ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

বই ॥ সাম্যের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২০ মে ২০১৬

বই ॥ সাম্যের স্বপ্ন

দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরীর পারিপার্শ্বিক জীবনে অমানুষিক নির্যাতন ও নিপীড়ন তাঁর মন-মানসকে বিচলিত ও বিগলিত করে তুলে। একে উৎখাত করার জন্য তিনি সমাজতন্ত্রকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নতুন সাফল্য অর্জন করার কথা ভেবেছেন। তাঁর বিশ্বাস এই যে, সমাজতন্ত্রই পারে সমাজের নিচুতলায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কোটি সর্বহারা মানুষের মুক্তির পথকে অবারিত করে তাদের জীবনমান উন্নত করতে। সমাজতন্ত্রই পারে মেহনতী মানুষকে অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে। তিনি বলেছেন যে, সমাজতন্ত্র নির্মাণের মাধ্যমেই মানুষের ওপর সকল প্রকার শোষণের অবসান ঘটিয়ে শ্রেণীহীন-শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নিপীড়িত জনগণ যুগ যুগ ধরে যে শোষণমূলক ব্যবস্থার কালো ফণার ছোবলে ধ্বংস হচ্ছে, তার থেকে মুক্তির পথ সর্বহারার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। যদিও আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সঙ্গে পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলো ও সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎপরতায় সর্বহারা জনগণের মধ্যে বিপ্লবী সংগ্রামের সম্ভাবনা ও সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে হতাশা ও সন্দেহের সৃষ্টি হয়, তবুও দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর যে, এই হতাশা এবং সন্দেহ সাম্রাজ্যবাদী প্রচার-মাধ্যমগুলোর একতরফা প্রচারণার ফলে বিশ্বের দেশে দেশে বিপ্লবী-আন্দোলন ও সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করেছে। তাঁর বিশ্বাস, বাস্তবে এইসব ঘটনাবলী সাম্রাজ্যবাদের অবক্ষয় ও ধ্বংসের পর্যায়, তার বিকাশের কোনো পর্যায় অবশ্যই নয়, বরং পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ চরিত্রগত সঙ্কটের বহিঃপ্রকাশ, যা ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য। পঞ্চখ-ে বিভক্ত ‘বিপ্লব ও বিপ্লবীদের কথা’-এ দ্রোহী কথাসাহিত্যিক আব্দুর রউফ চৌধুরী সমাজতন্ত্রের আলোচনা করেছেন, যথাÑ ‘ফরাসী বিপ্লব’; ‘কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস’; ‘লেনিন-স্তালিন ও রাশিয়া’; ‘মাও সেতুং ও চীন’ আর ‘বাংলাদেশ ও সমাজতন্ত্র’। এই পঞ্চখ-ের গ্রন্থটির দুই খ- প্রকাশ করেছে অঙ্কুর প্রকাশনী। প্রথম খ- ‘ফরাসী বিপ্লব’-এ একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দার্শনিক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীÑ ভলতেয়ার, রুশো, দিদরো প্রমুখ। জনগণকে বিপ্লবের পথে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন তারই কথা ব্যক্ত করেছেন। সেই সময়ের ফরাসী রাষ্ট্রীয় ও সমাজ কাঠামোতে বিদ্যমান ছিল প্রচুর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব। ফলে সামন্ততান্ত্রিক রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রবর্তন বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়ে। কৃষক-শ্রমিক-কারিগর ও বুর্জোয়ারা এই বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল। এই বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ ঘটে বটে, কিন্তু স্বাধীনতা-সমতা-ভ্রাতৃত্বের মন্ত্রে আপ্লুত হয়ে যে প্রজাতন্ত্র-রাষ্ট্রের সৃষ্টি করার কথা ছিল তা না-হয়ে ফ্রান্স পরিণত হয় একটি বুর্জোয়া-রাষ্ট্রে। বুর্জোয়াশ্রেণী ও শ্রমশ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষটিÑ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণÑ ঠিকই বহাল থাকে। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করলেও শ্রমিক-কৃষক-কারিগর শ্রেণীকে অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ও ধনীশ্রেণীর প্রতি শ্রমশ্রেণীকে অনুগত রাখার একটি কার্যকরী কৌশল হিসেবেÑ রাজনীতিতে আসার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে বুর্জোয়াশ্রেণী। ‘বুর্জোয়ারা সামন্ততন্ত্র ভেঙে তার ধ্বংসের ওপর সৃষ্টি করে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাÑ অবাধ প্রতিযোগিতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আইনের চোখে সমস্ত পণ্য-মালিকদের সমানাধিকার ইত্যাদি পুঁজিবাদী আশীর্বাদের রাজত্ব। শ্রমিকদের জন্য আজীবন মজুরি শ্রমের ব্যবস্থা।’ Ñ ‘ফরাসী বিপ্লব’, ২০১৪, অঙ্কুর প্রকাশনী। আর দ্বিতীয় খ- ‘কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস’-এ লেখক সর্বহারাশ্রেণীর শিক্ষা-বিস্তারে মার্কস ও এঙ্গেলসের জীবনী তুলে ধরার মাধ্যমে ‘ডেমোক্রিটিয় ও এপিক্যুরিয় প্রকৃতির দর্শনের পার্থক্য’; ‘রাইন অঞ্চলের সংবাদপত্র’ ও ‘অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া’; ‘ফয়েরবাখ সম্পর্কিত থিসিসসমূহ’, ‘জার্মান ভাবাদর্শ’ ও ‘দর্শনের দারিদ্র্য’; ‘কম্যুনিস্ট লীগ’; ‘কম্যুনিস্ট পার্টির ইশতেহার’; ‘জার্মানিতে কম্যুনিস্ট পাটির দাবিসমূহ’, ‘রাইন অঞ্চলের নূতন সংবাদপত্র’; ‘নিউইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউন’; ‘পুঁজি’; ‘আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রমজীবী সমিতি’; ‘ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ’, ‘জার্মান সোশ্যাল-ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’; ‘মার্কসবাদ’ বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। এমনকি বিজ্ঞানসম্মত মার্কসবাদ ও মার্কসবাদী দর্শনের ‘দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদ’-এর শ্রেণী-প্রকৃতি ও বাস্তব-প্রকৃতি সম্বন্ধেও আলোচনা করেছেন। আর ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে কার্ল মার্কসের পরবাসী জীবনকালে রচিত ‘অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া’ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘এর বিষয়বস্তু হচ্ছেÑ শ্রমের মজুরি, পুঁজির মুনাফা, ভূমির খাজনা এবং বিচ্ছিন্ন করা শ্রম। পুঁজি ও শ্রমের এন্টিথিসিস। ব্যক্তি সম্পত্তি ও শ্রম, ব্যক্তি সম্পত্তি ও কম্যুনিজম, বুর্জোয়া সমাজে অর্থের দাপট একটি বিশাল অংশ সমগ্রভাবে হেগেলীয় ডায়ালেকটিক এবং দর্শনের পর্যালোচনার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।’
×