ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চুকনগরের গণহত্যা

স্বাধীনতার স্পৃহা আর মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে মর্মন্তুদ স্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ১৭ মে ২০১৬

স্বাধীনতার স্পৃহা আর মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে মর্মন্তুদ স্মৃতি

আনোয়ার রোজেন ॥ পাকিস্তানী হানাদারদের নৃশংসতার নিদর্শন দেখে কখনও শিউরে উঠবেন আপনি। কখনও বা আবেগে ঝাপসা হয়ে আসবে চোখ। তারপর আসবে গৌরব, আমাদের বিজয় মুহূর্ত। বাঙালীর মুক্তি, স্বাধীনতার স্পৃহা আর মুক্তিযুদ্ধকালের সবচেয়ে মর্মন্তুদ পর্ব গণহত্যার ইতিহাসকে এভাবেই মেলে ধরেছে খুলনার ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যা-নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করা এ প্রতিষ্ঠানটি আজ মঙ্গলবার পূর্ণ করবে দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে ও চুকনগর গণহত্যা দিবস স্মরণে ডাক বিভাগ আজ একটি বিশেষ খাম অবমুক্ত করবে। খামের ওপরের পৃষ্ঠায় বাম পাশে রক্তিম গোলাকার বৃত্তে রয়েছে চুকনগর গণহত্যার স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভের আলোকচিত্র, ওপরের কোনায় রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আলোকচিত্র। আর খামের বাকিটাজুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নৃশংসতা ও বর্বরতার চিত্র। এ ধরনের আর্কাইভ-জাদুঘরের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন একবার বলেছিলেন, মানুষ বেশিদিন বীরত্বের বিষয়টি মনে রাখে না। মনে রাখে বেদনার ও কষ্টের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের মানুষের ওপর কী অত্যাচার-নির্যাতন হয়েছে সে সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ করে গণহত্যা-নির্যাতনের বা আমাদের জাতীয় আত্মপরিচয়ের এ গৌরবজনক অধ্যায়টি আগামী প্রজন্মের কাছে যথাযথভাবে তুলে ধরাই এর মূল উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠার ইতিকথা ॥ ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নির্বাসিত জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনটিকে মনে রেখে ২০১৪ সালের ১৭ মে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যা-নির্যাতন বিষয়ক জাদুঘরÑ ‘১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’। খুলনার ময়লাপোতা এলাকার শেরেবাংলা রোড়ের ৩৩৪ নম্বর বাড়িটির নিচতলায় তিনটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে এর কার্যক্রম শুরু হয়। গত বছরের আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে খুলনা নগরের ২৬ সাউথ সেন্ট্রাল রোডের দ্বিতল বাড়ি উপহার পায় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে এ বাড়িতেই চলছে জাদুঘরের কার্যক্রম। ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে জাদুঘরটি পরিচালিত হচ্ছে; যার সভাপতি অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, ট্রাস্টি সম্পাদক ড. শেখ বাহারুল আলম। ট্রাস্টের ট্রাস্টি চৌধুরী শহীদ কাদের বলেন, আমরা সবকিছু ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করি। এর ফলে ঢাকার বাইরের মানুষ এসব কর্মকা-ে সক্রিয় হতে পারে না। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি আমরা ঢাকার বাইরে করেছি, যাতে দক্ষিণাঞ্চলে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন মানুষজন সক্রিয় হতে পারে। এটি হবে মহান মুক্তিযুদ্ধের মুখ্যতÑ ‘গণহত্যা’ ও ’নির্যাতন’ পর্বের একটি বিশাল তথ্যভা-ার। তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে খুলনা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি গণকবর নির্দিষ্টকরণ ও নামফলক স্থাপন করা হয়েছে। বিশেষ করে খুলনা অঞ্চলে গত এক বছরে প্রায় ২০টি অচিহ্নিত গণকবর, বধ্যভূমি চিহ্নিত করে ফলক নির্মাণ করা হয়েছে। এখন মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত বই ও দলিলপত্র সংগ্রহের কাজ চলছে। জাদুঘরের লাইব্রেরী প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে (রবিবার ব্যতীত)। আর্কাইভ থেকে আর্কাইভ বার্তা নামে একটি বুলেটিন নিয়মিত প্রকাশ করা হচ্ছে। যা আছে নিদর্শন হিসেবে ॥ আর্কাইভ ও জাদুঘরের প্রবেশ মুখেই আছে ১৯৭১ সালের গণহত্যা স্মারক মানচিত্র। আছে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটে বাঙালী জাতির ওপর পাকিস্তানীদের নির্মম নির্যাতনের চিত্রাবলী, হত্যার শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্থিরচিত্র, দেশত্যাগরত সারি সারি শরণার্থীদের স্থির চিত্র। আছে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মুখের ছবি দিয়ে পটুয়া কামরুল হাসানের আঁকা পোস্টার ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। একের পর এক সাজানো হয়েছে যুদ্ধকালীন নানা ধরনের নির্যাতনের আলোকচিত্র। আছে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনার ওপর প্রকাশিত ম্যাগাজিন ও স্মরণিকাও। জাদুঘর সূত্রে জানা যায়, জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই আছে পাঁচ শতাধিক, গণহত্যা ও নির্যাতনের বাঁধানো ছবি রয়েছে শতাধিক। আগরতলার শিল্পীদের আঁকা ‘শিল্পীর চোখে গণহত্যা-নির্যাতন আর্ট’ শিরোনামের ছবিও আছে। ২০১৫ সালে ‘শিল্পীর চোখে গণহত্যা নির্যাতন’ নামে একটি আর্টক্যাম্প হয়, সেখানকার ছবিও আছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রামাণ্যচিত্রের সিডিসহ মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার নানান নিদর্শন আছে। জাদুঘরের পক্ষ থেকে গণহত্যার ওপর জাতীয় জাদুঘর, ভারতের ত্রিপুরা ও খুলনায় বিশেষ আলোকচিত্র প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ জাদুঘরের উদ্যোগে বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও ফলক স্থাপনের কাজ চলছে। চৌধুরী শহীদ কাদের জানান, জাদুঘরের উদ্যোগে দেশের প্রতিটি গণহত্যাস্থলের ওপর ‘গণহত্যা নির্ঘণ্ট’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই তিন পর্যায়ে এর ৩১টি গ্রন্থ প্রকাশিত করা হয়েছে। আমাদের প্রস্তাবে ত্রিপুরা সরকার ও ত্রিপুরা জাতীয় জাদুঘরে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিপুরা’ শীর্ষক একটি গ্যালারি স্থাপন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মারক হিসেবে ত্রিপুরার চোত্তাখোলায় ভারত সরকার নির্মিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী উদ্যানে আমরা একটি স্মারক ভাস্কর্য উদ্যান গড়ে তুলছি; যেখানে বাংলাদেশের খ্যাতিমান ভাস্করদের ভাস্কর্যকর্ম স্থান পাবে। আমরা জাদুঘরের উদ্যোগে একটি আইপি টেলিভিশন (ইতিহাস আইপি টিভি) চালু করেছি। তিনি বলেন, আমাদের মূল দর্শন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংরক্ষণ ও বিকাশ। আমরা চাই এ জাদুঘর ও আর্কাইভ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলে একটি সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করতে। এ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম প্রতিষ্ঠান এটি। দেশের সবচেয়ে বেশি গণহত্যা ও নির্যাতন ঘটেছে এ অঞ্চলে। সবচেয়ে বড় বধ্যভূমি চুকনগরের অবস্থান এখানে। সার্বিক দিক বিবেচনায় এই ১৯৭১ : গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক জোন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছেÑ যেখানে এসে আগামী প্রজন্ম তার আত্মপরিচয়ের সন্ধান পাবে।
×