ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নবকুমারের রিক্সাচিত্র

সিনেমার চরিত্র, লোকায়ত জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতি, গাঢ় রঙে আঁকা

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ২২ মে ২০১৬

সিনেমার চরিত্র, লোকায়ত জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতি, গাঢ় রঙে আঁকা

মোরসালিন মিজান ॥ রিক্সার চেয়ে সাধারণ বাহন আর হয় না। দেশের প্রায় সব শহরেই আছে। আর ঢাকা তো রিক্সারই শহর ছিল একসময়। একসময় বলার যৌক্তিক কারণ এই যে, এখন আর অনিবার্য নয় রিক্সা। যানজটের কারণ দেখিয়ে মধ্যবিত্তের প্রিয় বাহনটিকে নির্বাসনে পাঠানোর সকল প্রক্রিয়া চলমান আছে। বলা চলে, রিক্সার শহরে মোটামুটি সংগ্রাম করেই টিকে আছে রিক্সা। আর টিকে আছে বলেই টিকে আছে চিত্রশিল্পের অনন্য সাধারণ একটি ধারা, যা রিক্সা পেইন্টিং নামে স্বতন্ত্র পরিচিতি ও মর্যাদা লাভ করেছে। একাডেমিক চর্চার বাইরে থেকেও, একদল শিল্পী দক্ষ হাতে ছবি আঁকেন। এঁকে যান। এরই ধারাবাহিকতা নব কুমার ভদ্র। পুরান ঢাকার শিল্পী অনেক বছর ধরে বিশেষ ধারাটি নিয়ে কাজ করছেন। আরও অনেকের মতোই সিনেমার ব্যানার আঁকতেন। রিক্সাকে চলমান শিল্পকর্ম হিসেবে গড়ে দিতেন। কিন্তু ছন্দপতন ঘটায় ডিজিটাল ব্যানার। বেকার হতে থাকেন শিল্পীরা। তবে আবেগ এবং আঁকার গুণ নিয়ে কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। তাদের অন্যতম নব কুমার। ২০১০ সালে তার প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। আর দ্বিতীয়টি অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে ধানম-ির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে। নীরবেই শেষ হয়েছে প্রদর্শনী। শেষ হয়েছে বটে। রেশ কাটেনি। এখনও যেন চোখে লেগে আছে। একক প্রদর্শনী হলেও, বেশ কিছু কাজ এতে উপস্থাপন করেন শিল্পী। লা গ্যালারির পুরোটাজুড়েই ছিল রিক্সাচিত্র। দেখে যারপর নাই অভিভূত হতে হয়েছে। নতুন করে দেখতে হয়েছে। প্রদর্শনীটির মধ্য দিয়ে আবারও সামনে এলো রিক্সা পেইন্টিং। ঐতিহ্যের অংশ হয়ে ওঠা এই ধারার কাজ বাঁচিয়ে রাখার সংরক্ষণের দাবি উঠল। চলমান রিক্সার গায়ে যে ধরনের চিত্রকর্ম সচরাচর দেখা যায়, নব কুমার তার বাইরে যাননি। মৌল বৈশিষ্ট্যগুলো আঁকড়ে ধরে উন্নত কিছু করে দেখানোর চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় তার কাজে। মোট শিল্পকর্মের ২৪টিতে প্লাস্টিক পেইন্ট। এনামেল পেইন্ট দিয়ে সাজিয়েছিলেন টিনের পাত। পেন্সিল স্কেচ করেছিলেন কাগজে। মিনিয়েচার শিল্পকর্ম হিসেবে প্রদর্শনীতে রাখা হয় শিল্পীর গড়া রিক্সা ও বেবিট্যাক্সি। ষাটের দশকে বাঙালীর বিনোদনের প্রধানতম মাধ্যম ছিল সিনেমা। প্রিয় নায়ক নায়িকাদের ছবি সংবলিত পোস্টার ক্যালেন্ডার ঘরে ঘরে শোভা পেত। এবং এই সিনেমাকেই বিপুলভাবে আশ্রয় করতেন রিক্সাচিত্রীরা। এখন বাংলা সিনেমা নিয়ে আবেগ কমে শূন্যের কোটায়। তাতে কী? নব কুমার পেছন ফিরে তাকান। উজ্জ্বল স্মৃতি কুড়িয়ে নিয়ে ততোধিক গাঢ় রঙে আঁকেন। তাতেই ফিরে আসে ‘সদর ঘাটের কুলি’, ‘তোলপাড়’, ‘মুখোশ’ ইত্যাদি জনপ্রিয় সিনেমা! লোকায়ত জীবন, ধর্ম বিশ্বাস ও ভাবনা দ্বারা যথারীতি প্রভাবিত হতে দেখা যায় শিল্পীকে। চারপাশের পৃথিবী ও কল্পনার রাজ্য ঘুরে অনুষঙ্গ খুঁজে নেন তিনি। নিজের মতো করে সাজান। শিল্পীর আঁকা ছবিতে পশু পাখি মাছ গাছ নদী ফুলÑ কী নেই? আবহমান গ্রাম বাংলার রূপ রিক্সাচিত্রের নিজস্ব ভাষায় উপস্থাপিত হয়। উজ্জ্বল রং আর রেখার ব্যবহারে অন্য সব আঁকাআঁকি থেকে আলাদা হয়ে ওঠে নব কুমারের ছবি। বিভিন্ন পোস্টারে ব্যানারে পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া ছবিগুলোকে সামনে রেখেই নিজের মতো করে গড়ে নেন তিনি। শিল্পভাষা দেন। এই শিল্পভাষা যেমন মুগ্ধ করে, তেমনি টিকে থাকার আকুতি জানায়! ২৯ এপ্রিল শুরু হওয়া প্রদর্শনী চলে ১৭ মে পর্যন্ত।
×