ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কপিলের বংশধরদের হারিয়ে তিরাশির শোধ লয়েড-বাহিনীর

প্রকাশিত: ১৮:৫০, ১ এপ্রিল ২০১৬

কপিলের বংশধরদের হারিয়ে তিরাশির শোধ লয়েড-বাহিনীর

অনলাইন ডেস্ক ॥ গোটা দেশকে বিহ্বল করে সেমিফাইনালে হারানোর ট্র্যাডিশন বজায় রাখল ওয়াংখেড়ে। শোকের হ্যাটট্রিক হল আরব সাগরের পারে। সাতাশির বিশ্বকাপ, নেহরু কাপ এবং এ বার টি-টোয়েন্টি সেমিফাইনাল! কিন্তু এ বারের প্রতিপক্ষ যেহেতু ওয়েস্ট ইন্ডিজ, তাদের চরম অপ্রত্যাশিত সাত উইকেটে জয়ের মধ্যে অন্য একটা ঐতিহাসিক প্যাটার্নও ফুটে উঠছে। তেত্রিশ বছর আগের দার্শনিক বদলার! লর্ডসে ৬০ ওভারে ১৮৩ করেও বিশ্বকাপ ফাইনাল অবিশ্বাস্য জিতে গিয়েছিল ভারত। ওয়াংখেড়েতে ২০ ওভারে ১৯২ করে একই রকম অপ্রত্যাশিত ভাবে গোটা ভারতকে নিষ্পন্দ চেহারায় এনে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল তারা। উনিশশো তিরাশি আর দু’হাজার ষোলো— কী অদ্ভুত ভাবে যে যুক্ত হয়ে গেল একই বন্ধনীতে। সে দিন ভিভ মারতে শুরু করার পর মনে হয়েছিল লর্ডসে খেলা শেষ হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। কপিলদের স্ত্রীরা হতাশায় হোটেলে ফিরে গিয়েছিলেন। আজও ক্রিস গেইল দ্বিতীয় ওভারে ফিরে যাওয়ার পর হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান স্ত্রীরাও কেউ কেউ তা-ই করেছেন। ধোনিদের জয় তখন শুধুই নিয়মরক্ষার অপেক্ষা। অথচ সেটাই কেমন অত্যাশ্চর্য ভাবে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল! গোটা টুর্নামেন্ট টিমকে একা টানছিলেন বিরাট কোহালি। আজও মাত্র ৪৭ বলে অপরাজিত ৮৯ করে গেলেন। একটা উইকেট তুললেন। কিন্তু তাঁর প্রতিভাও ভারতকে রক্ষা করতে অসমর্থ। লেন্ডল সিমন্স। জনসন চার্লস। আন্দ্রে রাসেল। এঁদের কাউকে হিসেবের মধ্যেই ধরেনি ভারত। তাঁরাই কি না ছত্রখান করে দিলেন ভারতীয় বোলিংকে। সাতাশির বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে গ্রাহাম গুচ সতেরোটা সুইপ মেরেছিলেন ভারতীয় বোলারদের। আজও তার জন্য কপিলকে শুনতে হয়, কেন তিনি অনে এক জন ফিল্ডার সে দিন বাড়াননি? ধোনিকেও কুড়ি বছর পরেও নির্ঘাত শুনে যেতে হবে, কেন অশ্বিনকে মাত্র দু’ওভার বল করিয়ে তিনি বিরাটের মতো অনিয়মিত বোলারকে দিয়ে শেষ ওভারে সুযোগ নিলেন? স্পেশ্যালিস্ট স্পিনার যদি শেষ ওভারে বাঁচাতে না পারেন, তা হলে কি অনিয়মিত বোলার পারবে? কাঙ্গা লিগে যে শ্রেণিকে বলা হয় ‘চুম্পি চুম্পি’। কখনও আছে, কখনও নেই। শেষ ওভারে জেতার জন্য ক্যারিবীয়দের দরকার ছিল মাত্র ৮ রান। তিন বলে ১ রান হওয়ার পর একটা ছক্কা আর চারে ভারতের বিশ্বকাপ অভিযান সাঙ্গ করে দিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা। ধোনি আশ্চর্য ভাবে রায়নাকে দিয়েও বল করালেন না। যাঁকে বাকি টুর্নামেন্টে নিয়মিত ব্যবহার করেছেন। ধোনি যে এ বারের বিশ্বকাপে নানা সময় নানান ভ্রমাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়ে বেঁচে গিয়েছেন, তা আনন্দবাজার-সহ ভারতীয় মিডিয়ায় বারবার আলোকিত হয়েছে। কলকাতায় টার্নিং পিচে অশ্বিনের পুরো ওভার শেষ করাননি। একটা ম্যাচে নিজে না গিয়ে হার্দিককে আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। যুবরাজকে গোটা টুর্নামেন্টে মাত্র ৩ ওভার দিয়েছেন। বিরাটের নৈপুণ্য টিমকে বাঁচাচ্ছিল বারবার। এ দিন দেখা গেল, পোস্তায় ভেঙে পড়া ব্রিজের মতোই টিমের চুন, বালি, সিমেন্টে হালকা ঘাটতি ছিল। কলকাতার অশৌচের বিষণ্ণ মেজাজের সঙ্গে মিলে গেল ভারতীয় ক্রিকেটের রং! শোকের শহরে ধোনিরা আর ফাইনাল খেলতে আসছেন না। কিন্তু ১৯২ করেও ম্যাচ রাখতে না পারার শোক বহু বছর ধরে শোকের ফ্লাইওভারের নীচে পিষে রাখবে ভারতীয় ক্রিকেটকে। যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসের ১০ ওভার চলছে, তখন স্কোর ৮৪-২। যত ভালই দেখাক, ভাবা যায়নি ক্রমাগত চার-ছয় মেরে তারা গতিটা রেখে যাবে। নেহরা ছাড়া প্রত্যেক বোলার গড়ে এগারো করে রান দিয়েছেন। ভারতীয় ইনিংসে যেখানে ছয় না আসায় ব্যাটসম্যানদের প্রচণ্ড দৌড়ে খুচরো রান নিতে হচ্ছিল, সেখানে এত শর্ট আর ব্যাটের ওপর বল যে বোলিং ইউনিট করবে, ভাবাই যায়নি। ধোনি বললেন, শিশিরের জন্য। কিন্তু শিশিরও কি কুড়িটা বাউন্ডারি আর এগারোটা ওভার বাউন্ডারির ব্যাখ্যা? বরঞ্চ ১৪৬ রান চার-ছয়ে খাওয়ার পর প্রশ্ন উঠতে পারে, কাল শিশিরের মধ্যে কেন ভারতীয় বোলারদের প্র্যাকটিস করানো হয়নি? নাকি তারা কোহালির ফর্মে অহংকারী হয়ে একটু বেশি আত্মতুষ্ট হয়ে পড়েছিল? টস হারা থেকে শুরু করে ভারত কিছু ভাগ্যজনিত গ্রহফেরেও ভুগল। অনেক ক্যাচ অল্পের জন্য হাতে এল না। মিসহিট বাউন্ডারিতে চলে গেল। আর ম্যাচ জেতানো মানুষ লেন্ডল সিমন্স দু’বার আউট হয়েও নো বলের জন্য বেঁচে গেলেন। এক বার অশ্বিন, এক বার হার্দিকের বলে তিনি আউট ছিলেন। অথচ দু’বারই আবিষ্কার হল নো বল। ইনিংসের শুরুর দিকে সিমন্স আউট হয়ে গেলে তাজ বেঙ্গলের ঘরের চাবি ধোনিদেরই নেওয়ার কথা। কিন্তু তার আগে বলা যাক, রান তাড়া করার চ্যালেঞ্জে মুখ্য ব্যাটসম্যান দুটো নো বলে আউট থেকে বেঁচেছে, এমন ঘটনা মনে করতে পারছি না। তার আগে কোহালিও ভাগ্যের যথেষ্ট আশ্রয় পেয়েছেন। যা একমাত্র রজনীকান্তের ছবিতে হয়! হিরোকে ভিলেন পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে এক মিনিটে তিনটে গুলি করে, যার একটাও হিরোর গায়ে লাগে না। বরং সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ভিলেনকে বলে, এ বার তোকে এত জোরে মারব যে গুগলও খুঁজে পাবে না। দক্ষিণের রুপোলি পর্দায় যা হয়, ক্রিকেট মাঠে সম্ভব, কে জানত! ওয়েস্ট ইন্ডিজ দু’বলের মধ্যে তিন বার রান আউট করার সুযোগ পেয়েও ছাড়ল। সেটা আবার কাকে, না বিরাট কোহালিকে! একটা সময় ভারতীয় দল আক্ষেপ করত, আমাদের কিপার আর কারও ক্যাচ ফেলে না— ভিভেরটা ছাড়া। তিরাশির ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে কিরমানি তিন বার ভিভকে ছেড়েছিলেন। টিম এত চটে যায় যে, ফেরার ফ্লাইটে যখন বিমানসেবিকা বাধ্যতামূলক অ্যানাউন্সমেন্ট করছেন, ‘ইন কেস অব ফল ইন ক্যাবিন প্রেশার, অক্সিজেন মাস্ক উড ড্রপ ডাউন অটোমেটিক্যালি’— তখন কেউ কেউ বলছিল, ‘‘ওরে কিরি, তুই অক্সিজেনের মুখোশটাও ধরতে পারবি তো?’’ ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেন তেত্রিশ বছর আগের সেই বদান্যতা তাদের তখনকার ক্যাপ্টেন এবং এখনকার মুখ্য নির্বাচক ক্লাইভ লয়েডের সামনে ওয়াংখেড়েতে শোধ করে গেল! এই প্যারাগ্রাফটা লিখে রাখা ছিল ভারতীয় ইনিংসের শেষে। কে জানত, ম্যাচের শেষে নতুন করে লিখতে হবে যে ভারত নয়, বদলা নিয়ে গেল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শোনা যায় তিরাশির ফাইনালে জিততে না পারার রাতে অ্যান্টিগা আর বার্বেডোজের অনেক বাড়িতে লোকে মুখে জল তোলেনি। আজ রাত্তিরে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, ক’টা বাড়িতে এক জিনিস ঘটল, সেটা হয়তো পরে কোনও মার্কেট সার্ভে আমাদের জানাবে। সচিন তেন্ডুলকর এসেছিলেন অম্বানীদের বক্সে খেলা দেখতে। দেখলেন কোহালিকে ঘিরে কী প্রচণ্ড গর্জন। দেখলেন মুম্বই তাঁর উত্তরাধিকারকে কেমন সাগ্রহে বরণ করে নিয়েছে। আর দেখলেন, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে তাঁদের লেন্ডল সিমন্স, যিনি কি না মূল দলেই ছিলেন না, সদ্য ভারতে এসেছেন, তিনি কী ভাবে স্তব্ধ করে দিলেন ওয়াংখেড়ের জনজীবন। একটা গোটা স্টেডিয়াম মাত্র আধ ঘণ্টায় উৎসব থেকে অশৌচে রূপান্তরিত হয়ে গেল। এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, না তিরাশি নয়, সাতাশির সঙ্গে বেশি মিল। সে বার ম্যাচের ঠিক আগে মূল দলে থাকা বেঙ্গসরকর পেটের সংক্রমণে খেলতে পারেননি। এখানে পারলেন না যুবরাজ। অবশ্য অতীতের কোন হারের প্রোটোটাইপ, সেটা পরে ঠিক হবে। আপাতত যা দাঁড়াল, মহেন্দ্র বাবুর বিখ্যাত ট্রফি-ভাগ্য আর কাজ করছে না! জগমোহন ডালমিয়ার বহু বছরের ইচ্ছে ছিল, কলকাতায় বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলাবেন ভারতকে। যা হবে চূড়ান্ত দর্শক আকর্ষণ। ফাইনালের ফাইনাল। সাতাশিতে পারেননি। তার পর ঊননব্বইয়ের নেহরু কাপেও একই দশা। নেহরু কাপ চরিত্রে বিশ্বকাপ সমতুল্যই ছিল। সেখানেও ভারত কলকাতা পৌঁছতে পারেনি। সেমিফাইনাল হেরে যায়। ডালমিয়ার উত্তরসূরিও দেখা গেল ওয়াংখেড়ের গেরো পার করার ব্যাপারে অসমর্থ। কলকাতায় ভারতকে বিশ্ব ফাইনালে দেখা তাই তিন দশক পরেও চাপা পড়ে থাকা এক শোকগাথা। যার ভাগ্য ঊনত্রিশ বছর বাদেও আর বদলায় না। সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×