ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

উদ্ভট উটের পিঠে কি চলেছে স্বদেশ?

প্রকাশিত: ০৬:২২, ৯ মে ২০১৬

উদ্ভট উটের পিঠে কি  চলেছে স্বদেশ?

(গতকালের পর) ॥ চার ॥ এবার আসা যাক মুক্তমনাদের খুনের ব্যাপারে। এখন তাদের ব্র্যান্ডিং করা হয়েছে ‘ব্লগার’ হিসেবে। অন্তর্জালে যারা লেখালেখি করেন না তারাও ব্লগার। এই ব্র্যান্ডিং করেছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। তাদের নেতা হাটহাজারীর জনাব আহমদ শফি জামায়াতে ইসলাম ও বিএনপির সাহায্যে ঢাকা দখলে প্রস্তুতি নেন। প্রস্তুতির প্রথম পর্যায়ে তারা অধ্যাপক অজয় রায়, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার কবির ও আমাকে মুরতাদ ঘোষণা করে। ইকবাল ধর্ম নিয়ে একটি অক্ষরও লেখেননি, আলোচনাও করেননি। তিনি মুরতাদ হন কিভাবে? বা অধ্যাপক অজয় রায়? তারপর তারা তাদের ভাষায় ‘ব্লগার’দের নাস্তিক ঘোষণা করেন। আমাদের মুরতাদ ঘোষণা করে তারা যতটা না সফল হয়েছিলেন তার চেয়ে সফল হন ‘ব্লগার’দের নাস্তিক ঘোষণা করে। এবং শাহবাগ আন্দোলন চলাকালেই খুন হন রাজিব। সেই থেকে মুক্তমনাদের হত্যার বিষয়টি জোরদার হয়। কবি শামসুর রাহমানকে হত্যা প্রচেষ্টার মাধ্যমে খুনের মহড়া শুরু হয়েছিল। এতে বোঝা যায় ‘ব্লগার’ বা ‘নাস্তিক-মুরতাদ’ মূল বিষয় নয়। বিষয় হচ্ছে যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বা ব্যবসার বিপক্ষে, যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের, তাদের ঘরে ঢোকানোই মূল বিষয়। শাহবাগ আন্দোলনের সময় কেন হেফাজতী বা হেজাবিরা বেছে নিয়েছিল হত্যার জন্য? কারণ, শাহবাগ ছিল মূলত তরুণদের আন্দোলন, বহুদিন পর মুক্তিযুদ্ধের তরুণরা একত্রিত হয়েছিলেন যারা ভোট দিয়েছিলেন বর্তমান সরকারকে। শাহবাগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে কী হতো তা বুঝেছিলেন হেফাজতী নেতারা। তাই তারা মরিয়া হয়ে ৫ মে তাদের ভাষায় ঢাকা অবরোধ করেন, আমাদের ভাষায় ঢাকা আক্রমণ করেন। খালেদা-এরশাদ-জামায়াতী নেতারা ভেবেছিলেন, ঢাকার পতন আসন্ন। তাই তারা কোরান থেকে গাড়িÑ সব পোড়ানো শুরু করেছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তার নেতৃত্বে রক্তপাতহীন এক অভিযানের মাধ্যমে ঢাকা মুক্ত করে পুলিশ বাহিনী। পুলিশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে সফলতম অভিযান। পৃথিবীর ইতিহাসেও দেখা যায়নি দাঙ্গাবাজদের এত বৃহৎ সমাবেশ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে রক্তপাতহীনভাবে সম্পন্ন করার। এই হুকুম নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন। এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সমর্থন করেছিলেন। দলের সাধারণ সম্পাদকের সমর্থন এবং প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া এ কাজ করার বুকের পাটা কোন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরই হবে না। এরপর আমরা দেখেছিলাম হেফাজতীদের কান্নাকাটি। কোথায় ঢাকা অভিযান, তারা তখন হাটহাজারীতে লুকোতে পারলে বাঁচে। এ অভিজ্ঞতা বলে, যে যেই ভাষা বোঝে তাদের সঙ্গে সে ভাষায়ই কথা বলতে হয়। হেফাজত বলুন, বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন বলুন সবার মাতৃদল জামায়াতে ইসলামী। তাদের ট্রেডমার্ক রগকাটা। এখন যে সব খুন হচ্ছে তারা কৌশলটাকে আপগ্রেড করেছে, চাপাতি দ্বারা ঘাড়ে কোপ। রাজিব থেকে হুমায়ুন আজাদ, দীপন থেকে অধ্যাপক রেজাউল করিমÑ সবাইকে একই কায়দায় খুন করা হয়েছে। অর্থাৎ যে নামেই তারা কাজ করুক না কেন মূলত তারা একই বৃহৎ সংগঠনের বিভিন্ন ফ্যাকশন। হেফাজত এবং এরপর হেজাবিদের দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু, শুনেছি [শোনা কথায় গুরুত্ব নাও দিতে পারেন] রুলিং পার্টির এক অংশ দাবি তোলে ড. আলমগীরের কারণে ‘ইসলামী ভোট’ বিনষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশে কোন মন্ত্রীর বুকের পাটা আছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া কিছু করার? এই ‘ইসলামী’ ভোট সংগ্রহের জন্য সরকার নমনীয় মনোভাব দেখায় হেফাজতীদের প্রতি। কিন্তু কী লাভ হয়েছে তাতে? প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পিতার যে দর্শন, এখন তারা তাও আক্রমণ করছে। এই নমনীয়তার কারণে, আবার খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবার বাংলাদেশকে কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, এই সব হত্যাকা- ঘটানোর কারণ যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও বিএনপি-জামায়াত ষড়যন্ত্র তখন এ মন্তব্য উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধ পক্ষকে ঘরে খেদানোর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সাল থেকে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে। এ কথা কোন যুক্তিতেই অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৯৭৫ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত [মাঝের ৫ বছর বাদে] দেশ শাসন করেছে সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসররা। বিএনপির ইতিহাসেই দেখা যায় সামরিক গোয়েন্দারা কিভাবে বিএনপি গড়ে তুলেছিলেন। জামায়াতকেও সামরিক নেতারা সমর্থন করেছিলেন। তৎকালীন সামরিক বাহিনীর ক্ষমতায় ছিলেন পাকিস্তানে বিশ্বাসীরা। তাদের পুরো ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীরা ক্যান্টনমেন্টে বাঙালী সেনাদের আক্রমণ না করলে তারা পক্ষ বদল করতেন কিনা সন্দেহ। ব্যতিক্রম কিছু ছিলেন। থাকবেনই। মুক্তিযুদ্ধের পরও সামরিক প্রশিক্ষণে কেন ভারতকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। আজ কাকুল প্রশিক্ষিত সৈনিকরা নেই দেখে সামরিক বাহিনীর তরুণরা বাংলাদেশের সৈনিক হিসেবে কাজ করছেন যা আমাদের সবার কাম্য। ৪৫ বছরের ইতিহাসে ২৫-৩০ বছর কম নয়। এর মধ্যে পাকিস্তানী আদর্শ দৃঢ়ভাবে কয়েকটি জেনারেশনকে প্রভাবিত করেছে। মাদ্রাসাগুলো এতে ব্যাপকভাবে ভূমিকা রেখেছে। তাদের সহায়তা করেছে বিএনপি-জামায়াত। সুতরাং নিমিষেই পাকিস্তানী আদর্শে বিশ্বাসী কমপক্ষে ত্রিশ ভাগকে বাঙালী করা যাবে তা বাস্তবসম্মত নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করলে তারা হাসিনা উৎখাত প্রকল্প জোরদার করে। শেখ হাসিনার জানের ওপর যতবার হামলা হয়েছে বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক নেতার ওপর তা হয়নি। খালেদা জিয়ার সময় তো এনএসআই-ডিজিএফআইয়ের সাহায্যে গ্রেনেড হামলায় তাকে প্রায় খুনই করে ফেলা হয়েছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ১৯৭২ সালের পর তাদের ওপর প্রথম আঘাত। ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তাদের ওপর সর্বপ্রথম আঘাত হানেন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে। ড. কামাল হোসেন যখন সংবিধানের খসড়া করছেন, তখন বঙ্গবন্ধু আলাদা করে তাকে ডেকে নিয়ে বলেন, এই সংক্রান্ত ধারা যোগ করতে। এ নিয়ে তিনি কারো সঙ্গে আলোচনা করেননি। তাঁর অভিজ্ঞতায়ই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছে ওই ধারা যুক্ত করার। পরিস্থিতি কিন্তু তখনও ছিল সঙ্কুল। আমার একান্ত ব্যক্তিগত মত, স্বাধীনতা ঘোষণার পর এটিই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় সাহসিক কাজ। কমিউনিস্ট শাসিত দেশ ছাড়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত আর কোন দেশের রাষ্ট্রনায়ক নিতে পারেননি। হ্যাঁ, জামায়াত বা মুসলিম লীগ তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল। আন্ডারগ্রাউন্ডে সিরাজ শিকদারও ছিলেন। কিন্তু, আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে খুব বেশি কিছু করা যায় না। এ মন্তব্য এ জন্য করলাম যে, অনেকে বলেন জামায়াত নিষিদ্ধ করলে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবে। গেলে কি সুবিধা পাবে? জিয়াউর রহমান যে ক্ষমতা দখলের পর সংবিধানের এই ধারা বাতিল করলেন তার কারণ খুব স্পষ্ট। (চলবে)
×