ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে সন্ত্রাসের ধরন বদলাচ্ছে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৯ মে ২০১৬

বাংলাদেশে সন্ত্রাসের ধরন বদলাচ্ছে বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র

তৌহিদুর রহমান ॥ বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে সহযোগিতার লক্ষ্যে নতুন পথ খুঁজছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে সন্ত্রাসের ধরন বদলাচ্ছে বলেও মনে করছে দেশটি। এছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়াতে আগামী বছরের জাতীয় বাজেটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাদ্দ বাড়ানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানায়। চলতি মাসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের দুটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেছেন। দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ও মুখ্য উপসহকারী মন্ত্রী উইলিয়াম ই টডের নেতৃত্বে দুইটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসেন। তারা সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। দুটি প্রতিনিধি দলের সফরে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধই ছিল আলোচনার মুখ্য বিষয়। ঢাকা সফরকালে মার্কির যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের এই দুই শীর্ষ কর্মকর্তা সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন, বাংলাদেশে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে মনে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কেননা এখন যে ধরনের টার্গেট কিলিং হচ্ছে, এটা বাংলাদেশে কখনই ছিল না। এখানে সন্ত্রাসের যে ধরন বদলাচ্ছে, সেটা এখানকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিরোধী বলেও মনে করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে সন্ত্রাসের ধরন পরিবর্তন হওয়ায় নতুন উপায়ে এই সন্ত্রাস প্রতিরোধের পরামর্শ দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কেননা প্রচলিত সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হত্যাকা-ের কোন মিল নেই। নতুন ধরনের এই সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিরোধে সহযোগিতা দিতে চায় দেশটি। সে কারণে দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই ধরনের সন্ত্রাস প্রতিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নতুন উপায় খুঁজছে। একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নতুনভাবে সহযোগিতা দিতে চাইছে, তবে সে বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও পুরোপুরি খোলাসা করেনি। নতুন পথ নিয়ে দুই দেশের মধ্যেই আলোচনা হয়েছে, তবে এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বিশদভাবে অবহিত করবে। সূত্র জানায়, ঢাকা সফর শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল তার দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ সফর নিয়ে একটি নোট পেশ করেছেন। সেই নোটে বাংলাদেশের জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মার্কিন প্রশাসনকে বিস্তারিত অবহিত করেছেন তিনি। বাংলাদেশে সন্ত্রাসের ধরন পরিবর্তন হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। নোটে তিনি জঙ্গী ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে বাংলাদেশকে নতুন পথে সহযোগিতা দেয়ার কথা উল্লেখ করেছেন নিশা দেশাই। বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বাংলাদেশে আইএস বা আলকায়েদার কোন সাংগঠনিক কাঠামো নেই বলে মার্কিন প্রতিনিধিদের সাফ জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এই বিষয়ে মতবিরোধ সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস প্রতিরোধে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শুরু থেকেই এখানে যেসব জঙ্গী হামলা হয়েছে সেগুলোর সঙ্গে দেশী জঙ্গীরা জড়িত। হুজি, জেএমবি, আনসারুল্লাহ, আনসার আল ইসলামসহ বিভিন্ন ব্যানারে জঙ্গীরা কার্যক্রম চালাচ্ছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের রক্ষা করতে ও উন্নয়নে বাধা দিতেই তারা এসব করছে। তবে পরিস্থিতি পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বেশিরভাগ হামলাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকা সফরের সময় মার্কিন প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের সমসাময়িক ইস্যু হিসেবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মুক্তমতের চর্চায় বাধা, মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তা-রাবি শিক্ষক, ব্লগার, ইমাম, পুরোহিত খুনসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ জন্য সন্ত্রাসবাদ দমনে এক সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তারা। দেশে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ইস্যুসহ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে ঢাকা-ওয়াশিংটনের সহযোগিতা বিষয়টিকে মার্কিন প্রতিনিধি দল প্রাধান্য দিয়েছেন। একের পর এক হত্যাকা-ে বাংলাদেশ সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সে সম্পর্কেও অবহিত হয়েছেন তারা। সূত্র জানায়, মার্কিন প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরের সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জঙ্গী ও সন্ত্রাসীরা যে কর্মকা- চালাচ্ছে, তা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা আরও বাড়ানোর জন্য পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এছাড়া জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের বিষয়ে তথ্য আদান প্রদানে দুই দেশ আরও জোর দিয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরের সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গী প্রতিরোধই ছিল গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তবে এটা ছাড়াও অন্যান্য ইস্যুতেও আলোচনা করেছেন তারা। আগামী জুন মাসে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম অংশীদারী সংলাপ কিভাবে সফল করা যেতে পারে, তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।। এছাড়া আগামী সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ অধিবেশনের সময় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে সাইডলাইনে অভিবাসন সম্পর্কিত একটি উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে কো-চেয়ার করার জন্য শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে সহযোগিতা বাড়াতে চায়। দেশটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশেও জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে সহযোগিতা দেবে। সেজন্য মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই ইতোমধ্যেই বলেছেন, আগামী ২০১৭ সালের অর্থ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাজেট বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছে। আগামী বছরের জন্য এই অঞ্চলে ২০৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এই অর্থ যেসব খাতে ব্যয় হবে তার মধ্যে অন্যতম খাত হলো জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ। ঢাকা সফরের সময় মার্কিন প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত রয়েছে। আঞ্চলিক যোগাযোগ বৃদ্ধিতেও বাংলাদেশের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তবে একই কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকিও রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) এই অঞ্চলে শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। এখানে ভবিষ্যতে আরও জঙ্গীবাদের বিস্তৃত ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
×