ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিপুল ভোটারের উপস্থিতিতে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হলেও গুটি কয়েক এলাকায় সংঘাত দমনে ইসির দক্ষতা নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে

ইউপি ভোটে সহিংসতা প্রাণহানিতে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২ এপ্রিল ২০১৬

ইউপি ভোটে সহিংসতা প্রাণহানিতে জনমনে নেতিবাচক প্রভাব

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইউপি নির্বাচনে কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায় প্রভাব পড়ছে গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর। বিশেষ নির্বাচনে প্রাণহানির মতো ঘটনায় জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। প্রশ্ন উঠছে গোটা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও। অথচ দুটি নির্বাচনের সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সহিংসতার এসব ঘটনা ঘটছে গুটিকয়েক এলাকায়। বাদবাকি ভোটগ্রহণ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হচ্ছে। ভোটার উপস্থিতিও জানান দেয় ভোট হচ্ছে উৎসবমুখর পরিবেশে। কিন্তু দু-একটি সহিংসতার ঘটনায় জন্ম দিয়েছে তীব্র সমালোচনার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনে এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা দেয়া আছে। ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগ করলে প্রাণহানির মতো ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিএনপি হলেও সংঘাত-সহিংসতা হচ্ছে মূলত আওয়মী লীগ ও তার বিদ্রোহী সমর্থকদের মধ্যে। দল থেকে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর থেকেই মূলত এ সংঘাতের সূচনা হয়েছে। মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে অনেক প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এভাবে মনোনয়ন পাওয়া আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীর সঙ্গে জনসম্পৃক্তা নেই। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তারা নির্বাচনে জয়লাভ করার চেষ্টা করছে। এর বাইরে দীর্ঘদিন ধরে যারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই এবার মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। এসব প্রার্থীর বেশিরভাগ বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিয়েছেন। জনগণের সমর্থনও অনেকটা তাদের পক্ষেই কাজ করছে আগের প্রভাব থেকে। এছাড়া বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রথম থেকে তারা অনেকটা কোণঠাসা। ফলে এ সুযোগটা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরাও কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে বিএনপি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থন যোগাচ্ছে। এ কারণেই সহিংসতার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথম দফার চেয়ে দ্বিতীয় এবং পরবর্তী দফায়ও প্রতি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সে তুলনায় বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে অনেক কম। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীই বিদ্রোহী প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় সহিংসতা রোধ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে। আওয়ামী লীগের দলীয় ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে সহিংসতার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পক্ষ থেকে আগেই আভাস দেয়া হয়েছিল। গত ৩ মার্চ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনরীর সঙ্গে ইসির বৈঠকে এ আভাস দেয়া হয়। ওই বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ইসিকে সতর্ক করা হয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিষয়ে। তারা বৈঠকে উল্লেখ করেন, বেশিরভাগ জায়গায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। মূলত এসব বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যেই সংঘাতের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। নির্বাচনের ফলফলেও বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। প্রথম দফায় নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশি নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। এর বাইরে মনোনয়ন ভুলের কারণে অনেক ইউপিতে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থীও নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন। দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনের ফলে একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। দ্বিতীয় দফায় বিএনপি যেখানে মোট ৮০টির মতো ইউপিতে জয়লাভ করেছে সেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতেছে ১শ’র বেশি ইউপিতে। এরা মূলত আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিত। এছাড়া দ্বিতীয় দফায় সাতক্ষীরা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামায়াতের কয়েকজন প্রার্থী জয়লাভ করেছে। এতে বোঝা যায়, গুটিকয়েক এলাকায় সহিংসতা ঘটলেও বেশিরভাগ এলাকায় নির্বাচন হয়েছে সুষ্ঠু। আবার দলীয় নির্বাচন হওয়ার কারণে সহিংসতার প্রচার বেশিমাত্রায় হচ্ছে। বিশেষ করে বিরোধী পক্ষ থেকে প্রথম থেকেই নির্বাচনে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করা হচ্ছে। জানা গেছে, ইসিকে চাপের মুখে রেখে তারা এর মাধ্যমে ফায়দা নিতে চেয়েছে। তার পরও বেশিরভাগ এলাকায় বিএনপি কোণঠানা হওয়ার কারণে তাদের প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে প্রকাশ্যে আসছে না। ফলে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে কোন কাজ না হওয়ায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে সমর্থন যোগাচ্ছে। এদিকে, কমিশন সহিংসতা রোধে যথেষ্ট ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। নির্বাচনে শুরু থেকে এ কমিশন বলে আসছে, যে কোন অনিয়মের বিষয়ে কমিশন কঠোর। কাজের ক্ষেত্রে তার স্বাক্ষর রাখতে পারছে না। সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে ইউপি নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে কমিশনকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। দু-একটি ঘটনায় শুধু দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যাখ্যা চেয়েই কমিশন সন্তুষ্ট হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এছাড়াও ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েই দায় এড়িয়েছে। কিন্তু কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা আর কখনও যাচাই করা হয়নি। গত পৌরসভা নির্বাচনে অনিয়মের অনেট ঘটনায় কমিশনকে দায় এড়াতে দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে থেকে এসব বিক্ষিপ্ত ঘটনার বিষয়ে ব্যবস্থা নিলে কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থা বৃদ্ধি পেত। এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তিও রোধ করা যেত। অথচ কমিশন সেদিকে পা বাড়ায়নি। কারও বিরুদ্ধে নেয়নি কোন কঠোর ব্যবস্থা। গত ২২ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে সারাদেশে ছয় দফার ইউপি নির্বাচন। প্রথম দফায় সারাদেশে ৭২১ ইউপিতে ভোটগ্রহণ করা হয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভোটগ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগে ৬৫ ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। এমনকি খোদ বিএনপির পক্ষ থেকে ৫০ কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে। অথচ প্রথম দফায় ভোটগ্রহণ করা হয় সাত হাজার ভোটকেন্দ্রে। কিন্তু নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতার কারণে প্রায় ১০ জনের প্রাণহানি ঘটে। আর এতে গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। এ ঘটনায় কমিশন দায়িত্ব এড়ালে প্রায় একবাক্যে সবাই বলছে, সহিংসতার দায় কমিশন এড়াতে পারে না। সহিংসতা এড়াতে তাদের সব ধরনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নির্বাচন শেষে ঝালকাঠির একটি কেন্দ্রে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ছয়জন নিহত হয়। অথচ আইন অনুযায়ী ভোট শেষ হয়ে গেলে কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও প্রার্থীর এজেন্ট ছাড়া আশপাশে কারও থাকার কথা নয়। এছাড়া গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির মধ্যে থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। প্রথম দফায় নির্বাচনের আগের রাতে সাতক্ষীরার ১৪টি কেন্দ্রে ভোটের আগেই ব্যালট পেপারে সিল মারার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ওই কেন্দ্রগুলোর ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়। যারা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে তারা পুলিশের পোশাকে ছিল। এছাড়া ভোট গ্রহণের আগের রাতেই প্রতি কেন্দ্রে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা থাকে। এ কারণে বাইরের কারও কেন্দ্রে ঢুকে ব্যালট পেপারে সিল মারার কথা নয়। অথচ এ ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত কঠোর কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি। নির্বাচনের জন্য প্রণীত সরকারী কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯১ অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় কোন সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হলে কমিশন তাকে সর্বোচ্চ দুই মাসের জন্য বরখাস্ত করতে পারবে। ঘটনার আট দিন পর সাতক্ষীরার এসপি ও পুলিশের পাঁচ কর্মকর্তাকে কমিশনে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের ভর্ৎসনা করা হয়। একই সঙ্গে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ১৫ দিনের মধ্যে গ্রেফতার করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জাতীয় ঘটনায় ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া গেলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় না। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনী চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, প্রথম দফার চেয়ে কম এলাকায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বাকি এলাকায় নির্বাচন হয়েছে সুষ্ঠুই। এসব এলাকায় বিএনপি ও তাদের বিদ্রোহী, জাতীয় পার্টির এমনকি জামায়াতের মতো দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচনের আগে মাঠপর্যায়ে পরিস্থিতি জরিপ করে ব্যবস্থা নেয়া গেলে এ ধরনের ঘটনা এড়ানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বিতীয় দফায় যে গুটিকয়েক এলাকায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে তা ছয় হাজার ভোটকেন্দ্রের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। গেয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টের ভিত্তিতে আগেই এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেত। অথচ কঠোর পদক্ষেপের অভাবেই দ্বিতীয় দফায় ঝরে গেল আরও আটটি প্রাণ, যার মধ্যে একটি চতুর্থ শ্রেণীর শিশুও রয়েছে। আর এর প্রভাব এসে পড়েছে সার্বিক নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর। স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বৃহস্পতিবার স্বীকার করেছেন, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি সহিংস ঘটনা গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ম্লান করে দিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় ভোট হয়েছে ৪৭টি জেলায়। সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে হাতেগোনা কয়েকটি জেলায়, যা সহজেই এড়ানো যেত সময়মতো ব্যবস্থা নিলে। এর বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া না হলে পরবর্তীতে সহিংসতা এড়ানো কঠিন হবে।
×