ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফফার চৌধুরী

হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আঁতাতের এই রটনা কেন?

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১১ মে ২০১৬

হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের আঁতাতের এই রটনা কেন?

কয়েকদিন আগে ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। ঢাকার এক সাংবাদিক বন্ধু প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনার কি মনে হয় আওয়ামী লীগ সরকার ও হেফাজতের মধ্যে একটা গোপন অথবা প্রকাশ্য সমঝোতা কাজ করছে?’ আমি প্রতিবেদনটি পড়ার আগ পর্যন্ত প্রশ্নটির কোনো জবাব দিতে পারিনি। পড়ার পর মনে হয়েছে, এই দীর্ঘ প্রতিবেদনটি প্রকাশের মধ্যে একটা চাতুরি কাজ করছে। এই চাতুর্যটি কি? দেশের অধিকাংশ সচেতন সংবাদপত্র পাঠকই জানেন, প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার এই দুটি পত্রিকাই নিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে কট্টরভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধী। সম্প্রতি শেখ হাসিনা সম্পর্কিত একটি অসত্য খবর এক-এগারোর আমলে দায়িত্বহীনভাবে ছাপানোর কথা স্বীকার করে পত্রিকাটি সাময়িকভাবে বিপাকে পড়ে এবং দুই সহোদর পত্রিকাই আওয়ামী লীগবিরোধী কণ্ঠ হঠাৎ নরম করে ফেলে। কথায় বলে স্বভাব যায় না ম’লেও। বিপাকে পড়ে সরাসরি আওয়ামী লীগবিরোধী খবর ছাপানো থেকে প্রথম আলো একটু পেছনে হটলেও স্বভাবটি বর্জন করতে পারেনি। কৌশলে এমন সব খবর ছাপাতে শুরু করে, যা প্রত্যক্ষভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রচার বলে মনে না হয়; কিন্তু আওয়ামী লীগ সম্পর্কে পাঠক মনে বৈরাগ্য সৃষ্টির চেষ্টাটি অব্যাহত থাকে। হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমঝোতা অথবা সখ্যতার প্রতিবেদনটি এমন কৌশলে আওয়ামী সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য যোগ করে প্রকাশ করা হয়েছে, যাতে মনে হতে পারে দেশের উগ্র মৌলবাদীদের একটা অংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সমঝোতায় এই ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটি শঙ্কিত। অন্যদিকে চাতুর্যের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির প্রচারণাটিকেই সূক্ষ্মভাবে সমর্থন দেওয়া হয়েছে যে, জামায়াত, হেফাজত ইত্যাদি মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে আওয়ামী লীগই আঁতাত করে বেড়ায়। এই প্রচারণায় উগ্র মৌলবাদী তথা জামায়াতের মতো দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির সখ্য ও আঁতাতের অপরাধটি ঢাকা পড়ে যায়। হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আঁতাত সম্পর্কিত খবরটির প্রকাশনার সময়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে ধর্মান্ধ গুপ্ত ঘাতকদের (দু’টি হত্যাকা-ে শিবিরের যোগসূত্র জানা গেছে) হাতে কয়েকজন ব্লগার, বিদেশী নাগরিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিহত হওয়ার ঘটনার সুযোগ নিয়ে আমেরিকা প্রচার শুরু করে বাংলাদেশে আইএস বা ইসলামী স্টেটের জঙ্গীদের অস্তিত্ব আছে। আওয়ামী লীগ সরকার তা দৃঢ়তার সঙ্গে অস্বীকার করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তা নিশা দেশাইও সম্ভবত বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের জন্য একই বার্তা নিয়ে সম্প্রতি ঢাকায় এসেছিলেন। ঠিক এই সময় হেফাজতীদের জঙ্গী সাজিয়ে যদি প্রমাণ করা যায়, জঙ্গীদের একাংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকার সমঝোতা করে চলেছে, তাহলে প্রথম আলো এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারবে। প্রথমত তারা প্রমাণ করতে চাইবে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষভাবে আইএসের জঙ্গীদের উপস্থিতি না থাকলেও তাদের সঙ্গী অথবা সমর্থক জঙ্গীদের উপস্থিতি আছে। তাদের একাংশের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সমঝোতা রয়েছে। সুতরাং সরকার জঙ্গী দমনে সফল হচ্ছে না। এভাবে প্রথম আলো সরকারের জঙ্গী দমন প্রচেষ্টায় সমর্থন জোগাচ্ছে না, কৌশলে সমর্থন জোগাচ্ছে আমেরিকা ও বিএনপির প্রচারণায়। এখন যেমন প্রচারণা চালানো হচ্ছে, হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমঝোতা করে চলছে; তেমনি ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে এবং পরেও বিএনপি ও বিএনপির সমর্থক বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর প্রচারণা ছিল, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আঁতাত করেছে। জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী উগ্র মৌলবাদী দল। এই দলের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের মনে ঘৃণা আছে। বিএনপি এই দলের সঙ্গে তাদের আদর্শগত ও লক্ষ্যগত মিল থাকা সত্ত্বেও প্রচার করে বেড়াচ্ছিল, জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আঁতাত করেছে। বিষয়টা এখন সকলেরই জানা। বিএনপি সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি মেনে নিতে রাজি করানো জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে বহুদলীয় আন্দোলন শুরু হয়, তখন জামায়াত সেই আন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট তাদের গ্রহণ করেনি। তারা নিজস্ব দলীয় ভিত্তিতে এই আন্দোলনের কর্মসূচীর সঙ্গে নিজেদের কর্মসূচী মিলিয়ে আন্দোলনে সমর্থন দিতে থাকে। এটাকেই জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আঁতাত বলে দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারণা চালানো হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে দেখা গেল বিএনপির ন্যাচারাল এলাই বা স্বাভাবিক মিত্র কে? এই মিত্র হলো স্বাধীনতাবিরোধী এবং একাত্তরের ঘাতক জামায়াত। এই জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করেছিল। যে মতিউর রহমান নিজামী এখন একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসিতে ঝোলার দিন গুনছেন, তাকে বিএনপি ২০০১ সালের নির্বাচনে জেতার পর বানিয়েছিলেন তাদের সরকারের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা। পরবর্তীকালে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ৫ মে মৌলবাদী হেফাজতীরা দেশে যে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিল, তার পেছনেও সর্বাত্মক সহযোগিতা জুগিয়েছে জামায়াত। ইন্ধন জুগিয়েছে বিএনপি (এরশাদ সাহেবও পেছনে পড়ে থাকেননি)। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় সমর্থন জানান এবং হেফাজতী মাদ্রাসা ছাত্ররা যখন মিছিল করে ঢাকার দিকে আসতে থাকে তখন তাদের জন্য পথে পথে খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করেছিল বিএনপি। এই হেফাজতী অভ্যুত্থান উস্কে দিয়ে খালেদা জিয়া আশা করেছিলেন, তিনি হাসিনা সরকারের পতন নিশ্চিত করেছেন। এ জন্যে শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। এক রাতের সরকারী অভিযানে এই প্রহসনের সমাপ্তি ঘটে। দেখা যায় অধিকাংশ তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রকে ঢাকায় বেড়ানো এবং আমোদ-প্রমোদের প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ঢুকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ঢাকায় রক্তপাত ঘটানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সরকারের দৃঢ়তার মুখে তা ব্যর্থ হয়। প্রায় বিনা রক্তপাতে এই হেফাজতী অভ্যুত্থান দমন হাসিনা সরকারের একটি অভূতপূর্ব সাফল্য। পশ্চিমবঙ্গে নকশাল সন্ত্রাস দমনেও জ্যোতি বসুর কম্যুনিস্ট সরকার এই সাফল্য দেখাতে পারেনি। রক্তপাত ঘটেছে প্রচুর। বাংলাদেশে রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঘটাতে চরম ব্যর্থতার পর বিএনপি প্রচার শুরু করে শাপলা চত্বরে হাজার হাজার মাদ্রাসা ছাত্র হত্যা করে অধিকাংশ লাশ ভারতে পাচার করা হয়েছে। এই প্রচারণাও সর্বৈব মিথ্যা তা অচিরেই প্রমাণিত হয়। হেফাজতীদের সামনে রেখে এবং উস্কে দিয়ে দেশে রক্তাক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল বিএনপি ও জামায়াত। কিন্তু হেফাজতের মাদ্রাসা ছাত্ররা সন্ত্রাসী নয় বলেই পুলিশের নির্দেশে তারা দলে দলে শাপলা চত্বর ছেড়ে যায়। হেফাজতের পীর সাহেবও সরকারী হেলিকপ্টারে চড়ে হাটহাজারীতে ফিরে যান। সরকারের সঙ্গে কোন সংঘর্ষের পথে যাননি। হেফাজতীরা গোঁড়া মৌলবাদী। কিন্তু জামায়াতের মতো উগ্র রাজনৈতিক মৌলবাদী নয়। জামায়াতের মতো ধর্মকে পুঁজি করে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে তারা জড়িত নয়। এ জন্যেই হাসিনা সরকার অতি সহজেই জামায়াতের খপ্পর থেকে হেফাজতীদের মুক্ত করে তাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে তুলতে পেরেছেন। হেফাজতী নেতারা জামায়াতী নেতাদের মতো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীও নয়। প্রথম আলোর প্রতিবেদনে যে দেখানো হয়েছে হেফাজতের সঙ্গে হাসিনা সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী মাঝেসাঝে কথাবার্তা বলেন, তাতে দোষের কিছু নেই। এটা আঁতাত নয়, একটি গণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। সর্বত্র এবং সকলের সঙ্গে কনফ্রন্টেশন দ্বারা সমস্যা সমাধান হয় না। হাসিনা সরকার দমন নীতির দ্বারা নয়, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দ্বারা বিএনপি ও জামায়াতের খপ্পর থেকে হেফাজতীদের সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ফলে দেশে বড় ধরনের রক্তপাত ঘটানোর পরিকল্পনা করেও বিএনপি ও জামায়াত সফল হয়নি। এই একই ধরনের কৌশল গ্রহণ করেছিল পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতি বসুর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে বামফ্রন্ট সরকার। তারা হিংস্র নকশাল আন্দোলন দমন করার জন্য নকশালদের কানু সান্যাল গ্রুপকে চারু মজুমদারের গ্রুপের কাছ থেকে সরিয়ে এনেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে এখনও মাওবাদী উৎপাত আছে। কিন্তু নকশাল সন্ত্রাস পরাভূত। জ্যোতি বসুর এই কৌশলকে কেউ নকশালীদের এক অংশের সঙ্গে আপোস বা আঁতাত বলে প্রচার চালায়নি। বাংলাদেশে যে ধর্মীয় জঙ্গীবাদ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মাথা তুলতে পারেনি, তার কারণ, অনেক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীকেও হাসিনা সরকার জামায়াতের প্রভাব থেকে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশের বহু প্রভাবশালী আলেম ওলেমা, বহু ধর্মীয় দল জামায়াতের তথাকথিত ধর্মীয় রাজনীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্ত ও সন্ত্রাস দমনের জন্য এই জামায়াতবিরোধী ধর্মীয় নেতা ও দলগুলোর সমর্থন লাভ হাসিনা সরকারের দরকার। আঁতাত নয়, আপোসও নয় তা বিভিন্ন দেশে অনুসৃত গণতান্ত্রিক সরকারের রাজনৈতিক কৌশল। আফগানিস্তানের সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমেরিকা পর্যন্ত তালেবান সন্ত্রাসীদের মধ্য থেকে গুড তালেবান বের করে তাদের সঙ্গে একটা রফা করার জন্য কি কম চেষ্টা করছে? একটি পত্রিকার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য যে কাগজের সম্পাদক বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিবের কাছে গিয়ে তওবা করতে পারেন, তিনি যখন দেশের বৃহত্তর স্বার্থে হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কৌশলপূর্ণ সম্পর্কের নীতিকে আঁতাত বা আপোস বলে চালাতে চান, তখন তার সাংবাদিক সততা সম্পর্কেই মনে প্রশ্ন জাগে। [লন্ডন ১০ মে মঙ্গলবার ২০১৬]
×