ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এভারেস্ট ছুঁতে গিয়ে বিপদের মুখে দুই বাঙালি

প্রকাশিত: ২৩:১৮, ২২ মে ২০১৬

এভারেস্ট ছুঁতে গিয়ে বিপদের মুখে দুই বাঙালি

অনলাইন ডেস্ক॥ শনিবার ভোর পাঁচটা ৪৬ মিনিট। যন্ত্র দেখাল, ৮,৮৪৮ মিটার। না, কোন ম্যাজিক নম্বর নয়। বিশ্বের সর্বোচ্চ বিন্দুর উচ্চতা। মাউন্ট এভারেস্ট! ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ছেলে সত্যরূপ সিদ্ধান্তের জিপিএস যন্ত্রের রিডিং ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখা যেতেই জানা গেল, তাঁর পা পড়েছে ওই উচ্চতায়। অর্থাৎ শৃঙ্গ ছুঁয়ে ফেলেছেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই নেপালের পর্বতারোহণ আয়োজক সংস্থার তরফে জানানো হয়, একা সত্যরূপ নন। শৃঙ্গ ছুঁয়েছেন আরও তিন বাঙালি— মলয় মুখোপাধ্যায়, রমেশ রায় এবং রুদ্রপ্রসাদ হালদারও। সঙ্গে সঙ্গেই উৎকণ্ঠা বাড়ে অন্য আরও চার জনের জন্য। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ শৃঙ্গ ছোঁয়ার জন্য ক্যাম্প ফোর থেকে চূড়ান্ত আরোহণ শুরু করেছিলেন সুনীতা হাজরা, পরেশ নাথ, সুভাষ পাল ও গৌতম ঘোষরাও। তাঁরা কি শৃঙ্গ ছুঁতে পারলেন? উদ্বেগ-আশঙ্কা-আতঙ্কের পারদ কয়েক গুণ চড়িয়ে শনিবার রাত ১০টা নাগাদ সর্বশেষ খবর পাওয়া গেল, নেপালের পর্বতারোহণ আয়োজক সংস্থার কর্ণধার লোবেন শেরপার থেকে। টেলিফোনে জানালেন, শৃঙ্গের একটু নীচেই, ‘সাউথ সামিটে’ রয়েছেন সুনীতা এবং সুভাষ। অত্যন্ত খারাপ আবহাওয়া এবং শারীরিক ক্লান্তি থামিয়ে দিয়েছে গতি। সঙ্গে রয়েছেন দু’জন শেরপা পাসাং এবং মিংমা। লোবেনের দাবি, দলের অন্য দুই সদস্য গৌতম এবং পরেশ তাঁদের দুই শেরপা লাকপা ও বিষ্ণুর সঙ্গে ক্যাম্প ফোরে পৌঁছতে পেরেছেন শনিবার রাত ৯টা নাগাদ। তবে এঁরা শৃঙ্গ ছুঁতে পেরেছেন কি না, শনিবার রাত পর্যন্ত তার নিশ্চিত খবর মেলেনি। চার নম্বর ক্যাম্প থেকেই বেসক্যাম্পের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন লাকপা। তাঁরাই সুনীতা ও সুভাষের খবর জানান। তবে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নামানোর পদক্ষেপ করতে পারেননি বলে জানিয়েছেন লোবেন। কারণ ক্যাম্প ফোরে পর্যাপ্ত সংখ্যক শেরপা নেই এই মুহূর্তে, যাঁদের পাঠানো যাবে সাউথ সামিট পর্যন্ত। সুনীতাদের দলের প্রতিনিধি বুদ্ধি শেরপা শুক্রবার রাত থেকেই বেসক্যাম্প থেকে ওয়াকিটকির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছিলেন ওই চার আরোহী ও তাঁদের সঙ্গী শেরপাদের সঙ্গে। টেলিফোনে বুদ্ধি জানালেন, বেলা একটা নাগাদ ওই দলের এক শেরপার সঙ্গে শেষ কথা হয় তাঁর। শৃঙ্গ ছোঁয়া হয়নি ওঁদের। তখনও চেষ্টা চলছে ওপরে ওঠার। ‘‘সঙ্গে সঙ্গে ওদের ফিরে আসার কথা বলেছিলাম আমি। এত দিনের অভিজ্ঞতা বলেছিল, এর পরেও চেষ্টা চালালে অক্সিজেনের অভাবে মারাত্মক বিপদের মুখে পড়বে ওরা,’’—উদ্বেগ ঝরে পড়ে বুদ্ধির গলায়। কিন্তু তারপর? তারপর কি ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেননি আরোহীরা? জানেন না বুদ্ধি শেরপা। জানে না বাংলার অভিযাত্রী মহল। জানেন না দিনভর টিভির পর্দায় চোখ রেখে বসে থাকা অসংখ্য সাধারণ মানুষ। তবে লোবেন শেরপার সর্বশেষ খবর সেই ইঙ্গিতই করছে। বেসক্যাম্প সূত্রের খবর, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ ক্যাম্প ফোরে নেমে এসেছে মলয় মুখোপাধ্যায়দের চার জনের দলটি। কিন্তু সেই ভোরে শৃঙ্গ ছুঁয়ে ফেলার পর মলয়দের চার নম্বর ক্যাম্পে নামতে এত সময় কেন লাগল? তাঁরা কি কোন বিপদের মুখে পড়েছিলেন? বাদ সেধেছিল আবহাওয়া? তাঁদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কাঠমান্ডু থেকে তাঁদের অভিযান আয়োজক সংস্থার কর্ণধার মিংমা শেরপা এতটুকুই নিশ্চিত করলেন, ‘‘ও চার বংগালি ক্লাইম্বার সামিট করকে সহি-সালামত ক্যাম্প ফোর পঁউছ গ্যয়া।’’ বেসক্যাম্প সূত্রের খবর, ‘সহি-সালামাত’ আছেন গৌতম আর পরেশও। কিন্তু উদ্বেগ বাড়িয়েছে সুনীতা আর সুভাষের আটকে থাকার খবর। দুশ্চিন্তার মেঘ ক্রমে ভারী হয়ে উঠলেও এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অন্নপূর্ণার মতো তিনটি আট-হাজারি শৃঙ্গ ছোঁয়া বাঙালি পর্বতারোহী বসন্ত সিংহরায় তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন, যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটত তবে সেই খবর কোন না কোন ভাবে বেসক্যাম্পে এসে পৌঁছতই। তা যখন হয়নি তখন এই মুহূর্তে খুব খারাপটা ধরে নেওয়ার কারণ নেই। অন্য অঙ্কে বাড়ছে উদ্বেগ। শুক্রবার সন্ধেয় আরোহণ শুরু করার পর থেকে চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এখনও যদি ক্যাম্প ফোরে ফিরতে না পারেন তাঁরা, তবে অক্সিজেন ফুরিয়ে যেতে বাধ্য। ফুরোবে পানীয় জলও। ঠিক দু’দিন আগেই ধৌলাগিরি অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন রাজীব ভট্টাচার্য। এখনও যতটুকু জানা গেছে, স্নো ব্লাইন্ডনেস ও চরম ক্লান্তিতে মন্থর হয়েছিল গতি। আর তাতেই টান পড়েছিল অক্সিজেনের জোগানে। এই মৃত্যুর ধাক্কা সামলানোর আগেই আজকের ঘটনায় রীতিমতো সিঁটিয়ে রয়েছে আরোহীদের পরিবার। উদ্বেগ বেড়েছে বেসক্যাম্প থেকে সমতল পর্যন্ত। এর আগে গত দু’বছরই চোখ রাঙিয়েছিল প্রকৃতি। তুষারধস আর ভূমিকম্পের ধাক্কায় এভারেস্ট বেসক্যাম্পের মতোই গুঁড়িয়ে গিয়েছিল অসংখ্য আরোহীর এভারেস্ট ছোঁয়ার স্বপ্নও। ফের স্বপ্ন বেঁধে, একই অনিশ্চয়তার পথে এবারেও পা বাড়িয়েছিলেন তাঁরা। ছিলেন ১১ জন বাঙালি। ১৯ মে এভারেস্টের চুঁড়া স্পর্শ করেন বেহালার দেবরাজ দত্ত। সঙ্গে ছিলেন টালিগঞ্জের দম্পতি প্রদীপ সাউ ও চেতনা সাউ। শৃঙ্গ ছুঁয়ে ফেরার পথে হাতে ও পায়ে তুষার ক্ষতে (ফ্রস্ট বাইট) আক্রান্ত হন চেতনা। শনিবার বেসক্যাম্পে পৌঁছেই হেলিকপ্টারে করে কাঠমান্ডু নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়েছে তাঁর। দেবরাজ দত্তও শনিবার সন্ধ্যায় পৌঁছেছেন বেসক্যাম্পে। টেলিফোনে জানালেন, বিকেলের পর থেকে আবহাওয়া ক্রমেই খারাপ হচ্ছে। উপরের অবস্থা আরও খারাপ। বেশ কয়েক জন আরোহী উপরে আটকে রয়েছে বলে শুনেছেন তিনি। রয়েছেন বাঙালি সদস্যরাও। তবে ঠিক কারা কোনখানে আটকে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করতে পারেননি দেবরাজ। সদ্য নেমে আসার অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘‘ক্যাম্প ফোর থেকে ক্যাম্প টু পর্যন্ত পথ এতই দুর্গম, এই রাত্রিবেলা কাউকে উদ্ধার করে নামিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।’’
×