ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাগরে ভাটা থাকায় রোয়ানুতে তাণ্ডব ঘটেনি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২২ মে ২০১৬

সাগরে ভাটা থাকায় রোয়ানুতে তাণ্ডব ঘটেনি

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত দু’ঘণ্টা ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু চট্টগ্রামের উপকূলজুড়ে প্রচ- গতির বাতাস কম-বেশি শক্তি প্রদর্শন করে স্থলভাগে উঠে যায়। উপকূলবাসীর ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। কারণ এ সময় সাগরে ছিল পূর্ণমাত্রার ভাটা। এ একটিমাত্র কারণে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু উপকূলজুড়ে তা-বলীলা ঘটাতে পারেনি। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর বাতাসের তা-বে বাড়িঘর ও গাছপালার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও উচ্চমাত্রার জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা ঘটেনি। দুপুর দেড়টার পর ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু উপকূল অতিক্রম করার সময় সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, হাতিয়া, সীতাকু- ও ফেনী দিয়ে স্থলভাগে উঠে আসে। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু নিয়ে ব্যাপক শঙ্কা যেমন ছিল, তেমনি মোকাবিলার প্রস্তুতিও ছিল। তবে সচিত্র পাল্টে যায় কর্ণফুলীর মোহনায় জোয়ার ভাটার পরিস্থিতির কারণে। শুক্রবার রাত ১২টার পর দিবসের প্রথম ভাটা শুরু হয়। এরপর শনিবার সকাল পৌনে সাতটার দিকে শুরু হয় জোয়ার। দ্বিতীয় ভাটা শুরু হয় দুপুর সাড়ে ১২টায়। আর এ সময় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু এর পূর্ণ শক্তি দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে। রোয়ানুর বাতাসের গতিবেগের বিপরীতে ভাটার গতিবেগ থাকায় জলোচ্ছ্বাস উপকূলের কোথাও সর্বোচ্চ ৪ ফুট অতিক্রম করতে পারেনি এবং সাগরের পানি কোথাও লোকালয় জুড়ে সয়লাব হতে পারেনি। এর ফলে জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যুর ঘটনা নেই বললেই চলে। চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, দুপুর দেড়টার পর উপকূলের কাছাকাছি এসে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু দ্রুতবেগে স্থলভাগের দিকে এগিয়ে যায়। বিকেল পেরিয়ে যাওয়ার পর এর পুরো পরিধি স্থলভাগে এসে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়। এ সময়ও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে কখনও হালকা, কখনও ভারি বাতাস, সঙ্গে হালকা বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। উপকূল অতিক্রম করার সময় ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে ঘূর্ণিঝড়টি ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে যায়। ফলে শঙ্কিত মানুষের সকল উৎকণ্ঠার অবসান ঘটে। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ভাবাস ছিল চট্টগ্রাম, মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরে ৭ নম্বর বিপদ সঙ্কেত এবং কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ছিল ৬ নম্বর সঙ্কেত। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে সরকারী নির্দেশে স্ব স্ব জেলা প্রশাসন এবার ছিল বহুগুণে তৎপর। রাতভর জেগে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় সব ধরনের প্রস্তুতি ছিল জেলা ও উপজেলা প্রশাসনগুলোর। সঙ্গে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোরও তৎপরতা কম ছিল না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাত মোকাবেলায় উপকূলীয় এলাকা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ লোককে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়া হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রীও প্রস্তুত রাখা হয়। শুক্রবার থেকে আবহাওয়ার তথ্য অনুযায়ী রোয়ানু গতিবেগ চট্টগ্রাম উপকূলমুখী হওয়ায় এখানকার মানুষের মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার জন্ম নেয়। সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও হালকা বাতাস শুরু হয়, যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। বেলা সাড়ে ১১টায় রোয়ানুর অগ্রভাগ পূর্ণমাত্রায় আঘাত হানতে শুরু করে। দুপুর দেড়টা পর্যন্ত ভারি বাতাস ও বৃষ্টিপাত নিয়ে এটি তা-ব চালিয়ে দুর্বল হয়ে স্থল নি¤œচাপে পরিণত হওয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টায় এ রিপোর্ট লেখার সময় চট্টগ্রামের সীতাকু- থেকে টেকনাফ উপকূল পর্যন্ত বড় ধরনের কোন ক্ষতির খবর মেলেনি। তবে এর গতিবেগ কখনও ৬২ কখনও ৮৮ কিলোমিটারে উঠানামা করে। এ সময় বহির্নোঙ্গর থেকে তিনটি জাহাজ নোঙ্গর ছিঁড়ে দুটি পতেঙ্গা ও একটি সন্দ্বীপ উপকূলে ছড়ায় উঠে যায়। চট্টগ্রামের চারটি উপজেলা সন্দ্বীপ, সীতাকু-, আনোয়ারা ও বাঁশখালীর যে সব স্থানে বেড়িবাঁধ ছিল না বা ভেঙ্গে গেছে সে সব স্থান দিয়ে লোনা পানি প্রবেশ করেছে। অপরদিকে, কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া দ্বীপের উত্তর অংশে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সমতল ভূমির সঙ্গে মিশে থাকায় সহজে পানি ঢুকেছে। তবে উচ্চমাত্রার কোন জলোচ্ছ্বাস না হওয়ায় এ দ্বীপেও প্রাণহানির কোন ঘটনা ঘটেনি। কুতুবদিয়া থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে, এলাকার উপজেলা সদরের মগডেইল সন্নিহিত এলাকা ছাড়া দ্বীপের পশ্চিমাংশের সর্বত্র লোনা পানি কম-বেশি প্রবেশ করেছে। তবে বাড়িঘর ও যানমালের ক্ষতি না হওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। অনুরূপভাবে কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, চকরিয়ায়ও কাঁচা বাড়িঘর চাপা পড়া ও গাছপালা ভেঙ্গে যাওয়া ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোন ক্ষতির খবর মেলেনি। আবহাওয়াবিদসহ অভিজ্ঞজনদের অভিন্ন সুরে বলা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু পূর্ণমাত্রায় যখন আঘাত হেনেছিল তখন সাগরে পূর্ণমাত্রার ভাটা চলছিল। ফলে পানির গতি বাতাসের গতির বিপরীতমুখী থাকায় উপকূল এলাকাকে রোয়ানু ল-ভ- করে দিতে পারেনি। প্রাণহানি ঘটিয়ে দেশজুড়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার জন্ম দিতে পারেনি। উপকূলের লাখ লাখ মানুষের মাঝে ফিরে এসেছে স্বস্তি। তারপরও ক্ষতি যা হয়েছে তা অনেকের জন্য বেশি। আবার অনেকের জন্য সামান্য। সব মিলিয়ে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু দ্রুতগতিতে আঘাত হেনে কম ক্ষতি ঘটিয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ভারি বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে এর শক্তির সমাপ্তি ঘটিয়েছে।
×