ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আল বিদা মাহে রমজান

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩০ জুন ২০১৬

আল বিদা মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ রমজানুল মোবারকের প্রধান পরিচিতি ও মাহাত্ম্য নিহিত রয়েছে এ মাস কুরআনুল কারীম নাজিলের পুণ্য স্মৃতিবিজড়িত মাস হিসেবে। এখন মাহে রমজানের সমাপনী দশক। সাধারণ মু’মিন মুসলমানগণ সাওয়াবের নিয়তে ব্যাপকভাবে যেমন কোরান তিলোয়াতে সময় ব্যয় করেছেন, তেমনি প্রায় সর্বত্র খতম তারাবিহও সুসম্পন্ন হতে চলেছে। এ রমজান ইহতিকাব আত্ম সমালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসার মাসও। শিক্ষিত শ্রেণীর উচিত তিলোয়াতের পাশাপাশি কোরানের তাফসির, এর ইতিহাস ঐতিহ্য প্রভৃতি সম্পর্কেও জ্ঞান হাসিল করা। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে হেরা গুহা উজ্জ্বল করে এ রমজানের শবে কদরে আমাদের প্রিয়নবী হযরত রাসূলে আকরাম (স) এর খিদমতে প্রথম আল্লাহর নূরানী ফিরিস্তা জিব্রাইল (আ) পবিত্র কোরানের বাণী নিয়ে আসেন। এরপর দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে ওই ঐশী বাণী আসা অব্যাহত থাকে। আল্লাহর মহান পয়গাম্বর (স) ও তাঁর আত্মনিবেদিত সাহাবা কেরামগণ মানুষের কাছে এ বাণী নিয়ে হাজির হতেন। তার ওফাতের পর মুসলমানদের সংখ্যাও ভূখ-গত পরিধি ক্রমাগত ব্যাপকতর হতে থাকে। সাথে সাথে কোরআনের শিক্ষাও এর ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তাও তীব্রতর হয়। এ গুরুত্বপূর্ণ কাজে জ্ঞানসাধক সাহাবাগণ যেমন অগ্রসর হন, তেমনি তাদের শিষ্য ‘তাবেয়ী’ বা অধঃস্তন মনীষীগণও অফুরন্ত উৎসাহ ও আন্তরিকতা নিয়ে আত্মনিয়োগ করেন। আজকে আমরা যে কোরানের তাফসির বা ব্যাখ্যা পড়ি তা তাদেরই পরিশ্রমের ফসল। সাহাবী পরবর্তী যুগে ‘তাবেয়ী’দের মধ্যে এদিক দিয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন মোজাহিদ (রহ)। তিনি এত উঁচুস্তরের এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় তাফসির বিশারদ ছিলেন যে, পরবর্তীতে ইমাম নববী (রহ) স্বীকার করেছেন যে, যদি মোজাহিদ হতে কোন তাফসির প্রণীত পাওয়া যায় তখন তাই আমলের জন্য যথেষ্ট। (আত তানবীর)। এ মন্তব্য দ্বারা হযরত মোজাহিদের ব্যক্তিত্ব ও তাফসির শাস্ত্রে তার অপরিমেয় পারদর্শিতার কথা প্রকাশ পায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তাফসির শাস্ত্রের এ মহান সেবকের জীবনী যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে ইতিহাস ব্যর্থ হয়েছে। তার সম্পর্কে জানার ও পড়ার প্রবন্ধ বই খুব কমই দেখা যায়। আসলে আমরা ক্রমাগত আমাদের ঐতিহ্য ও গৌরবগাথার ব্যাপারে উদাসীনতা প্রকাশ করে চলেছি। তবুও বিভিন্ন গ্রন্থে একান্ত প্রাসঙ্গিক। যে দুই-চার কথা এসেছে তা থেকেই আজকে আমাদের এ উপস্থাপনা। তার প্রকৃত নাম মোজাহিদ, ডাক নাম আবু হিজাজ (অথবা আবু হাজ্জাজ)। পিতার নাম জাবর। তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ বিন সায়িব মাখযুমীর আযাদকৃত দাস। মিশকাত শরীফের অন্তর্গত আসমাউর রিজালের বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি তৃতীয় স্তরের একজন বিখ্যাত তাবেয়ী। যে কয়েকজন সৌভাগ্যবান মনীষী পেয়ারা নবী (স) জ্ঞানী সাহাবীদের সাহচর্য পেয়ে নিজেদের জ্ঞানভা-ার উজালা ও সমৃদ্ধ করেছেন মুজাহিদ তাদের শীর্ষে। তাফসির শাস্ত্রের ক্রমধারায় তিনি একটি অলঙ্ঘনীয় মাইলস্টোন হয়ে আছেন। সে সময় মক্কা ছিল হাদিস ও তাফসির চর্চায় মুসলিম জাহানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মারকাজ বা সেন্টার। তাকে সেখানকার শ্রেষ্ঠ আইনবিদ (ফকীহ), কারী, মুফাসসির হিসেবে বিবেচিত করা হয়। আঁ-হযরতের (স.) দোয়ার বরকতময় ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের মূর্তপ্রতীক সাহাবী ইবনে আব্বাস (রা) শেষ জীবন কাটান মক্কায়। যাকে কিনা ইতিহাসে হিবরুল উম্মাহ (উম্মতের মহাজ্ঞানী) ও আল বাহার বা জ্ঞানের সাগর প্রভৃতি উপাধিতে স্মরণ করা হয়। (দ্র: আসহাবে রাসূলের জীবন কথা-১)। মুজাহিদ তারই হাতে গড়া সেরা ছাত্র। তার অন্যান্য সতীর্থদের মধ্যে ছিলেন ইকরামা ও শাদা (র) প্রমুখ। ওস্তাদ সম্পর্কে মুজাহিদ একস্থানে বলেছেন, ‘হযরত ইবনে আব্বাস (রা) যখন আল কোরানের তাফসির পেশ করেন তখন তার মুখ দিয়ে নূরের জ্যোতি বের হতো।’ আর নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি ইবনে আব্বাসের সমীপে তিরিশ বার কোরান অধ্যয়ন করেছি’ (আত তানবীর-১০০)। তার লেখা ও রচনাবলী সম্পর্কে ইতিহাস নীরব। তবে তিনি তার মহান ওস্তাদের শিক্ষাই বহন ও প্রচার করে বেড়াতেন। আর এমনিতেই সে যুগে লেখালেখির চেয়ে মুখস্ত করা ও মুখস্ত করানোর দিকে বেশি জোর দিতেন। একান্ত লিখিত আকারে কিছু করলেও তা মুখস্তের সুবিধার জন্য ইমাম মালিকের (র) একটি উদ্ধৃতি হতে এ সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, তখনকার লোক সাধারণত লিখতে অভ্যস্ত ছিলেন না, তারা অভ্যস্ত ছিলেন মুখস্ত বিদ্যায়। তাদের কেউ কোন জিনিস লিখে নিলেও কেবল মুখস্ত করার উদ্দেশ্যেই লিখতেন, আর মুখস্ত হয়ে গেলে পরে তা মুছে ফেলতেন। (হাদীস সংকলনের ইতিহাস, মাও. আ. রহীম-৩১২)। হিজরী ১০০ মতান্তরে ১০৪ সালে বিখ্যাত কোরান বিশেষজ্ঞ মোজাহিদ (র) ওফাতপ্রাপ্ত হন। কোরানের মাস রমজানের শেষ দশকে এবং নুজ্জলে কোরান দিবস শবে কদরের পূর্বলগ্নে আমরা এ মহান কোরান সেবককে স্মরণ করি, আরজ করি তার প্রতি অকৃত্রিম অফুরান শ্রদ্ধা ও ভক্তি; আল্লাহ তাকে জান্নাতে উচ্চাসন দান করুন।
×