ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মালেক

নিউইয়র্ক বইমেলার ২৫ বছর ও কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২১ মে ২০১৬

নিউইয়র্ক বইমেলার ২৫ বছর ও কিছু কথা

আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে তখন কেবল শুরু হয়েছে বাঙালী সাধারণ ইমিগ্রান্ট মানুষের আনাগোনা। নব্বইয়ের প্রথম ভাগে ওই রকম ক্ষুদ্র কমিউনিটিতে মেলার আয়োজন তাও আবার বাংলা পুস্তক মেলা ব্যাপারটা সত্যি অভাবনীয়। কিন্তু ১৯৯২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে নিউইয়র্ক নগরের ব্রুকলিন ও কুইন্স এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল তিন দিনব্যাপী বইয়ের এক মেলা। মেলাটির উদ্বোধন করেছিলেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক ড. জ্যোতি প্রকাশ দত্ত। এর পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয় মেলারও উদ্বোধন করলেন বাংলা সাহিত্যের আর এক খ্যাতনামা কবি শহিদ কাদরী। ’৯৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী ড. জাফর ইকবালের হাত দিয়ে বইমেলার পদার্পণ ঘটল তৃতীয় বছরে। মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিত সাহা একক প্রচেষ্টায় এভাবেই প্রতিবছর অক্লান্তভাবে আয়োজন করে যেতে লাগলেন মেলাটির। শুধু নিউইয়র্ক নগরেই নয়Ñ বাংলাভাষী অধ্যুষিত আমেরিকার অনেক শহরের বুকের পাঁজরেও লেখা হলো মুক্তধারা আয়োজিত পুস্তক মেলার ইতিকথা। বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানের ছোট ছোট আয়োজন ঘটেছে ইমিগ্র্যান্টদের এই দেশে। সেগুলো অবশ্য বৃহত্তর পরিসরে কোন ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখে যেতে পারেনি। নব্বইয়ের দশকে উত্তর আমেরিকার প্রবাসী মানুষ মিলিতভাবে তৈরি করেছিলেন ‘ফেডারেশন অব বাংলাদেশী ন্যাশনালস’ সংক্ষেপে ‘ফোবানা’ নামের একটি আমব্রেলা সংগঠন। ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে আহ্বায়ক হিসেবে ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের প্রধান ইকবাল বাহার চৌধুরী। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও জাঁকজমকের সঙ্গে ফি বছর এই উপলক্ষে নানা শহরে-নগরে বাংলাদেশী মানুষ সমবেত হতেন আক্ষরিক অর্থেই এক মিলনমেলায়। সমাবেশ ঘটত দুই বাংলার নামী-দামী কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ, গায়ক-গায়িকা, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের। তারপর দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্মেলন হিসেবে শুভারম্ভ ঘটেছিল উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের। শিকাগো, নিউইয়র্ক, ডালাস, লস এঞ্জেলেস এই রকম আরও অনেক শহরে সাহিত্য সম্মেলনেও পদার্পণ করেছেন উভয় বাংলার প্রখ্যাত সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীরা। বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক ডাঃ সিরাজুল্লাহ এবং দিদারুল আলম পান্নার প্রচেষ্টায় প্রথম সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় শিকাগোতে। হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে তৃতীয় অবিস্মরণীয় সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় নিউইয়র্ক বহেমিয়ান পার্কে। ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ পাঠিকা ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক দিলারা হাসেম ছিলেন এর আহ্বায়ক। সর্বাত্মক সহযোগিতায় ছিলেন সাইদ-উর-রব, প্রয়াত মোজাম্মেল হোসেন মিন্টু ও দেওয়ান শামসুল আরেফিন প্রমুখ। সম্মেলনের সদস্য সচিব ছিলাম আমি। অবশেষে এই দুটো প্রতিষ্ঠানই এক সময় ঢেউ হয়ে ভেঙ্গে যেতে যেতে হয়ে গেল বহুধাবিভক্ত। ফলে প্রবাসী বাঙালীর সমবেত হবার জন্য রইল না আর কোন একক মঞ্চ। বিশ্বজিত সাহা এক সময় সাংবাদিক ছিল। আসলে ‘ছিল’ বললে একটা দারুণ অশুদ্ধ শব্দ বলা হয়। এক সময়ে যে মানুষ এই জীবনের ফ্রেমে বন্দী হয়ে যায় তার বন্ধনমুক্তি আর ঘটে না। সমগ্র জীবনব্যাপী তাকে সাংবাদিকই রয়ে যেতে হয়। ওর নামটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল যখন প্রবাসে সাংবাদিকতার কাজ শুরু করেছিলাম সদ্য প্রকাশিত ‘আমার দেশ’ নামে একটি সাপ্তাহিকীতে। প্রবীণ সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহর সম্পাদনায় নিউইয়র্ক থেকে প্রথম প্রকাশিত ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করত সে। প্রসঙ্গক্রমে বলি, প্রবাসীর পর নিউইয়র্ক থেকে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ঠিকানার। তারপর একে একে বাজারে এসেছিল আরও তিনটি বাংলা পত্রিকা। অপ্রাসঙ্গিক হলেও নিজের অভিজ্ঞতা ভাগ করে বলতে ইচ্ছে করছে তখন বিদেশের মাটিতে জুতো সেলাই থেকে চ-িপাঠ পর্যন্ত ছিল একজন সাংবাদিকের কাজের অন্তর্ভুক্ত। ‘ঠিকানার’ মালিক এবং সম্পাদক এমএম শাহীন আমাকে সে সময়টিতে তার পত্রিকায় যোগ দেয়ার জন্য অনুরোধ করে বললেন, তিনি শীঘ্রই দেশে যাচ্ছেন এবং সে কারণে আমার হাতে তুলে দিতে চান পত্রিকাটির সামগ্রিক দায়িত্ব। যোগদানের কয়েকদিনের মাথায় শাহীন ভাই দেশে ফিরে গেলেন। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি পরবর্তীতে নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় সংসদের সদস্য। ঠিকানায় যোগদানের পর বিশ্বজিতের সঙ্গে গড়ে উঠল এক অকৃত্রিম সম্পর্ক এবং এই সুবাদে হয়ে গেল আমার ছোট ভাইয়ের মতো। জানতাম অবকাশে সে বইয়ের ব্যবসা করছে এবং যে কাজের শুরু নিজ বাড়ি থেকে। এক সময় ব্যবসাটি ছড়িয়ে দিতে শুরু করল আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য ও কানাডায়। শুধু তাই নয়, জ্যাকসন হাইটসের প্রাণকেন্দ্রে চালু করল মুক্তধারা বুক স্টোর। এভাবেই বিশ্বজিত সাহা নামের পরিশ্রমী প্রবাসী যুবকটি হয়ে উঠতে লাগল ভাগ্যের বরপুত্র। বাণিজ্য বসতে লক্ষ্মীই শুধু নয়, বীণাপাণিও যুক্ত হলেন সেই সাধনায়। শ্রাবণের মেঘের ভেতর যেরকম থাকে বর্ষণ সেভাবে এক ব্যবসায়িক বিকিকিনির মাঝেও যে থাকতে পারে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিশাল বৃষ্টিধারা কে জানত। মনে পড়ে সেদিন ঠিকানায় এক দুপুরে হঠাৎ বিশ্বজিত ফোন করল যে, আজ মুক্তধারায় বসছেন ঢাকা ও কলকাতার তিনজন দিকপাল সাহিত্যিক, যারা হচ্ছেনÑ সমরেশ মজুমদার, হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলন। ও বলে ভাবিকেও সঙ্গে আনবেন। কাজটাজ গুছিয়ে রেখে রওনা হলাম দ্রুততার সঙ্গে। বাড়িতেও অর্ধাঙ্গিনীর কাছে আমন্ত্রণটা পৌঁছে দিলাম। দোকানে মোটামুটি অনেক ক্রেতাকেই দেখা গেল। বলাবাহুল্য, স্টোরের অধিকাংশজুড়েই ছিলেন মহিলা এবং তারা অল্প বয়সী ক্রেতা। কেউ হুমায়ূন আহমেদ, কেউ ইমদাদুল হক মিলন, কেউবা সমরেশ মজুমদারের মতো দুর্লভ ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে চাক্ষুষভাবে পেয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত। এরা দেশে থাকতে কখনও এসব প্রিয় লেখকের এত ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের কথা ভাবতেও পারেননি। বই কেনার পর লেখকদের স্বাক্ষর নিতে গিয়ে কলকল স্বরে কথা বলতে বলতে ছবি তুলছিলেন সবাই। উপস্থিতজনদের কেনাকাটা ও কথা বলার অবকাশে লেখকদের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম আমি। ওখান থেকেই সমরেশ মজুমদারের সঙ্গে পরিচয়; পরবর্তীতে যেটা প্রগাঢ় হয়ে গড়ে উঠেছিল কমিউনিটির সঙ্গে, আমার সঙ্গেও। পরবর্তী মেলাগুলোতে ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা হয়েছিল সুনীল ও শীর্ষেন্দুসহ প্রখ্যাতজনদের সঙ্গে। নিউইয়র্কের বই উৎসব বরাবর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে সরকারী বিদ্যালয়ের বিরাট লবি, অডিটোরিয়াম ও খেলার মাঠজুড়ে। ত্রয়ী সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার, হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনকে মুক্তধারার সঙ্গে অচ্ছেদ্যবন্ধনে বাঁধা হতে দেখেছিলাম। তারা ছাড়াও আসতে লাগলেন সৈয়দ শামসুল হক, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামীসহ উভয় বাংলার নামী-দামী সাহিত্যিকবৃন্দ। আগমন করতে শুরু করলেন বাংলাদেশ, ভারত, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ থেকে বহু গুণীজন ও প্রকাশনা সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত দুই বাংলার অনেক শিল্পী ও কলাকুশলী বইমেলা আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন। দেশ থেকে হুমায়ূন আহমেদ প্রায় প্রতিবারই এতে যোগ দিতেন। ওই শহরে হাসপাতালে জীবনের শেষ দিনগুলোতে বিশ্বজিত ও তার স্ত্রী ছিল অসুস্থ এই লেখকের পাশে। প্রথম দিকের মেলাগুলো অনুষ্ঠিত হতো যথাযথ নিয়মে ফেব্রুয়ারি মাসে। কিন্তু সে মাসে নিউইয়র্কে আসে যেমন তীব্র শীত, তেমনি তুষারপাত। বিশ্বজিত সিদ্ধান্ত নিল মেলাটি গ্রীষ্মের উষ্ণতায় সরিয়ে আনতে। তারপর থেকে এপ্রিল ও মে মাসে সেটি চলে এলো। আন্তর্জাতিক বাংলা উৎসব ও বইমেলার ২৫ বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছর। ২০ থেকে ২২ মে পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী রজতজয়ন্তীর মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিউইয়র্ক বাঙালীর প্রাণকেন্দ্র জ্যাকসন হাইটসে। একটা কথা বলা আবশ্যক, বিশ্বজিতের এই সুদীর্ঘ পথ চলায় তার পাশে দাঁড়িয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন প্রবাসের অনেক কবি, সাহিত্যক, সাংবাদিক সংগঠক, সমাজসেবী ও নানা পেশায় নিয়োজিত শুভানুধ্যায়ীরা। আজ নির্দ্বিধায় বলা যায়, মুক্তধারার এই আয়োজন বহুধাবিভক্ত কমিউনিটিকে গ্রথিত করেছে এক সূত্রে। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট [email protected]
×