ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গাছ কাটা যাবে না

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৮ জুন ২০১৬

গাছ কাটা যাবে না

লাউয়াছড়া সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান নিয়ে রেল বিভাগ ও বন বিভাগ মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। ঢাকা-সিলেট রেলপথে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া বনাঞ্চলটি দু’পাশে প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে অবস্থিত। অপরূপ সৌন্দর্যম-িত প্রাকৃতিক এই বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে রেললাইন নির্মিত হয় সেই ব্রিটিশ আমলেই। ঢাকা থেকে সিলেট রেলযোগে যাতায়াতের পথে উৎসুক ও আগ্রহীরা প্রায়ই এর ভেতর দিয়ে যেতে রীতিমতো রোমাঞ্চ অনুভব করে থাকেন। দু’চোখ ভরে উপভোগ করেন বনের অপূর্ব সৌন্দর্য, গাছপালার বৈচিত্র্য ও সমারোহ। স্বল্পক্ষণের দর্শনে বনের ভেতরে লুকায়িত বন্য জীবজন্তু ও পাখপাখালির দর্শন হয় তো মেলে না। তবে ভ্রমণ পথের ক্লান্তি জুড়াতে বনের সৌন্দর্যটা কম কী। এত দিনে সেই বনের ওপর নজর পড়েছে রেল বিভাগের। রেলপথ নির্বিঘœ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রেললাইনের দু’পাশে ৫০ ফুটের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার গাছ কেটে ফেলতে ইচ্ছুক। উল্লেখ্য, লাউয়াছড়া বনাঞ্চলের এসব গাছের অধিকাংশই বহু পুরনো ও বৈচিত্র্যময়। যুক্তি হিসেবে রেল বিভাগ বলছে, ঝড়-বৃষ্টিতে প্রায়ই বনের গাছপালা উপড়ে কিংবা ডালপালা ভেঙ্গে পড়ে রেলপথের ওপর। তাতে স্বাভাবিক রেল চলাচলে বিঘœ ঘটে। যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে সময়ক্ষেপণ হয়। তদুপরি রেললাইন, ইঞ্জিন ও বগির ক্ষতি সাধিত হয়। এর জন্যই রেললাইনের দু’পাশের গাছপালা কেটে ফেলা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। প্রথমে তারা চিঠি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নিজেদের উদ্যোগেই গাছ কেটে ফেলার জন্য বলেছে বন বিভাগকে। বন বিভাগ সেটি করতে অপারগ কিংবা অসমর্থ হলে রেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সেটা করবে বলে হুমকি দিয়েছে। অন্যদিকে বন বিভাগ গাছ না কাটার ব্যাপারে অনড় অবস্থান নিয়েছে। তাদের মতে, এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। সংরক্ষিত এলাকাও বটে। এই অঞ্চলের গাছ কাটা হলে তা বনাঞ্চলসহ জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বিঘিœত করবে। ফলে ঘটবে পরিবেশ বিপর্যয়। রেল ও বন বিভাগের এহেন মুখোমুখি অবস্থানে বন ও পরিবেশমন্ত্রী বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর কথা বলেছেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য। দেশে বনাঞ্চলের পরিমাণ এমনিতেই কম। জনসংখ্যা ও ভূমি সংস্থান অনুপাতে পঁচিশ শতাংশ বনভূমির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বর্তমানে আছে বড়জোর ৭-৮ শতাংশ। যেটুকু আছে সেটুকুও বুঝি যায় যায়। এমনকি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বলে ঘোষিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের অস্তিত্বও বর্তমানে বিপন্নপ্রায়। সিলেটের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত উদ্যানসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে যেটুকু বন অবশিষ্ট আছে, সেটুকুও হুমকির মুখে। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বন কেটে বসত ও শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা অনেক ক্ষেত্রে অনিবার্য ও অপরিহার্য হয়ে পড়ে বটে। তবে আজকাল পরিবেশ অক্ষুণœ রেখেও পরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন কার্য করা সম্ভব। বিশ্বের অনেক দেশেই বনের ভেতর দিয়ে রেললাইন, নদ-নদী বা সমুদ্রের ভেতর দিয়ে টানেল এবং পাহাড়-পর্বতের ভেতর দিয়ে রেল ও সড়কপথ নির্মিত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেসব হয়েছে পরিবেশ অক্ষুণœ রেখেই। লাউয়াছড়ার ক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে রেল কর্তৃপক্ষকে। প্রয়োজনে ওই পাঁচ কিলোমিটার রেললাইন বনের বাইরে দিয়ে বিকল্প হিসেবে টেনে নেয়া যেতে পারে। পরিবেশ রক্ষা, বন ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বিবেচনায় এই ব্যয় তেমন বেশি হবে না। ১৯৯৭ সালের জুন মাসে মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টাল কোম্পানি গ্যাসকূপ খননকালে মাগুরছড়ায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা- ঘটে। তাতে লাউয়াছড়া বনাঞ্চলের সমূহ ক্ষতি সাধিত হয়, যার পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা। আজ পর্যন্ত সেই ক্ষয়ক্ষতির পূরণ হয়নি। এমন অবস্থায় আবারও লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বৃক্ষকর্তন সমীচীন হবে না কোন অবস্থাতেই। সেক্ষেত্রে রেলসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে বলেই প্রত্যাশা।
×