুরু থেকেই অক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে বসেই আছি- উত্তরণের উপায়ই নেই! কোনটা শিখব? পদার্থবিদ্যা, শিশুপালন– নাকি সংসার? অনেক সংসারেই ঘরপোড়ায় আলুপোড়া দেবার ভূমিকাতেও থাকে গৃহকর্মী, সুযোগমতন কূটনামি ফেরি করে ‘ভাল হওয়া’ বউ-শাশুড়ির সংসারে তাদের একটা অপরিহার্য কাজ, অথবা নিকটাত্মীয়া কেউ। কিভাবে যেন প্রতিপালকই পথ বাতলে দিলেন, একেবারে নিঃশর্ত অনুরোধ করলাম শাশুড়ি-মায়ের কাছে যে সংসার তাঁরই থাক, আপাতত আমি এর গুরুভার নিতে অক্ষম। পড়ালেখা শেষ করে থিতু হয়ে নেই। তিনি সানন্দেই সংসার সামলে গেলেন, গৃহকর্মী ছিল ঘরের, বাচ্চাদের। তাঁর কাজে সাহায্য করেছে। পড়ালেখা শেষ করে কর্মজীবন শুরু“ করি, জিজ্ঞেস করে যাই ‘মা কিছু লাগবে কিনা?’, দিন শেষে ফিরে ঘরের গল্প শুনি, আমার দুই ছেলের গল্পই বেশি- নিজেও অফিসের গল্প করি। নিশ্চিন্তে ক্যারিয়ার গড়েছি, বাচ্চাদের পড়ালেখা দেখেছি, ঘরের বা শ্বশুর-শাশুড়ির কি লাগবে, কাকে কবে নিমন্ত্রণ করবেন - কি লাগবে সামলেছি। তিনি সংসার, নাতিদের খাওয়া নাওয়া স্বাধীনভাবে নিজে যেমন ভাল বুঝেছেন করেছেন। আমি চিরকালীন এই সম্পর্কটায় হারজিত ঢুকতে দেইনি, তাই তাঁকে আমি মা-পাখির মতনই পেয়েছিলাম। তিনিও ছেলের বাড়ি না- নিজের সংসারেই আজীবন বাস করেছেন। এ থেকেই জেনেছি, কোন সম্পর্ককেই কখনোই হারজিতে ঠেলে দিতে হয় না। তাতে বিজয়ী- বিজিত দু’জনেরই হার অবধারিত। মানুষের মন কোন খেলা নয় যেখানে হারজিত থাকবে। দোকানিদের লেনদেনের সেই শেষ বাক্য ‘আচ্ছা নিন, আপনারটা কথাও থাকল, আমারটাও!’ এমন দু’পক্ষের সন্তুষ্টিতেই কেবল একটা সম্পর্ক সুস্থ, প্রাণবন্ত হয়ে বেঁচে থাকে।
×