ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সমুদ্র হক

বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৬:৩৯, ২০ মে ২০১৬

বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

পাঁচ অধ্যায়ে রচিত বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আক্ষরিক অর্থেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি দলিল হয়েছে। এই বইয়ের বিশেষায়িত দিক হলো- ইতিহাসের আলোকে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা কয়েকটি পর্বে টেনে আনা হয়েছে। লেখক এই কাজ করতে গিয়ে অনেক রেফারেন্স পড়ে ঘটনাগুলোকে বিশ্বাসযোগ্যতা করাতে সমর্থ হয়েছে। প্রথম অধ্যায়েই তিনি টেনে এনেছেন খুলনার ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অবস্থান। যা পাঠ করে একটি অঞ্চলের সার্বিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে ভাষা আন্দোলন ও পরবর্তী পরিস্থিতি। যুক্তফ্রন্ট ও আইয়ুবি নিপীড়ন এমনভাবে তুলে এনেছেন যা বর্তমান প্রজন্ম ও বর্তমানের রাজনীতিকদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কি ছিল সেদিন। তৎকালীন বিরোধী আন্দোলন কি ভাবে অসাম্যের কবলে পড়ে তার চিত্র তুলে ধরেছেন যা বর্তমানের অশনী সঙ্কেতের আভাস দেয়। এই কঠিন বাস্তবতা উপস্থাপন করে লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। খুলনার মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনার আগে তিনি টেনে এনেছেন কি ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছে। যেখানে এসেছে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঐতিহাসিক ৬ দফা, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন। একটি অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি নিখুঁতভাবে পূর্বের সকল ইতিহাস টেনে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব এমনভাবে এনেছেন যা পাঠ করে দেশের ওই সময়ে সার্বিক সকল চিত্রই উঠে আসে। সবচেয়ে বড় পর্বটি হলো চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি মাও অনুসারীদের অবস্থান এবং রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির মূল্যায়ন। এই দুই মূল্যায়ন পুরো বইটিকে সফলতা এনে দিয়েছে। চীন ও রুশপন্থীদের নিয়ে এমন উপাখ্যান চোখে পড়েনি। তবে আলাদা ও বিচ্ছিন্নভাবে এ যাবত যা লেখা হয়েছে তা সহজ ভাষায় নয়। এই ক্ষেত্রে গৌরাঙ্গ নন্দী যে কাজটি করেছেন তা সহজ পাঠ্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কোন গোষ্ঠীর কি প্রভাব ছিল তাও উঠে এসেছে। তবে তা খুবই স্বল্প পরিসরে। চতুর্থ অধ্যায় থেকে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা। গল্লামারী, ফরেস্ট ঘাট, চুকনগর, বাদামতলা, দোয়াড়া, ডাকরা, শাখারী কাঠি ঝাউডাঙ্গার গণহত্যার ঘটনাগুলো পড়তে গিয়ে পাঠকের ধারণা হবে কতটা নিষ্ঠুর ছিল হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসর এ দেশীয় রাজাকার। কোন অংশ পাঠ করতে গিয়ে ক্রোধ সামলানো যায় না। লেখকের সার্থকতা এখানেই। এই অধ্যায়ের সবচেয়ে বড় দিক হলো মুখোশ উন্মোচন করা। যেখানে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর খান, পিস কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী, জামায়াতে ইসলামী মাওলানা এক ইউসুফ ইত্যাদির ভূমিকা চোখ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে এসেছে প্রতিরোধ যুদ্ধ। এই পর্বে আছে খুলনার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ, বাগেরহাট সদর থানা আক্রমণ, ডুমুরিয়ার মজিদ বাহিনীর লড়াই, মুক্তাঞ্চল চিরুলিয়া বিষ্ণপুর, বিষ্ণপুর ঘাঁটির যোদ্ধারা, দুই বীর নৌ সেনার শহীদি মৃত্যু, পাকিস্তানী সেনাদের পিছু হটা, বোয়ালিয়ায় রাজাকারদের আক্রমণ, কাপালিডাঙ্গায় রাজাকারদের ক্যাম্প দখল, ১৪ জন মুক্তি সেনার করুণ মৃত্যু, সাতক্ষীরা পাওয়ার হাউস আক্রমণ, কপিলমুনির যুদ্ধ, শিরোমনির ট্যাঙ্ক যুদ্ধ, ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে লড়াই। প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘটনাগুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তবে কোন কোন অংশে একটু হোঁচট খেতে হয়েছে। মনে হয়েছে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো প্রতিটি পয়েন্ট বিশদভাবে উঠে এলেই ভাল হতো। বইটির নাম বৃহত্তর খুলনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সেখানে খুলনা অঞ্চলের ঘটনার বিস্তারিত না থাকলে পাঠকের অতৃপ্ত রয়ে যেতে পারে। এই অংশে ডুমুরিয়ায় মজিদ বাহিনীর লড়াই মুক্তাঞ্চাল চিরুলিয়া বিষ্ণপুর অংশটি সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা এ দেশকে মুক্ত করতে জীবন বাজি রেখে কিভারে লডাই করেছে তার চিত্রগুলো পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলো খুব সহজভাবে উপস্থাপিত হওয়ায় সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে হৃদয়গ্রাহী হবে। শেষ অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরবর্তী ঘটনাগুলো সংবাদপত্রের পাতায় কি ভাবে এসেছে তা তুলে ধরা হয়। সঙ্গে কয়েক মুক্তিযোদ্ধার সাক্ষাতকারও নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বইটি একটি ডকুমেন্টারি। প্রজন্মরা জানতে পারবে পূর্বসূরি মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা কথা। বইয়ের প্রচ্ছদটি আরও ভাল হতে পারত।
×