ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পানের বরজের মজুর গোলাপী এখন কলেজে

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২ এপ্রিল ২০১৬

পানের বরজের মজুর গোলাপী এখন কলেজে

যাতায়াত ভাড়ার অভাবে প্রতিদিন ক্লাসে যাওয়া সম্ভব হয় না। শিক্ষাবর্ষের তিন মাস কেটে গেছে। একখানা বইও কেনা হয়নি। বাড়িতে বিদ্যুত নেই। চেয়ার-টেবিল নেই। নেই ভাল জামাকাপড়। এমনকি সংসারের খরচ জোটাতে বাবা-মায়ের সঙ্গে পানের বরজে দিনমজুরিও খাটতে হয়। এরপরও থেমে নেই গোলাপী রানী দাসের পথচলা। গলাচিপা ডিগ্রী কলেজের বিএ পাসকোর্সের শিক্ষার্থী গোলাপী লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হতে চায়। হতে চায় চাকরিজীবী। আর এ জন্য চলছে লড়াই। গোলাপী রানী দাসের বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার উত্তরপানপট্টি রেন্ডিতলা গ্রামে। বাবা গৌতম চন্দ্র দাসের দু’মেয়ের মধ্যে বড়। ছোট মেয়ে অন্তরা অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। গৌতম দাসের বাড়ির ভিটি ছাড়া নিজের কোন জমিজমা নেই। পেশায় কৃষি শ্রমিক। চল্লিশোর্ধ গৌতম চন্দ্র দাস জানান, তিনি মহাজনের পানের বরজে দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। মজুরি প্রতিদিন তিন শ’ টাকা। প্রতিদিন কাজ জোটে না। সপ্তাহে বড় জোর তিন-চারদিন কাজ থাকে। বছরের ৬-৭ মাস বেকার থাকতে হয়। যে কারণে স্ত্রী অনিতা রানীও পানের বরজে মাটি কাটা, বাঁধ দেয়াসহ নানা কাজ করেন। তাঁর কাজও অস্থায়ী। বছরে বড় জোর তিন-চার মাস কাজ থাকে। মজুরি প্রতিদিন এক- দেড়শ’ টাকা। কয়েকটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মাথা গোঁজার ঘর তুলেছেন। প্রতি সপ্তাহে তিন হাজার টাকার কিস্তি দিতে হয়। স্বামী-স্ত্রী মিলে যা আয় করেন তার পুরোটাই কিস্তি পরিশোধে চলে যায়। সংসারের এ করুণ অবস্থার মধ্যেও দু’মেয়ে গোলাপী আর অন্তরা লেখাপড়া ধরে রেখেছে। গোলাপী রানী দাস জানান, স্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর গত বছর এইচএসসি পাস করেছেন গলাচিপা ডিগ্রী কলেজ থেকে। অর্থাভাবে কোনদিন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ার সুযোগ হয়নি। ক্লাসে শিক্ষকদের দেয়া নোট ভরসা করেই পড়াশোনা করেছেন। এ বছর জানুয়ারি মাসে গলাচিপা ডিগ্রী কলেজে পাসকোর্সের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু ভর্তির পুরো টাকা এখনও দেয়া সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত একখানা বইও কেনা হয়নি। বাড়ি থেকে কলেজে যাতায়াতে ১২ কিলোমিটার পথ টমটম গাড়িতে যেতে হয়। ভাড়া লাগে ৬০ টাকা। প্রতিদিন সে টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয় না। তাই সপ্তাহে দু’দিন ক্লাস করেন। গোলাপী রানী আরও জানান, পড়াশোনা আর পথ খরচের জন্য বাড়ির পাশে পানের বরজে কাজ করেন। পানগাছ বেঁধে দেয়া, পান তোলা, পান সাজানো প্রভৃতি কাজ করতে হয়। সপ্তাহে এক-দেড় দিনের বেশি কাজ মেলে না। এতে এক-দেড়শ’ টাকা মজুরি মেলে। এ অর্থ দিয়ে দু’দিন কলেজ যাতায়াতের খরচ মেটানো যায়। বাকি কিছু থাকলে তা দিয়ে কাগজ-কলম কিনতে হয়। গোলাপী রানী দাস জানান, যত কষ্টই হোক, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চান। অনেক বড় হওয়ার ইচ্ছা তাঁর। অভাবী সংসারের বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে হতে চান চাকরিজীবী। বিশেষ করে সরকারী চাকরি। লেখাপড়া চালিয়ে নেয়ার লড়াই চালিয়ে যাবেনই। গোলাপী রানী দাসের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে নেই বিদ্যুত। আশপাশের বাড়ির অনেকে সোলার লাগিয়েছে। কিন্তু অর্থাভাবে তারা সোলার লাগাতে পারেনি। কেরোসিনের কুপিবাতি জ্বালিয়ে চলে পড়ালেখা। বেশি কেরোসিন পোড়ানোর সামর্থ্য নেই। আর নেই পড়ালেখা করার চেয়ার টেবিল। মাটির মেঝেতে পাটি বিছিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। নেই ভাল জামাকাপড়। তবে লেখাপড়ার প্রতি অদম্য আগ্রহ বাবা-মাকেও সাহসী করে তুলেছে। তাঁরাও চান মেয়ে গোলাপী আরও এগিয়ে যাক। নিজের পায়ে দাঁড়াক। গোলাপী রানী দাসের অদম্য লড়াইয়ের প্রশংসা করে গলাচিপা ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ ফোরকান কবীর জানান, গোলাপী যাতে উপবৃত্তি পায়, তিনি সে ব্যবস্থা করবেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি কিছু বই দেবেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সহযোগিতাও দেবেন। Ñশংকর লাল দাশ, গলাচিপা থেকে
×