ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মীম নোশিন নাওয়াল খান

সুমনের স্বপ্ন

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২১ মে ২০১৬

সুমনের স্বপ্ন

সুমনের মন ভাল নেই। বাবা বলেছে এখন থেকে তাকে আর স্কুলে যেতে হবে না। অনেকদিন ধরেই বাবা এটা বলছিল, কিন্তু বড় চাচার কথায় আজকে বেশ জোর দিয়েই বলেছে। বড় চাচা বলেছে, আমরা কৃষক মানুষ, ক্ষেতে-খামারে কাজ করি। আমাগো ছেলেপুলেও তাই করব। এত লেখাপড়া শিইখা কী হইব? বাবা বড় চাচার সঙ্গে একমত। এত লেখাপড়া শিখে কোন লাভ নেই। লেখাপড়া করলে তো আর তিনবেলা খাবারের যোগাড় হবে না। বরং সময় নষ্ট। বইখাতা কিনতে টাকাও অপচয় হচ্ছে। বাবা আজকে চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দিয়েছে, সুমনের আর লেখাপড়া করা হবে না। সুমন সেই থেকে মন খারাপ করে বাড়ির পেছনের পুকুরপাড়ে বসে আছে। লেখাপড়া তার খুব ভাল লাগে। কিছুদিন আগে মাসুম ভাই গ্রামে এসেছিল। মাসুম ভাই সুমনদের গ্রামের ছেলে। সে বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। মাসুম ভাই ওদেরকে বিমানবাহিনীর অনেক গল্প করেছে। সেই থেকে সুমনের ইচ্ছে সে বিমানবাহিনীতে যোগ দেবে, পাইলট হবে। তখন থেকে সে খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করছে। স্কুল-কলেজ পেরিয়ে সেও মাসুম ভাইয়ের মতো বিমানবাহিনীতে যাবে। কিন্তু বাবার কথায় সুমনের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সে মাত্র ক্লাস এইটে উঠেছে। বাবা এখনই তার লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে চান। বিকেলে বাবা সুমনকে ডেকে ক্ষেতে নিয়ে গেল। এখন থেকে তাকে ক্ষেতের কাজকর্ম শিখতে হবে। এখন চারা বোনার সময়। ক্ষেতে বোরো ধানের চারা বোনা হচ্ছে। বাবা সুমনকে দেখিয়ে দিল কিভাবে চারা বুনতে হয়। তারপর মাথায় হাত রেখে বলল, দু’দিন বাদে তুই নিজেই অনেক ভাল বুনতে পারবি। আমার পোলা আমার চেয়েও ভাল পারব। আমি জানি। সুমন মাথা নিচু করে রইল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্ষেতে কাজ করে যখন রাত নামতে শুরু করল, তখন বাবা বলল, চল, এবার বাড়ি যাই। সুমন বলল, আপনি যান। আমি আইতাছি। হেঁটে হেঁটে স্কুলের দিকে গেল সুমন। স্কুলমাঠ ফাঁকা। স্কুলঘরগুলোর দরজায় তালা মারা। এই স্কুলে তার আর কখনই পড়তে আসা হবে না। কথাটা মনে পড়তেই চোখে পানি চলে এলো তার। একা একা মাঠের এক কোণে গিয়ে ঘাসের উপরে বসল সে। আস্তে আস্তে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। আকাশে অনেক তারা। সুমন একদৃষ্টে তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। ঐ তারাগুলো যেমন অনেক অনেক দূরে, তাদেরকে ছোঁয়া যায় না, তার স্বপ্নটাও এখন তারার মতো দূরে চলে গেছে। ভাবতে ভাবতে আবারও চোখ ভিজে উঠল তার। কারোর একজনের পায়ের শব্দ পেয়ে সুমন তাড়াতাড়ি উঠে বসে পেছন তাকাল। মনির স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। স্যার অঙ্ক পড়ান, তাঁর বাড়ি স্কুলের পাশেই। মনির স্যার সুমনের কাছে এসে দাঁড়ালেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে সুমন? তুই এখানে শুয়ে আছিস কেন? আজকে স্কুলে আসিসনি কেন? শরীর ঠিক আছে? সুমন এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। স্যারকে একটু একটু করে সবটা খুলে বলল। স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, আমি তোর বাবার সঙ্গে কথা বলব। তুই মেধাবী ছাত্র। তোর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে- এটা আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। সুমন করুণ গলায় বলল, আব্বা কারোর কথা শুনব না স্যার। আমি অনেক বুঝানোর চেষ্টা করছি, আম্মাও বলছে। আব্বা শুনব না। স্যার কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর সুমনের পাশে গিয়ে বসলেন। তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ঠিক আছে। না শুনলে শুনবে না। তুই তাঁকে শোনাবি। তোর আব্বা তোকে স্কুলে আসতে দেবে না, তাই তো? ঠিক আছে, স্কুলে তকে আসতে হবে না। আমি হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলব। তুই বাসায় বসে পড়বি। ক্ষেতের কাজ শেষ করে রাতে আমার কাছে অঙ্ক দেখে যাবি। পরীক্ষার সময় শুধু এসে পরীক্ষা দিবি। সুমন মাথা নেড়ে বলল, আমি একা একা পইড়া কেমনে পরীক্ষা দিব স্যার? স্যার বললেন, সবকিছুর জন্য ইচ্ছেশক্তি দরকার সুমন। তুই পারবি। আমি হেডস্যারের সঙ্গে কথা বলব। তোর যখন যা বুঝতে অসুবিধা হয়, তুই স্যারদের বাসায় গিয়ে বুঝে নিবি। সবাই তোকে সাহায্য করবে। আর তুই দেখিস, যদি তুই জেএসএসি পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে পারিস, বৃত্তি পাস- তোর বাবা আর লেখাপড়ার ব্যাপারে আপত্তি করবেন না। সুমন মুখ তুলে বলল, আব্বায় যে কয় লেখাপড়া করলে খালি খালি টাকা নষ্ট হয়? স্যার বললেন, স্কুলের তহবিল থেকে তোর লেখাপড়ার খরচ দেয়া হবে। আর স্কুল যদি না দেয়, তাহলে আমি দেব। সেই চিন্তা করিস না। তুই শুধু ভাব, যেমন করে হোক, তোর স্বপ্ন তোকে পূরণ করতেই হবে। একবার ভাব, যেদিন তুই সত্যি সত্যি পাইলট হয়ে গ্রামে ফিরে আসবি, তোর বাবা-মা তোকে নিয়ে গর্ব করবে। আমরা তোকে নিয়ে গর্ব করব। লেখাপড়া শিখে মানুষ তো তোকে হতেই হবে সুমন, আমাদের মান রাখার জন্য হতে হবে। সুমন আরেকবার আকাশের দিকে তাকাল। তারাগুলো মিটমিট করছে। কে বলেছে তারাগুলোকে ছোঁয়া যায় না? সে ঠিক ওই তারাগুলো ছুঁয়ে দেখাবে, সে তার স্বপ্নটাকে ছুঁয়ে দেখাবে ইচ্ছে থাকলে সব সম্ভব। পাইলট সে হবেই।
×