ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

অয়ি ইতিবৃত্তকথা ক্ষান্ত কর মুখর ভাষণ

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৭ জুন ২০১৬

অয়ি ইতিবৃত্তকথা ক্ষান্ত কর মুখর ভাষণ

দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে পৃথিবীময় বিবাদ বিরোধ সংঘর্ষ লেগেই আছে। যাকে বলে বৈশ্বিক সন্ত্রাস। দেখে দেখে শুনে শুনে এই নিত্য আশঙ্কা, নিত্য অশান্তি, এমনকি যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা আগুন সন্ত্রাস বা গুপ্তহত্যার ব্যাপারেও আমরা এত বেশি অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি যে, এর অস্বাভাবিক এবং অমানুষিক দিকটি এখন আর আমাদের চোখে পড়ে না, মনেও লাগে না। সভ্য মানুষ অস্ত্রধারণ ছাড়া সুবুদ্ধির মাধ্যমে কোন বিরোধেরই নিষ্পত্তি করতে অপারগÑ এ কথা ভাবলে সভ্যতা সম্বন্ধে সংশয় না জেগে যায় না। খুব সহজ কথায় বলতে গেলে, সভ্যতা তো আর কিছু নয়, আত্মীয়তাবোধের বিস্তার। বর্বরতা নিজের সম্বন্ধে অজ্ঞান, অপরের সম্বন্ধেও সেজন্যে তার আত্মীয়তাবোধ নেই। সভ্যতা আপন-পর সকলকে জানে, জানে বলেই সকলেই তার আত্মীয়। আজ আমরা সংশয়, সন্দেহ ভরা, নৃশংসতায় আকীর্ণ সভ্য জগতে বাস করছি, সেখানে কে কার আত্মীয়? সমাজ সংসারের এমন অনাত্মীয় রূপ বোধ করি মানুষের ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। দেশকে বর্বরতার দিকে যারা ঠেলে দিতে চাচ্ছে, তাদের কাছে দেশের মর্যাদা ক্ষীণ। আর তা ক্ষীণ বলেই দেশের মানুষ তথা জাতিকে নিশ্চিহ্ন বা উপড়ে ফেলার জন্য একাত্তরের গণহত্যার পথ ধরে গুপ্তহত্যা চালানো হচ্ছে। বর্বরতার নিদর্শন বজায় রাখতে বোমা মেরে আগুন জ্বালিয়ে জীবন্ত মানুষ হত্যার মতো চরমতম নৃশংসতার পরাকাষ্ঠা দেখানো হয়েছে। ধর্মের নামে অধর্ম, রাজনীতির নামে দুর্নীতি, শিক্ষার নামে অশিক্ষা-কুশিক্ষা, সত্যকে আড়াল করে মিথ্যাচারের বিস্তার ঘটিয়ে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে পতিত করছে। শিক্ষা সভ্যতা ধর্ম এবং রাজনীতির প্রত্যেকটিরই পৃথক পৃথকভাবে উদ্দেশ্য একÑ সে পরকে আপন, অনাত্মীয়কে আত্মীয়, শত্রুকে মিত্র করবে, দূরকে নিকটে আনবে, সকল বিভেদ ঘুচিয়ে দেবে। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে প্রত্যেকটিই ব্যর্থকাম। আগে ছিল দেশে দেশে জাতিতে বৈরি ভাব। এখন তা সম্প্রসারিত হয়েছে গৃহযুদ্ধ নামে। জ্ঞাতি-শত্রুতা, গুপ্তহত্যা, আগুন সন্ত্রাসে পরিণত হয়েছে। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটেছে সর্বস্তরে, সর্বত্র। পৃথিবীর সকল মানুষ যে একই মানব পরিবারের অন্তর্গত শিক্ষা, সভ্যতা এ বোধটি মানুষের মনে কোনমতেই জাগাতে পারেনি। বরং বিভেদকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যারা ধর্মমত বা রাজনৈতিক মতবাদের সৃষ্টি করেছিলেন, তারা সদুদ্দেশ্য নিয়েই করেছিলেন। ভাল জিনিসের অপ্রয়োগ হলে হিতে বিপরীত হয়। ধর্ম যদি অধার্মিকের, রাজনীতি নীতিহীন এবং শিক্ষাদান অশিক্ষিতের হাতে এসে পড়ে, তাহলে যে বিড়ম্বনা ঘটবার কথা! আজকের মানবসমাজ সেই বিড়ম্বনার সম্মুখীন। কোন যুগকে কিংবা কোন দেশকে যখন সুসভ্য আখ্যা দেয়া হয়, তখন কথাটা খুব ঢিলেঢালাভাবে ব্যবহার করা হয়। কারণ সভ্যতা মানুষের অন্তরের সৃষ্টি। দেশের চিন্তা এবং জ্ঞানসাধনার বৃহত্তর অংশই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। সকল দেশে সকল যুগেই সভ্যতা অতি স্বল্পসংখ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যারা নিজেকে ‘সুসভ্য সুসভ্য’ বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন, সে আত্মপ্রসাদ অনেকাংশে অলীক। আমরা প্রকৃতপক্ষে যে সভ্যতার অংশীদার, সেটি যে সেই মণীষাজাত সভ্যতা নয়, সেটি আধুনিক কলকব্জার গড়া সভ্যতা। তাতে শোষণক্রিয়াটা যতখানি চলেছে, শোধনক্রিয়াটা ততখানি নয়। কলকব্জা, প্রযুক্তি এসে এ যুগের মানুষকে তার বহুযুগের মূল অর্থাৎ জীবনধারা থেকে উৎপাটন করেছে। বহুদিনের বহু পরীক্ষিত মূল্যবোধগুলো প্রায় সবই নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। পুরনো বলেই সে জিনিসগুলো আজ অকেজো হয়ে গেছে এমন নয়। যুগের পরিবর্তনে মানুষের ধরন ধারণ যত সহজে বদলায়, ধ্যান-ধারণা তত সহজে বদলাবার কথা নয়। দোষটা আসলে যন্ত্র বা প্রযুক্তির নয়, দোষ মানুষের। সে কোন কিছুকেই ঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানে না। সভ্যতা আর যন্ত্রের মধ্যেও কোন মৌলিক বিরোধ ছিল না। এই বিরোধটি মানুষ ঘটিয়েছে। সভ্যতা মানুষের আনন্দবিধান করে, আনন্দের কথাই প্রধানত ভাবে। যন্ত্র ভাবে স্বাচ্ছন্দ্যের কথা। আনন্দ আর স্বাচ্ছন্দ্য তো এক কথা নয়। আসলে মণীষাজাত সভ্যতা সকল দেশেই অল্পসংখ্যকের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। তাহলে বলা যায় প্রাচীন সভ্যতা মানেই গ্রীক সভ্যতা। ভারতীয় ও চীন সভ্যতায় দেখা দিয়েছিল একটি প্রসন্নতার ভাব, যা সমগ্র সমাজের দেহ মনে ব্যাপ্ত ছিল। অভাববোধটা কম ছিল বলে মোটা খেয়ে মোটা পরে সাধারণ মানুষ অল্পে তুষ্ট থাকত। প্রাচীন আরব সভ্যতা সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য। কারণ মরুভূমিবাসীর সভ্যতায় উপকরণ বাহুল্য থাকতে পারে না। অল্পে তুষ্ট হলে যা হয়- ঈর্ষা, বিদ্বেষ কম ছিল। অতএব কলহ-বিবাদও কম ছিল এবং সে কারণেই মায়া-মমতাটা বেশি ছিল। সমাজের এই প্রসন্ন ভাবটিকে সভ্যতা আখ্যা দেয়া হয়েছিল। আজকের মানুষের অভাববোধ অনেক বেড়েছে, মানুষের চাওয়া-পাওয়ার রকমও বদলেছে। আগেকার মানুষ চেয়েছে মনের সুখ, আজকের মানুষ চায় দেহের আরাম। সুখের আকাক্সক্ষার বদলে ভোগের আকাক্সক্ষা তাকে পেয়ে বসেছে। ভোগের আয়োজনকেই এখন সভ্যতা আখ্যা দেয়া হচ্ছে। সে আয়োজন যত বাড়ছে, সুখের স্পৃহা মানুষ তত ভুলছে। দেহের দাবি যত বাড়ছে, মনের দাবি তত কমছে। এভাবেই সভ্যতার চরিত্রহানি ঘটছে। শুভবুদ্ধির মানুষ আজ আতঙ্কিত। তারা বার বার সাবধানবাণী উচ্চারণ করছেন। কিন্তু আজকের মানুষ তাকে ধর্মকথা বলে হেসে উড়িয়ে দেয়। ধর্মবুদ্ধি বলে, কোন কিছুই ছাড়া বহুকিছু করা যায়। আর কুটবুদ্ধি বলে, কোন কিছুই ছাড়া বহুকিছু চালানো যায়। একজন বলে লোভ করো না, আরেকজন বলে, নিজেকে বঞ্চিত রেখ না। ‘কুটবুদ্ধি’ কথাটা খারাপ অর্থে বলা হচ্ছে না। কারণ তার কথার মধ্যেও অনেক খানি সত্য আছে। তবে জটিলতা বাড়িয়েছে। মানুষকে এত বেশি স্বার্থসজাগ করে তুলেছে যে, মানুষের অনেক স্বাভাবিক বৃত্তিকে নিস্তেজ করে দিয়েছে। সারাক্ষণ যদি নিজের স্বার্থটুকু নিয়েই ব্যস্ত থাকে, তাহলে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর কথা ভাববে কখন? মানুষের আত্মীয়তাবোধ কমে গিয়েছে। আবার আত্মীয়তা যেমন কমেছে নির্মমতা তেমনি বেড়েছে। স্বার্থবোধ যত টনটনে হবে, অনর্থচিন্তা তত মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিশ্বজুড়ে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের এখন সাজ সাজ রব। এমনিতেই এখন অনেক ক্ষেত্রে এক দেশ অন্য দেশকে শত্রু জ্ঞান করে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। প্রত্যেকেই যেন প্রত্যেকের শত্রু। কেউ কারও মিত্র নয়। সর্বত্র শত্রুতার চর্চা। মিত্রতার চর্চা কোথাও নেই। আপাতদৃষ্টিতে যাকে কিছু মিত্র বলে মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে সে চরমতম শত্রু। মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশের যদি রাজনীতির জ্ঞান থাকত। তাহলে কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গাঁটছড়া বাঁধত না। এটা তো বিশ শতকেই স্পষ্ট হয়েছে। আমেরিকার বন্ধুত্ব অভিশপ্ত। একদা ইরানের শাহ সেই অভিশাপে দেশ ছাড়া হয়ে বেঘোরে মারা গেলেন। ওই একই পাপে ফিলিপিন্সের মার্কোস রাজ্যছাড়া, দেশান্তরী হয়েছেন। পাকিস্তানের একনায়ক জান্তা শাসক জিয়াউল হককে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে বিমান দুর্ঘটনায় পারিষদসহ। আর সাম্প্রতিক ইরাকের সাদ্দাম লিবিয়ার গাদ্দাফির পরিণতি তো সবারই জানা। প্রবাদ রয়েছে যে, আমেরিকা যেখানে যাবে সেখানেই নিজের ঘাঁটিটি করতে গিয়ে সেই দেশটির সর্বনাশ ঘটাবে। আফগানিস্তানে মুজাহিদিন এবং তালেবান সৃষ্টির পর তাদের প্রচুর যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করেছে। সেই অস্ত্রে আফগানরা এখনও মারছে নিজেদের। পাকিস্তানে বিপুল রণসম্ভার মজুদ করেছিল। সেই অস্ত্র গুদামে বিস্ফোরণও ঘটেছিল,উদ্দেশ্য ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহও সন্ত্রস্ত থাকে। মার্কিনীদের তাঁবেদার হতে গিয়ে পাকিস্তান হয়ে পড়েছে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টির দেশ। অবস্থা ক্রমশ এমন দাঁড়াচ্ছে যে, পাকিস্তানের অস্তিত্বই বিপন্ন প্রায়। যে বোমা বিস্ফোরণে বিমান ধ্বংস হলো এবং পারিষদসহ জিয়াউল হক নিহত হন, সেই বোমাটিও ছিল আমেরিকারই ‘বন্ধুত্বের’ দান। আগের দিনে অস্ত্র থাকত সিপাই-সান্ত্রীর হাতে। বিপদে আপদে তারা দুর্বলকে অসহায়কে রক্ষা করত। সে ক্ষেত্রে অস্ত্র ছিল বীরের অঙ্গ-ভূষণ। মধ্যযুগে বিপন্নের উদ্ধারকারী বীরপুরুষরা নাইট উপাধিতে ভূষিত হতেন। সমগ্র সমাজ তাদের সম্ভ্রমের চোখে দেখত। সেই বীরের অস্ত্র যখন যদু মধু কানু মনুদের হাতে এসে জোটে; তখন দেশসুুদ্ধ এরা কাপুরুষ অর্থাৎ গুপ্তঘাতকে পরিণত হয়। তারা নিরস্ত্র-ঘুমন্ত মানুষ, নিরপরাধ ব্যক্তিদেরও নির্বিচারে হত্যা করে। আজকের পতিত সমাজে এই সব গুপ্ত ঘাতকরাই হিরো হিসেবে গণ্য যেন! যে কারণে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ধরিয়ে দেয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। আবার এরা ধরা পড়লেও অনায়াসে জামিনে যেমন বেরিয়ে আসে তেমনি কারাগারেও ‘রাজকীয়’ হালে থাকে। এদের অনেকে কারাগারে বসে তাদের ক্যাডারদের নির্দেশ-আদেশ প্রদান করে মানুষ হত্যার পথ সুগম করে আসছে। পুরো বিশ্ব যেন জঙ্গী ও সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় সন্ত্রস্ত। কেউই আর নেই স্বস্তিতে। গুপ্ত পথে যে অস্ত্র চলাচল করে, সে অস্ত্রের ব্যবহারও হয় গুপ্ত ঘাতক তথা জঙ্গীদের হাতে। স্বর্ণ, রৌপ্য, মাদকদ্রব্যের চোরাকারবারের মতো অস্ত্রের চোরাকারবারও বাড়ছে। চোরাই পথে আসা অজস্র অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে দেশজুড়ে। এমনকি বোমা তৈরির সরঞ্জামও হয়ে পড়েছে সহজলভ্য। এ শুধু বাংলাদেশের কথা নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা চলছে। শক্তিশালী দেশ ক’টি নিজ নিজ মতলবে দরাজ হাতে অস্ত্র সরবরাহ করছে। তাদের সেসব অস্ত্র জঙ্গীদের হাতে চলে যাচ্ছে নানাভাবে। এদের উদ্দেশ্য, নানা রকমের গোলমাল বাধিয়ে সেসব দেশের সরকারকে নড়বড়ে করে দেয়া। যাতে দুর্বল সরকার বাধ্য হয়ে তাদেরই অভিভাবক বলে গণ্য করবে। দুই প্রতিবেশীতে বিরোধ ঘটলে অভিভাবকরা কেউ এ পক্ষে, কেউ ও পক্ষে এসে হাজির হবে এবং অবস্থা আরও ঘোলাটে করে তুলবে। এসব অভিভাবকরা কিন্তু কেউ কারও মিত্র নয়। শুধু শক্তির পরীক্ষাটা মুখোমুখি না করে পরোক্ষভাবে অপরের ঘাড়ের ওপর দিয়ে করতে চায়। অনেক দেশের অভ্যন্তরেও শান্তি নেই। দলে দলে বিরোধ। আত্মস্থ থাকলে দলপতিরা বুঝতে পারতেন যে আত্মকলহের দরুন তারা দেশকে দুর্বল করছেন। বহির্শত্রুর শক্তি বাড়াচ্ছেন, পৃথিবীব্যাপী এত অশান্তি, দেশে দেশে এমন অযথা রক্তারক্তি কা- আগে কখনও হয়েছে কিনা ইতিহাসে এর হদিস মেলে না। মানুষ কখনও এতখানি মারমুখী স্বাভাবের ছিল বলে তো মনে হয় না! সারা বিশ্বের চেহারাটা জঙ্গী সন্ত্রাসীদের কারণে আজ এক খ্যাপাটে বলে মনে হতে পারে। বিশ্ব আজ ইসলামিক স্টেট তথা আইএস, আল কায়েদা, তালেবানসহ অন্যান্য জঙ্গীসংগঠনের চোরাগুপ্তা হামলার শিকার। যে কোন সময় যে কোন স্থানে তারা মানুষ হত্যায় সক্রিয়। একেক দেশে একেক উদ্দেশ্যে তরা তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা প্রাচীন ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে পিছপা হচ্ছে না। মানবসভ্যতাকে বিলুপ্ত করার মধ্যে জঙ্গীবাদীরা তাদের হীন উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, মিসরে তারা পাঠাগার ধ্বংস করতে পিছপা হচ্ছে না। শিক্ষা-দীক্ষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছুর বিনাশে এরা এমনই তৎপর যে, ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছেÑ তারা অন্ধকার যুগ ফিরিয়ে আনতে চায়। তাদের কাছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই। খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ তাদের জীবনাচারে এমনভাবেই প্রোথিত যে, এরা কোন বিধিবিধান সহ্য করে না। কেবল তাদের ইচ্ছামাফিক নির্দেশনা ছাড়া। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র এবং তার ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার পেছনে বৈশ্বিক সন্ত্রাসের যোগসূত্র যতটা, তার চেয়ে বেশি দেশী রাজনীতিকদের জঙ্গী সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষকতা। ক্ষমতা দখল, নিজেদের অপরাধের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার একটা উদ্দেশ্য তাদের মধ্যে কাজ করছে। তাদের অতীতজুড়ে হত্যাকা-ের নানা নিদর্শন রয়েছে। মৌলবাদীদের সঙ্গে নিয়ে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের তখতে তাউস নড়বড়ে করে দেবার জন্য নানা চেষ্টা-অপচেষ্টা চলছে। এদের ইতিবৃত্ত মানুষের অজানা নয়। কিন্তু সেসব ধামাচাপা দিয়ে এরা উচ্চকণ্ঠে কথা বলে। আগুন সন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা চালিয়েও তারা নির্বিকার। বরং যাদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, তাদেরকেই দায়ী করছে নিজেদের হত্যার জন্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়Ñ ‘মিথ্যা দিয়ে চাতুরী দিয়ে রচিয়া গুহাবাস/পৌরুষেরে কোরো না পরিহাস,/বাঁচাতে নিজপ্রাণ/বলীর পদে দুর্বলের কোরো না বলিদান।’... বিশ্বজুড়ে আজ জঙ্গীবাদের থাবার বিস্তার ঘটছে। যা কোন শান্তি, স্বস্তি আর অগ্রগতির সহায়ক নয়। বরং এর বিরোধী। সে কারণেই মনে হবে পুরো মানব সমাজেরই চিন্তা-ভাবনা দৃষ্টিভঙ্গি বিকারগ্রস্ত। সম্ভবত সে কারণেই কার্যকলাপও আজ বিকৃত। সভ্য সমাজে যুক্তি ছিল সবচেয়ে বড় শক্তি। মতবিরোধ ঘটলে যুক্তি বিচারের দ্বারা বিরোধ মেটানো হতো। এখন যুক্তির আর ধারও নেই, ভারও নেই। সকল ব্যাপারের রফা এখন শক্ত হাতে। সামান্যতম বিরোধেও লোহা ইস্পাত না হলে নিষ্পত্তি হয় না। গায়ের জোর যখন মাথার জোরকে ছাড়িয়ে যায়, তখন বুঝতে হবে মনুষ্য সমাজে ঘোর দুর্দিন উপস্থিত। এ শুধু বিশেষ কোন দেশের কথা নয়, সমস্ত পৃথিবীতেই এটি ঘটেছে। বিকারগ্রস্ত সমাজ সব কিছুকে বিকৃত করে ফেলে। জঙ্গীরা হিংসায় উন্মত্ত। শান্তির ললিতবাণীর কোন গুরুত্ব তাদের কাছে নেই। শুধু হত্যা, রক্তপাত, ধর্ষণ লুটপাট আর ধ্বংসের গর্জন হানে জঙ্গীরা। তাদের কাছে স্বাভাবিক জীবনের কোন কানাকড়ি মূল্য নেই। মানুষের জীবন, সমাজজীবন শোভন সুন্দর হবেÑ এমনটা জঙ্গীদের বিশ্বাসের বাইরে। সুন্দরের চর্চা শান্তিপূর্ণ জীবন হলেও সে জীবনকে তছনছ করে দেয়াই জঙ্গীদের প্রধান কর্মে পরিণত হয়েছে আজ। জঙ্গীরা যা করছে, তা সুন্দর ও শোভন নয়। তারা সবকিছুকে ধ্বংস করার মধ্যে আনন্দ খুঁজে পায়। তবে বাংলাদেশে যা হচ্ছে অর্থাৎ গুপ্তহত্যা। এর একটি রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়া ও পৃষ্ঠপোষকতায় এবং হীন উদ্দেশ্যে হত্যাযজ্ঞ চলে আসছে। মৌলবাদীদের হাত ধরে জঙ্গীবাদীরা মাঠে নেমেছে। এদের লক্ষ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেয়া। তাই তারা কাপুরুষতার পথ বেছে নিয়েছে। চাপাতি মেরে, গুলি ছুড়ে নির্বিচারে গুপ্তহত্যা কাপুরুষতার চূড়ান্ত অবশ্যই। এর মধ্যে বীরত্ব নেই লেশমাত্র। পাকিস্তানী ভাবধারার এই রাজনৈতিক দলগুলো বোমাবাজি এবং খুন খারাপিতে লিপ্ত হয়ে স্বাভাবিক রাজনীতির বিকাশের পথকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক ধারার ক্ষেত্রগুলোকে সঙ্কুচিত করে দিতে তারা বদ্ধপরিকর। একুশ শতকের আগে থেকেই বিশ শতকের শেষার্ধে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানো হয়। রাজনৈতিক দলের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে রাজনীতিকদের হত্যার আয়োজনের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক রাজনীতি শুধু নয়, গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবহার বিরুদ্ধে একটি বলয় তৈরি করা হয়েছিল। তাদের সেই অবস্থান থেকে তারা সরে আসেনি। বরং নানাভাবে মানুষকে হত্যা করাই হয়ে পড়েছে তাদের রাজনীতির মূল কর্মকা- তাই একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক জান্তা শাসকের উত্তরসূরি যে সন্ত্রাস ও জঙ্গীপনার উপর নির্ভরশীল হয়ে দেশবাসীকে সন্ত্রস্ত রেখেছে, এর পরিণাম ক্রমেই সর্বনেশে আকার ধারণ করছে। দেশময় বিশৃঙ্খলা, অরাজকতার যে দিকদর্শন চালু করতে চাইছে, তা ক্রমশ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করতে সচেষ্ট। তবে জনগণ তা মেনে নেবে কতদিন? প্রতিরোধ তারা গড়বেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তাকে প্রতিরোধী হতেই হয়। জঙ্গীবাদী মনোভাবের রাজনৈতিক দলের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। আর তাই তারা নিষ্ঠুরতার চূড়ায় আসীন হয়ে পড়েছে। তারপরও এরা উচ্চকণ্ঠে কথা বলে। সবকিছুকে দাবড়িয়ে বেড়াতে চায়। তাই জঙ্গীনেত্রী হিসেবে যিনি পরিচিতি পেয়েছেন, সব অপকর্মকে চাপা দেবার জন্য, যাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালানো হচ্ছে তাদেরকেই দায়ী করছেন এভাবে যে, নিজেরাই নিজেদের মারছে, এবং মেরে জঙ্গীনেত্রীর দলের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। সাধারণ মানুষ কেন নিজেরা নিজেদের হত্যা করবে- এর ব্যাখ্যা মেলে না। সরকার যারা পরিচালনা করছেন, তারা নাকি নিজেরাই এসব জঙ্গীকর্ম চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে। অর্থাৎ নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরে নিজেদেরই উৎখাত করতে চাইছে। এসব প্রলাপ দিয়ে আর যা-ই হোক সত্যকে ঢাকা যায় না। তাদের এই মুখর ভাষণের তোড়ে ঘটনার চিত্রকে মুছে ফেলা যায় না। ছাই চাপা আগুন থেকে স্ফূরণ ঘটতে পারে। এই আগুন নিভিয়ে ফেলা সঙ্গত হলেও নেভানোর দায় কাউকে তো নিতেই হয়। একদিকে গুপ্তহত্যা চালানো হচ্ছে নিজেদের হীন স্বার্থে, অন্যদিকে চিৎকার চেঁচামেচি চালানো হচ্ছে প্রবাদের সেই ‘চোরের মায়ের গলা বড় গলা’র মতো। জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটিয়ে একটি অরাজক অবস্থা তৈরির মানসিকতা থেকে তাদের সরে আসার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। তাদের মুখে ‘লিউকোপ্লাস্টার’ লাগিয়ে দেয়ার সময় এসে গেছে বলা যায়। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার এবং শাস্তি যখন হচ্ছে তখন তারা তা ভ-ুল করা বা প্রতিশোধের আগুনসন্ত্রাস, গুপ্তহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। জনগণ একদিন যুদ্ধাপরাধীদের মতো এইসব গুপ্তহত্যা, আগুনসন্ত্রাসীদের বিচার করবেই। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে ক্ষুব্ধ ইতিহাসে/অন্ধবেগে ঝঞ্ঝা বায়ু হুঙ্কারিয়া আসে,/ধ্বংস করে সভ্যতার চূড়া/ধর্ম আজি সংশয়েতে নত,/যুগ যুগের তাপসদের সাধন ধন যত/দানব পদদলনে হলো গুঁড়া।’এটা প্রমাণিত যে, গলরজ্জুবদ্ধ যারা তাদের অস্তিত্ব ক্রমশ বিলুপ্ত হবেই।
×