ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মেরুলে রাজউকের আবাসিক এলাকায় নানা বাণিজ্য ;###;পাঁচ বছরে গুদাম অপসারণ করতে পারেনি কমিটি ;###;১৫ বছরে ঘটেছে দুই শতাধিক অগ্নিকাণ্ড

মৃত্যুঝুঁকিতে পুরান ঢাকার মানুষ

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৭ মে ২০১৬

মৃত্যুঝুঁকিতে পুরান ঢাকার মানুষ

রাজন ভট্টাচার্য ॥ সীমা ছাড়িয়েছে যন্ত্রণা। ভাল নেই নগরবাসী। একদিকে জীবনযুদ্ধ। ঝুঁকি নিয়ে পথচলা। অন্যদিকে দখল আর দূষণসহ নানা যন্ত্রণা এখন নিত্যসঙ্গী। নতুন উপদ্রব আবাসিক এলাকার অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া নিয়ে। নগরীর প্রায় ৭০ ভাগ এলাকা এখন আবাসিক চরিত্র হারিয়েছে। গবেষকরা বলছেন, ঐতিহ্যের ঢাকা এখন বাণিজ্যের নগরী। গোটা রাজধানীই যেন ব্যবসা কেন্দ্র। নিয়মনীতি বা আইনের তোয়াক্কা না করেই রাতারাতি গজিয়ে উঠছে একের পর প্রতিষ্ঠান। দ্রুত বদলে যাচ্ছে বাসযোগ্য এলাকাগুলোর ধরন। প্লাস্টিক, কেমিক্যালসহ নানা ব্যবসায় ইসলামপুরের চিত্র এখন আর আগের মতো নেই। শুধু কেমিক্যাল বাণিজ্যের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস পুরান ঢাকার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে ১২৪ জন মানুষ মারা যান। এরপর মৃত্যুবোমা কেমিক্যালের সব গুদাম সরিয়ে নিতে দুটি কমিটি গঠন হলেও এখন পর্যন্ত কাজ শুরু করতে পারেনি। অথচ গত ১৫ বছরে এই এলাকায় দুই শতাধিক অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। মজার বিষয় হলো রাজউকও তাদের আবাসিক এলাকার চরিত্র ধরে রাখতে পারেনি। রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় রাজউকের একটি আবাসিক এলাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দাপটে এখন আর চেনার উপায় নেই। জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব সুশান্ত চাকমা জনকণ্ঠ’কে বলেন, নগরীর যেসব এলাকায় অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে কিংবা নিয়মবহির্ভূতভাবে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে আমরা পর্যায়ক্রমে এসব এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছি। ইতোমধ্যে সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালাচ্ছে। নিয়মিত অভিযান চলবে বলে জানান তিনি। ছয় মাসের মধ্যে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক সকল স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যাপারে মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সম্প্রতি একটি বৈঠক হয়েছে মাত্র। কোন প্রক্রিয়ায় কাজটি করা হবে? কারা কারা এর সঙ্গে যুক্ত থাকলে ভাল হয় সবগুলো বিষয় যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, নগর উন্নয়নের সঙ্গে রাজউকের পাশাপাশি অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান জড়িত। এখানে সিটি কর্পোরেশনের একটি বিরাট বড় ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও আছে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অনেক বিভাগ ও মন্ত্রণালয়। মূল কথা হলো মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার জন্য আমরা অপেক্ষায় আছি বলে জানান তিনি। ইসলামপুরের চিত্র ॥ ইসলামপুর এলাকায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি বাড়ি গড়ে উঠেছে প্লাস্টিকের কারখানা। কারখানার যন্ত্রাংশের শব্দে সবসময় অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ। এছাড়াও এখানে গড়ে উঠেছে কসমেটিকস, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ বিশেষ করে বাল্ব কারখানা। আবাসিক ভবনগুলোর নিচতলা ভাড়া দেয়া হয়েছে কেমিক্যাল ও প্লাস্টিকের গুদাম হিসেবে। কোথাও কোথাও গড়ে উঠেছে বাকরখানির দোকান। ইসলামপুরের মতো পুরান ঢাকার বকশীবাজার, লালবাগ এলাকারও একই চিত্র। এখানে মূল সড়ক, গলি ফুটপাথ কিছুই চেনার উপায় নেই। এই রাস্তায় মোটরযান, রিক্সা ও সাধারণ পথচারী চলাচল করছে। ফলে মোড়ে মোড়ে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। এসব এলাকায় যতটুকু ফুটপাথ আছে তার পুরোটাই দখল করে রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কোথাও ফুটপাথের ওপর চলছে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, কোথাও ফুটপাথে রাখা হয়েছে দোকানের ফার্নিচার। এতে সাধারণ পথচারীদের চলাচলেও বেশ সমস্যা পোহাতে হয়। মৃত্যুঝুঁকিতে পুরান ঢাকার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ ॥ কেমিক্যালের গুদামের কারণে পুরান ঢাকার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যুঝুঁকিতে বসবাস করছেন। যে কোন সময় ঘটতে পারে নিমতলীর মতো ট্র্যাজেডি। ২০১০ সালের ২ জুন রাতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে নিমতলীতে। এর পরপরই ঘটনার তদন্ত শেষে তোড়জোড় শুরু হয় কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়ার। এ পর্যন্তই শেষ! আর কোন পদক্ষেপ নেই। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, নিমতলীতে অগ্নিকা-ের ঘটনার পর পুরান ঢাকায় কেমিক্যালের গুদাম করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। তবে অনেকেই নিজেদের মতো করেই এ কাজটি করছেন। বুটপলিশ ও উপ-বুটপলিশের নামে ছাড়পত্র নিয়ে প্রতি মাসে চীন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে শত কোটি টাকার বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ। এরপর প্রকাশ্যে কখনও আইনসম্মতভাবে, কখনও বেআইনীভাবে বিক্রি করা হচ্ছে পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে। নিয়মানুযায়ী নারকোটিক্স ও বিস্ফোরক অধিদফতর থেকে ছাড়পত্রধারীদেরই কেবল কেমিক্যাল বিক্রি করার কথা। কিন্তু পুরান ঢাকার কেমিক্যাল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই সে ছাড়পত্র নেই। আবাসিক ভবনগুলো পুরোই বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়েছে। রেস্টুরেন্ট, গুদাম, কাঁচামালের ব্যবসাসহ পুরনো এই শহরটির পুরোটাই যেন এখন বাণিজ্যিক এলাকা। নিমতলী, মিটফোর্ড, কদমতলী, নয়াবাজারসহ আশপাশের এলাকায় রাস্তার ওপর কেমিক্যালের ড্রাম রেখে মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উপরে মানুষের বসবাস আর নিচে কেমিক্যাল গুদাম। ঠেলাগাড়ি, ভ্যানে করে নেয়া হচ্ছে কেমিক্যালের ড্রাম। পাশ দিয়েই চলাচল করছেন সাধারণ মানুষ। ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডির পর পুরান ঢাকায় কদমতলীর শ্যামপুর শিল্প এলাকায় একটি কারখানায় ছাদের থাকার ঘরে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে আটজন শ্রমিক ঘটনাস্থলেই পুড়ে মারা যান। এছাড়া ছোটখাটো আগুন লাগার ঘটনা তো আছেই। ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবকে প্রধান করে আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কমিটিগুলো এখনও কাজই শুরু করতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের সচেতনতার অভাবে পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বেশিরভাগ অগ্নিকা- ঘটছে। যেসব ভবনে বা কারখানায় আগুন লাগছে সেগুলোর অধিকাংশেই অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। আবার কোথাও আগুন লাগলে সাধারণ মানুষ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহযোগিতা করার পরিবর্তে রাস্তা আটকে উৎসুকভাবে তাকিয়ে থাকে। অগ্নিকা- প্রতিরোধে ভবন বা কারখানা মালিকদের আরও বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তারা। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, দ্রুত এ কাজটি না করা গেলে আরও ঘটনা ঘটতে পারে।
×