ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সৌদি আরবে নারীকর্মীর সঙ্গে স্বামীকেও কর্মী হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৯ মে ২০১৬

সৌদি আরবে নারীকর্মীর সঙ্গে স্বামীকেও কর্মী হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব

ফিরোজ মান্না ॥ সৌদি কর্তৃপক্ষ নারী কর্মীর সঙ্গে স্বামীকেও কর্মী হিসেবে নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। সম্প্রতি সৌদি প্রতিনিধি দল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এমন প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রাজি হলেও এখন দেশটিতে নারী কর্মীরাই যেতে আগ্রহী হচ্ছেন না। কারণ সৌদিতে নারী কর্মীদের ওপর নানাভাবে নিগ্রহ ও নির্যাতন চালানো হয়। তাদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার হাজারও অভিযোগ রয়েছে। এজন্য বেশ কয়েকটি দেশ সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্যে ভারত ও ফিলিপিন্স অনেক আগে থেকেই সৌদিতে নারী কর্মী পাঠাচ্ছে না। অভিবাসন নিয়ে কাজ করা ‘ন্যাশনাল এ্যালায়েন্স ফর মাইগ্রেশনস রাইটস বাংলাদেশ’ মনে করে, সৌদিতে নারী নির্যাতন ব্যাপকহারে বেড়েছে। সেখানে একজন নারী কর্মীকে শুধু গৃহস্থালির কাজই করতে হয় না, তাকে গৃহকর্তাসহ ওই বাড়ির যত পুরুষ আছে তাদের যৌনদাসী হিসেবেও ব্যবহৃত হতে হয়। যদি এ কাজে তারা রাজি না হন তাহলে তাদের ওপর চলে শারীরিক নির্যাতন। দীর্ঘদিন ধরে সৌদিতে এমন অবস্থা চলে এলেও প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোন প্রতিকার করতে পারেনি। এসব ঘটনা রোধ করার দাবি তুলে আসছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এ দাবির প্রেক্ষিতে কোন নারী কর্মী যাতে নির্যাতনের শিকার না হন তার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তবে এটা কতটা সফল হবে তা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যেই ভিন্নমত রয়েছে। যেসব দেশ বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী নিয়োগ করে সেসব দেশ যদি এমন প্রস্তাবে রাজি থাকে তাহলেই এ উদ্যোগ সফল হবে। তা না হলে উদ্যোগটি আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা। একই রকমের কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাসনিম সিদ্দিকী। বিদেশের মাটিতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী কর্মী কাজ করলেও তাদের সমস্যা এবং সহযোগিতার জন্য নেই কোন শেল্টার হোম, দ্রুত সহযোগিতা পাওয়ার জন্য নেই হটলাইন। অনেক দেশেই নারী কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হয়ে সহযোগিতা চাইলেও পাচ্ছেন না। নারী কর্মীদের তাৎক্ষণিক সহযোগিতার জন্য সরকারের উচিত দ্রুত হটলাইন এবং শেল্টার হোম খোলার উদ্যোগ নেয়া। কারণ বিদেশে নারী কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, সেই সঙ্গে প্রবাসে নারী কর্মীর সমস্যাও বাড়ছে। এদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে গৃহকর্মী নেয়ার জন্য চুক্তি হয়। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের সময় সৌদি সরকার দুই লাখের বেশি নারী কর্মীর চাহিদা জানায়। বাংলাদেশ থেকে মাসে দশ হাজার করে নারী কর্মী নেয়ার কথা বলা হয়। অথচ ২০১৫ সালের হিসাবে মাত্র ২০ হাজার ৯শ’ ৫২ নারী সৌদি আরবে গেছেন। ২০১৬ সালে সৌদি আরবে কোন নারী কর্মী যাননি। সৌদি সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশকে জানিয়েছে, তাদের কছে এখন দুই লাখ নারীর জন্য ভিসা প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশী নারীদের সৌদি আরবে যাওয়ার আগ্রহ খুবই কম। চুক্তির এক বছরে চাহিদার দশ ভাগের এক ভাগ নারী বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে গেছেন। কাজ করতে যাওয়ার অল্প দিনের মধ্যে আবার নারীদের ফেরত আসার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় নারী কর্মীর পাশাপাশি তার স্বামী বা নিকটাত্মীয়ও সঙ্গে যেতে পারবেন। এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নোটিস দিয়েছে। এরপরও কোন নারী কর্মী সৌদি যেতে আগ্রহী হননি। ২০১৫ সালে যারা সৌদি আরব গেছেন তাদের মধ্যে থেকেও বেশকিছু নারী দেশে ফিরে এসেছেন। ঋণ করে সৌদিতে কাজে গিয়ে এক মাস থেকেই ফেরত আসা একজন বলছিলেন তার স্বপ্নভঙ্গের কথা। অনেক নারী কর্মী দেশে ফিরে বলেন, ‘দশ পনেরো দিন ভালই থাকা যায়। এরপর থেকেই চলে নানা নির্যাতন। বাড়িতে ফোন করতে দেয় না, বাড়ির বাইরেও যাইতে দেয় না। সারাদিন কাজকর্ম করার পর রাতে ঘুমাইতে যাব তার আগে কাপড় ইস্ত্রি করা, ওই সময় উনি (বাড়ির মালিক) ঘরে গিয়া ডিস্টার্ব করে। রুমের দরজা খোলা রেখে ঘুমাইতে হয়। যখন খুশি বাড়ির মালিক বা তার ছেলেরা ঘরে ঢুকে যৌন হয়রানি করে।’ সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে গৃহকর্মী হিসেবে মহিলা কর্মীদের নিয়োগ দেয়ার চুক্তি হয়েছে। সৌদি আরব প্রতি বছর এক লাখ ২০ হাজার গৃহকর্মী নিয়োগ করবে। এর মধ্যে নারী কর্মীর সংখ্যাই বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে নারী কর্মীদের নিগ্রহ হওয়ার অনেক নজির রয়েছে। এটা যাতে না ঘটে তার জন্য সঙ্গে যদি স্বামী থাকেন তাহলে মহিলা কর্মীরা অনেকাংশে নিরাপদ হবেন। তাদের সন্তান থাকলেও সেখানে নিয়ে যেতে পারবেন। এমন একটি প্রস্তাব এর আগে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দিয়েছিল। এখন জনশক্তি রফতানিকারক দেশগুলো এ প্রস্তাব মানবে কী মানবে না, সেটা অনিশ্চিত। তবু নারী কর্মীদের নিরাপদ রাখার জন্য এ উদ্যোগ হাতে নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয় নারী কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি চিন্তা করছে। শুধু গৃহকর্মী হিসেবে নয়, নার্স হিসেবেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারীরা নিয়োগ পাচ্ছেন। তাদের বেলাও একই রকম প্রস্তাব রাখবে বলে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে সৌদি আরব মন্ত্রণালয়ের ওই প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। অন্যদিকে, নারী কর্মীদের নিরাপদ রাখার জন্য বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন দাবি তুলেছে। তারা বলেছে, বিদেশে নারী কর্মীরা অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন। নারী কর্মীরা যাতে নির্যাতনের শিকার না হন তার জন্য কর্মী আমদানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি আগে নিশ্চিত করতে হবে। এটা করতে না পারলে বহু নারী কর্মীকে তাদের সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরতে হবে। সংগঠনগুলো মন্ত্রণালয়কে একটি পরামর্শও দিয়েছে। যদি কোন নারী কর্মী বিদেশ যান সঙ্গে তার স্বামীকেও কর্মী হিসেবে পাঠানো যেতে পারে। যার স্বামী নেই এমন কর্মীর ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে কোন অসুবিধা হলে দূতাবাসসহ দেশে অত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
×