শংকর লাল দাশ ॥ পটুয়াখালীর দেওয়ান শরিফ মেলা ২শ’ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে আজও। প্রতিবছর বৈশাখের প্রচ- দাবদাহে মানুষের প্রাণ যখন থাকে ওষ্ঠাগত তখন রূদ্র প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে ওই মেলামাঠে নেমে আসে গণমানুষের ঢল। নানা উৎসব-আয়োজনে তারা অংশ নেয় ব্যাপক উৎসাহে। সবচেয়ে বেশি ভিড় হয় ঘোড়দৌড় ময়দানে। থাকে না তিল ধারণের ঠাঁই। পিঠাপুলি আর মৃৎশিল্পের জমজমাট পসরাও বসে। মেলা উপলক্ষে আশপাশের গাঁয়ের বাড়িঘর ভরে যায় আত্মীয়-স্বজনে। প্রতিটি ঘরে আয়োজন করা হয় সুস্বাদু নানা খাদ্যদ্রব্যের। এ মেলার আবহ গ্রামীণজীবনে এক অন্য ধরনের পরশ বুলিয়ে দেয়। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সবাই উপভোগ করে এ মেলা।
পটুয়াখালী সদর উপজেলার কমলাপুর ইউনিয়নের ধরান্দি গ্রামের ধর্মীয় সাধক দেওয়ান শরিফের নামে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে প্রায় দু’শ’ বছর ধরে। বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলে সগৌরবে টিকে থাকা প্রাচীন মেলাগুলোর মধ্যে দেওয়ান শরিফ মেলা অন্যতম। প্রতিবছর বৈশাখের ১৫ তারিখ আয়োজন করা হয় এ মেলার। সেই হিসেবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এ মেলা। প্রায় শুরু থেকেই মেলাটি দু’পর্বে বিভক্ত।
সকালে ধরান্দি গ্রামের দেওয়ান শরিফের মাজার সংলগ্ন মাঠে শুরু হয় মেলা। শেষ হয় দুপুর নাগাদ। দুপুরের পর খানবাড়ি সংলগ্ন মাঠে বসে মেলার দ্বিতীয় পর্ব। মেলায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার দৌড় থেকে শুরু করে চলে পিঠাপুলির নানান আয়োজন। এক সময় এই মেলার ঘোড়দৌড়ে শত শত ঘোড়া অংশ নিত। দেশের নানাপ্রান্ত থেকে আসত বহু ঘোড়া। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে এখন দৌড়ে অংশ নেয়া ঘোড়ার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। এরপরও এবার ২০টি ঘোড়া দৌড়ে অংশ নেয়। মেলার অন্যতম আকর্ষণ ঘোড়ার দৌড় দেখতে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে। লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে ঘোড়দৌড়ের মাঠ।
কোলাহল মুখর শহুরে জীবন থেকে অনেকদূরের ছায়াঘেরা পল্লীর এ মেলাটি নানা ধরনের মিষ্টি আর পিঠাপুলির জন্যও বিখ্যাত। এসব দোকানে কোথাও ক্ষণকাল দাঁড়ানোর উপায় পর্যন্ত থাকে না। মেলায় আসা প্রায় প্রত্যেকেই কিনে নেয় মিষ্টি আর পিঠাপুলি। হাড়িভর্তি মিষ্টি নিয়ে লোকজন ছুটে যায় স্বজনের বাড়িতে। মেলার বিভিন্ন স্টলে থাকে মৃৎশিল্প, কাঁসা-পিতলের তৈরি পণ্য আর থাকে বাহারি পোশাকের দোকান। তালপাতার বাঁশি আর বেলুন ফুলিয়ে শিস বাজিয়ে শিশুরা মেতে ওঠে নির্মল বিনোদনে। মেলার পরিবেশও থাকে যথেষ্ট সুন্দর। আয়োজকরা বলেন, মেলার পরিবেশ ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা সব সময়ই সক্রিয় থাকেন। আয়োজকদের অন্যতম মোঃ ফারুক খান বলেন, ‘প্রায় দু’শ’ বছর ধরে এ মেলা আপনাআপনি মিলে আসছে। আমরা আমাদের বাপ-দাদার কাল থেকেই দেখছি প্রতিবছর বৈশাখে এ মেলার আয়োজন হচ্ছে। আর এ মেলা আয়োজন করতে কোন ধরনের প্রচার ও আয়োজক কমিটির দরকার হয় না।
এলাকার সাধারণ মানুষ জানান, অনেকেই আছেন যারা সারাবছর গ্রামে আসার সুযোগ পান না। ঈদ অথবা কোরবানিতে না আসতে পারলেও এই মেলায় তারা অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া মেলা উপলক্ষে প্রতিবাড়িতে মেয়ে-জামাই থেকে শুরু করে নিকট আত্মীয়ের দাওয়াত দেয়াটাও এখন যেন আশপাশের গাঁয়ে রীতিমতো প্রথা হিসেবে রূপ নিয়েছে। এসব কারণে গ্রামের বাড়িগুলোতে মেলা উপলক্ষে থাকে উৎসবের আমেজ।
প্রতিবছর এ মেলা কেন্দ্র করে বাড়ছে মেলার পরিধি ও দর্শনার্থীর সংখ্যা। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রত্যন্ত এ গ্রামের মেলায় থাকে বিশেষ নজরদারি। দেওয়ান শরিফের এই মেলা এখন শুধু পটুয়াখালীই নয় পুরো দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এ বছর মেলায় প্রধান অতিথি থেকে ঘোড়দৌড়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট তারিকুজ্জামান মনি। তিনি বলেন, ‘শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলাকে জেলা ও জেলার বাইরের মানুষের কাছে পরিচিত করতে বিগত বছরগুলোর মতো আগামীতেও উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে। কারণ, এর ঐতিহ্য আমাদের ধরে রাখতে হবে।’