ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২২ মে ২০১৬

লে. জেনারেল জিয়ার হত্যাকাণ্ড প্রশাসকের বয়ান

(২১ মের পর) তার পরও দেখা গেল সবাই তার মতো ভাবছিলেন না। সেনাবাহিনীর একটি অংশ যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা জিয়ার রাজনীতি পছন্দ করছিলেন না। তার সহকর্মীদের অনেকের ধারণাও ছিল ভিন্ন। তারা মনে করতেন সেনাবাহিনীকে তিনি নষ্ট করছেন। তার নিজের দলেও দ্বন্দ্ব দেখা দিচ্ছিল। ৪০ জন এমপি নিয়ে মওদুদ আহমদ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আরও অংশীদারিত্ব দাবি করছিলেন। ফল হলো, মওদুদকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। বিভিন্ন জেলায় অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠল। এ রকম স্থানীয় একটি দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠলে জিয়া চট্টগ্রাম এসেছিলেন যা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। ॥ চার ॥ জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, ৩১ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসের দৃশ্য ছিল সধপধনৎব. গাড়ি বারান্দায় লাশ, দোতলার কিছু অংশ ঝুলে পড়েছে। পুলিশ বাহিনী ছন্নছাড়া। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। প্রথমেই তিনি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যারা এসেছিলেন তাদের খোঁজ করলেন। কিছুক্ষণ পর পাংশুবর্ণ বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আমেনা রহমান ও অন্যরা সার্কিট হাউসের বাইরে এলেন। আক্রমণ হওয়ার সময় স্নানঘরে বা বিছানার তলায় তারা লুকিয়ে ছিলেন। জিয়াউদ্দিনদের দেখে তারা কক্ষ ছেড়ে বেরুলেন। সেই সময়ই তারা সার্কিট হাউস ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলেন। জিয়াউদ্দিন তাদের গাড়ি বারান্দায় জড়ো হতে বললেন, যাতে তাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। তিনি যখন কমিশনার ও অন্য পুলিশ অফিসারদের জটলার দিকে এগোচ্ছিলেন তখন দেখলেন ওয়্যারলেস সেট হাতে পুরো ইউনিফর্ম পরে লে. কর্নেল মাহফুজ সার্কিট হাউস থেকে বেরুলেন। জটলা থেকে ৫০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে তিনি ওয়্যারলেসে কথা বলছিলেন। কথা শেষ করে তিনি জটলার কাছে এসে জানালেন, তিনি সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি তাদের জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশকারীরা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে। তাদের তিনি জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতির মরদেহ ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে। মাহফুজের মতে, জেনারেল এরশাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে হেলিকপ্টারে যে কোন সময় পেঁৗঁছতে পারেন। রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্ট ও পুলিশকে নির্দেশ দিলেন রাষ্ট্রপতির মরদেহের দিকে লক্ষ্য রাখতে। তাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছিল না বরং বেশ শান্ত দেখাচ্ছিল। গত রাতের ঘটনাবলীর কোন বিবরণও তিনি দিলেন না। শুধু বললেন, আক্রমণকারীরা তার কক্ষ লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। তিনি বিছানার নিচে আশ্রয় নেয়ায় বেঁচেছেন। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, পরে তিনি গুলির দাগ দেখিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলো ছিল পেছনের দেয়ালে, দরজায় গুলির আঘাতের কোন চিহ্ন ছিল না। মাহফুজের শান্ত মনোভাব এবং যে ভঙ্গিতে তিনি এরশাদ ও মোস্তাফিজের সঙ্গে কথোপকথনের বিবরণ দিলেন তাতে কোন উত্তেজনা ছিল না। তার এই ভাবলেশহীন ব্যবহার জিয়াউদ্দিনদের অবাক করেছিল। ঢাকা থেকে ক্যু হয়েছে এই সন্দেহটা তারা বাতিল করলেন। কারণ ক্যু হলে ওই দুজন বিশেষ করে মোস্তাফিজ থাকেন কীভাবে? মাহফুজের বক্তব্য যাচাই করার সময় বা অবস্থা তাদের ছিল না। ভোরেই ঢাকার সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ রহস্যজনকভাবে ছিন্ন হয়ে গেছে। আগে কমিশনার জানিয়েছিলেন তিনি স্বরাষ্ট্র সচিব বা মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। একজনের সঙ্গে শুধু যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন তিনি হলেন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সাদিক। রাষ্ট্রপতির হত্যার খবর শুনে তিনি জানিয়েছিলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি ফের কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। মিনিটখানেক কথা বলার পর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মাহফুজের কথায়ই তাদের আস্থা রাখতে হলো। জিয়াউদ্দিন ভাবছিলেন, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আগত মন্ত্রী ও নেতাদের কোথায় রাখা যায়। ডাঃ বদরুদ্দোজা চৌধুরী জানালেন, তার নিজস্ব রেস্ট হাউস আছে। সেখানে তিনি উঠবেন বলে চুপচাপ ব্যক্তিগত একটি গাড়িতে করে চলে গেলেন। রাষ্ট্রপতির স্টাফদের কমিশনার বললেন তার বাড়িতে রাখতে পারবেন। মাহফুজ সার্কিট হাউস ত্যাগ করে সেখানে যেতে চাইলেন, যদিও একটু আগেই বলেছিলেন সেনাপ্রধান আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসছেন। মাহফুজ আর জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক লে. কর্নেল মাহতাব ও এডিসি চলে গেলেন কমিশনারের সঙ্গে। ডিসি অন্যদের বিভিন্ন রেস্ট হাউসে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। সকাল সাতটার সময় জিয়াউদ্দিন এসপিকে নিয়ে ডিসির বাসায় ফিরলেন। বাসায় ফিরতে ফিরতে গার্ড দৌড়ে এসে জানাল, চট্টগ্রাম বেতার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ক্যু হয়েছে এবং সেনাবাহিনী সরকারের ভার গ্রহণ করেছে। জিয়াউদ্দিন লিখেছেন, অচেনা একটি স্বর ঘোষণা করল, জিয়াউর রহমানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। নতুন নেতৃত্বের নাম ঘোষণা করা হবে। তিনি ঢাকা রেডিও স্টেশন ধরলেন। সেখানে নিয়মিত অনুষ্ঠান চলছে। জিয়ার হত্যার খবরও প্রচার করা হয়নি। তার তখন মনে হলো, বিদ্রোহটি স্থানীয়। ঢাকার সঙ্গে তিনি যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তিনি ঠিক করলেন কোর্ট বিল্ডিং যাবেন। সেখানে অফিসে বসার পর পুলিশ কমিশনারের ফোন পেলেন। তিনি জানালেন, কিছুক্ষণ আগে দুটি আর্মি জিপে কয়েকজন অফিসার এসে রাষ্ট্রপতির গার্ডদের বলেছেন মরদেহ একটি আর্মি ভ্যানে উঠিয়ে দিতে। মরদেহ নিয়ে তারা চলে গেছেন। পুলিশকে জানিয়ে গেছে, মরদেহ ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দশটার দিকে জিয়াউদ্দিন কমিশনারের ফোন পেলেন। কমিশনার জানালেন, একজন মেজর এসেছেন তাদের সঙ্গে আলাপ করতে। তিনি যেন কমিশনারের অফিসে চলে আসেন। ৫০০ গজ দূরে কমিশনারের অফিস। সেখানে ঢুকে দেখলেন সিভিলিয়ান পোশাকে একজন তরুণ বসে আছে। কমিশনার জানালেন, তিনি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার মেজর। চাটগাঁর জিওসি মেজর জেনারেল মনজুর তাকে পাঠিয়েছেন কমিশনার ও ডিসিকে ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যেতে আলোচনার জন্য। জিয়াউদ্দিন জানালেন, তিনি কি মনজুরের সঙ্গে কথা বলেছেন? কমিশনার জানালেন, মনজুরকে তিনি ফোনে পাচ্ছেন না। কী আর করা, তিনজন মিলে কমিশনারের গাড়িতে ক্যান্টনমেন্ট রওনা হলেন। যাওয়ার পথে মেজর জানালেন, জেনারেল মনজুর এখন চার্জে, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’। ক্যান্টনমেন্ট অস্বাভাবিকভাবে নীরব। জিওসির অফিসের গেটের সামনে গাড়ি থামানো হলো। আগে জিওসির অফিস পর্যন্ত গাড়ি যেত। গেট থেকে ২০০ গজ দূরত্বে জিওসির অফিসে হেঁটেই গেলেন তারা। জিওসির স্টাফ জানালেন, তিনি মিটিংয়ে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সঙ্গে দেখা করবেন। ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। ওয়েটিং রুমে বসেই দেখছিলেন, চারদিকে ব্যস্ততা। কর্দমাক্ত বুট পরে অফিসাররা দ্রুত যাওয়া-আসা করছেন। কয়েকজনকে তিনি চিনলেন। কিন্তু কেউ তাদের দিকে দৃকপাত করলেন না। জিয়াউদ্দিন নিজেদের ভাগ্য নিয়ে ভাবছেন এমন সময় স্টাফ অফিসার জানালেন, ঢাকা ছাড়া সব ক্যান্টনমেন্ট ‘ওকে’। কিন্তু ঢাকাকে এটি সমর্থন করতে হবে। এ বক্তব্যে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, বিদ্রোহটি স্থানীয়। এক ঘণ্টা পর স্টাফ অফিসার তাদের জিওসির রুমে নিয়ে গেলেন। অফিসার একটু আগেই তাদের নিয়ে ঢুকেছিলেন। কারণ তারা দেখলেন মনজুরের সিনিয়র কর্মচারীরা জড়ো হয়ে নিবিষ্টভাবে ঢাকা রেডিও শুনছেন। বিচারপতি সাত্তার ভাষণ দিচ্ছেন। বিচারপতি সাত্তারের শেষ বাক্যটি কানে গেল জিয়াউদ্দিনের। তিনি বলছেন, বিদ্রোহ দমন করা হবে। একজন অফিসার বললেন, ‘তাহলে এই কথা’। বক্তৃতা শেষ হতেই অফিসাররা বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। অফিসারদের মধ্যে ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল ও লে. কর্নেলরা ছিলেন। কেউই তাদের সঙ্গে কথা বললেন না। শুধু ব্রিগেডিয়ার আজিজ জিয়াউদ্দিনকে দেখে মাথা নাড়লেন। একজন লে. কর্নেল অস্ত্র হাতে ঘরে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। জেনারেল মনজুরের মুখ গম্ভীর, চুল এলোমেলো, চোখ রক্তাভ। তার আচরণ মৎঁভভ. তার সামনে ডেস্কে একটি রিভলবার। জিয়াউদ্দিন ভেবে অবাক হলেন যে, যে মনজুরের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করতেন তিনি চাটগাঁ থেকে কীভাবে একটি ক্যুর কথা ভাবলেন। ১৯৭৮ সালে চাটগাঁর জিওসির ভার গ্রহণের পর মনজুরের সঙ্গে তার পরিচয়। মনজুরের বুদ্ধিমত্তা, পড়াশোনা ও নমনীয় ব্যবহারের জন্য তার প্রতি শ্রদ্ধা জেগেছিল। মনজুরের কনিষ্ঠ বন্ধুরা তাকে ‘পণ্ডিত’ বলতেন। মনজুর ছিলেন খুবই ভদ্র, সিভিলিয়ান অফিসারদের সঙ্গে কাজের সময় সেনাবাহিনীর পদমর্যাদার ভাব দেখাতেন না। সামাজিকভাবেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল; তার বাসায় জিয়াউদ্দিন ও তার স্ত্রীকে কয়েক বার নিমন্ত্রণ করেছিলেন। জিয়াউদ্দিনের বাসায়ও নৈশভোজে সস্ত্রীক এসেছেন। জিয়াউদ্দিনের মনে হয়েছিল তার প্রতি মনজুর বন্ধুভাবাপন্ন। সামাজিকভাবে তাকে নিঃসঙ্গও মনে হয়েছে। সিভিলিয়ানদের সঙ্গে খুব কমই মিশতেন। তিন বছরের পরিচয়ে তার কখনও মনে হয়নি হঠাৎ করে মনজুর এমন একটি কাজ করবেন যাকে ‘কুইক্সোটিক’ বলা যায়। মনজুর ক্যু করেছেন এটাই ছিল এক ধরনের শক। কিন্তু আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। (চলবে)
×