ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আত্মহত্যার নেপথ্যে মানসিক রোগ

প্রকাশিত: ০৭:১৬, ১০ মে ২০১৬

আত্মহত্যার নেপথ্যে মানসিক রোগ

অনেকেই মনে করেন, যারা একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন, তারা আর ও পথে এগোন নাÑ মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ঘুরে আসায় জীবনের প্রতি তাদের মায়া বেড়ে যায়। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, ঠিক এর উল্টোটা। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা অতীতে আত্মহননের প্রচেষ্টা চালিয়েছে তাদের মধ্যে পুনরায় প্রচেষ্টা চালানো বা আত্মহত্যার হার, যারা কখনোই আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালায়নি তাদের চেয়ে বেশি। কোন কোন গবেষণায় এই হার প্রায় ৩০-৪০ গুণ বেশি। মানসিক রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরের কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহে আত্মহত্যার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। যারা আত্মহত্যা করার চিন্তা করছেন গুরুত্বের সঙ্গে, এমন মানুষদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের প্রায় অর্ধেকই জীবনে কোন না কোন সময়ে মানসিক রোগাক্রান্ত ছিলেন বা আছেন। আর আত্মহত্যায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশই আত্মহত্যার সময়কালে অথবা তার আগে কোন না কোন মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। আত্মহত্যার জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানসিক রোগটি হচ্ছে বিষণœতা। এছাড়া জটিল মানসিক রোগ সিজোফ্রেনিয়া এবং কিছু ব্যক্তিত্ব বৈকল্য বা পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্তরাও অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকেন। তারা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন, পরিকল্পনা করেন, হয়তো ইঙ্গিতে বা প্রকাশ্যে তা ব্যক্তও করেন এবং পরবর্তীতে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটান। মাদকাসক্তি আত্মহত্যার জন্য অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। মাদকাসক্ত আত্মহত্যা-প্রবণ ব্যক্তিদের কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই আত্মহত্যা করে ফেলার ঝুঁকি বেশি। গবেষকরা জানান, অ্যালকোহলে আসক্তদের ১৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেন, হেরোইন-আসক্তদের আত্মহত্যার ঝুঁকি মাদকমুক্ত ব্যক্তিদের তুলনায় ২০ গুণ বেশি। হঠাৎ কোন মানসিক চাপে পড়লে বা জীবনে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে অনেকে এর সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। দৃশ্যমান গুরুতর কোন মানসিক রোগ না থাকা সত্ত্বেও কোন পরিকল্পনা বা দীর্ঘমেয়াদি আত্মহত্যা প্রবণতা ছাড়াই হুট করে অনেকে আত্মহত্যা করে বসতে পারেন এমন কোন চাপের মধ্যে পড়লে। পরীক্ষায় অকৃতকার্যতার ফলে, প্রেমে ব্যর্থতায়, অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে, বাবা-মায়ের ওপর অভিমান করে এমন হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যারা পূর্ব থেকেই অন্য কোন মানসিক রোগে আক্রান্ত অথবা মানসিক চাপে মানিয়ে নেয়ার দক্ষতা কম, তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটার ঝুঁকি বেশি। অবিবাহিত, ডিভোর্সি বা বিপতœীক/বিধবা, বেকার, দীর্ঘমেয়াদি বা দুরারোগ্য শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদেরও আত্মহত্যার ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে বেশি। সম্প্রতি প্রিয় কারো মৃত্যু শোক আত্মহত্যাপ্রবণ করে তুলতে পারে ব্যক্তিকে। শারীরিক-মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরাও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকেন বেশি। চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, এই সব আত্মহত্যার অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য। এ জন্য দরকার সচেতনতা, কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠা এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দীর্ঘমেয়াদে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি প্রকাশ্যে বা ইঙ্গিতে কোন না কোনভাবে তার অন্তর্গত ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে কারো কাছে মা, বাবা, বন্ধু বা চিকিৎসকের কাছে। কেউ যদি আত্মহত্যার কথা ব্যক্ত করে, তবে তা গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। তার সমস্যার জায়গাটা চিহ্নিত করে তাকে সেভাবে সহযোগিতা করার চেষ্টা করতে হবে। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মনে হলে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শমতো চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। আত্মহত্যা-চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের করুণার চোখে না দেখে, তিরস্কার করে, খোঁচা দিয়ে কথা না বলে তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যাদের মানসিক চাপে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা কম, তাদের যথোপযুক্ত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। আত্মহত্যার মাধ্যম যেমন, কীটনাশক প্রভৃতির সহজলভ্যতা কমাতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। মাদকদ্রব্যের ব্যবহার কমাতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর প্রতি নারী-পুরুষ উভয়েরই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। ধর্মীয় ও সামাজিক সুস্থ রীতিনীতির চর্চা করতে হবে। সামাজিক সুস্থ, সুন্দর সম্পর্ক লালন করতে হবে, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। এই বিষয়গুলো আত্মহত্যা প্রতিরোধে ‘প্রটেক্টিভ ফ্যাক্টর’ হিসেবে গণ্য। আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে চাইলে এর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলোর দিকে যেমন মনোযোগ দিতে হবে, তেমনি রক্ষাকারী বিষয়গুলোর প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে বিশ্বের কোথাও না কোথাও একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যা করে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। আত্মহত্যার প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার সংখ্যা এর কয়েক গুণ। আত্মহত্যা নিয়ে বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে রেফারেন্স হিসেবে গণ্য তেমন কোন গবেষণা নেই। তবে, ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু গবেষণা হয়েছে। এসব গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের অন্য অনেক দেশে পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যায় মৃতের হার বেশি হলেও বাংলাদেশে নারীরাই বেশি আত্মহত্যা করে। এরকম আরও কিছু গবেষণার ফল অনুযায়ী, যৌতুক এবং ছাত্রী উত্ত্যক্তকরণ বাংলাদেশে মেয়েদের আত্মহত্যার পেছনে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। সম্প্রতি পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, কম বয়সী, স্কুল ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যা এবং সন্তান বা পরিবারভুক্ত কাউকে হত্যার পর আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। এর পেছনের সামাজিক-মানসিক কারণ খতিয়ে দেখতে এবং সমাজে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার বিস্তার প্রতিরোধে যথাযথ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। ডাঃ মুনতাসীর মারুফ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ মেডিনোভা, মালিবাগ, ঢাকা
×