ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ভবনের বহু দেয়াল ফাটলে ফ্ল্যাট ছাড়ছেন বাসিন্দারা ॥ তদন্ত কমিটি গঠন, সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেশের নির্দেশ

উত্তর বাড্ডার প্রিমিয়ার প্লাজার আগুন নিয়ন্ত্রণে, হতাহত নেই

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ৩০ জুন ২০১৬

উত্তর বাড্ডার প্রিমিয়ার প্লাজার আগুন নিয়ন্ত্রণে, হতাহত নেই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকার উত্তর বাড্ডায় বহুতল প্রিমিয়ার প্লাজায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। তবে কেউ হতাহত হননি। ভয়াবহ অগ্নিকা-ের কারণে প্রচ- তাপে ভবনটির বহু দেয়ালে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। আতঙ্কে ভবনগুলোর বাসিন্দারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ফ্ল্যাট ছাড়ছেন। আগামী এক সপ্তাহেও ভবনগুলোতে পানি, বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ পুনঃস্থাপনের কোন সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। ফলে মাটি হয়ে গেছে তাদের ঈদ আনন্দ। ঈদের আনন্দ মাটি হলেও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের পরামর্শ আর বুদ্ধিমত্তায় রক্ষা পেয়েছে বহু প্রাণ। তবে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আগুনের কারণ জানতে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। মঙ্গলবার রাত পৌনে তিনটার দিকে রামপুরা থেকে বিশ্বরোড যাওয়ার প্রগতি সরণির উত্তর বাড্ডার রাস্তা লাগোয়া চ-৯০/এ নম্বর ১৪ তলা প্রিমিয়ার প্লাজায় অগ্নিকা-ের ঘটনাটি ঘটে। ভবনটির নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বিটিআই। নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানান, ৬৮ কাঠা জমির ওপর টি আকৃতির পাঁচটি ১৪ তলা টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম ভবনটি লম্বা। তার পেছনের দিকে পর পর চারটি ভবন। প্রতিটি ভবনের সঙ্গেই প্রতিটি ভবন সংযুক্ত। ভবনগুলোতে প্রথম তলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বিটিআইসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দোকান, শোরুম, চেনশপ ও অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অবস্থিত। আর পঞ্চম তলা থেকে ১৪ তলা পর্যন্ত ফ্ল্যাট। পাঁচটি ভবনে ১১৭ ফ্ল্যাটে সমসংখ্যক পরিবার বসবাস করছে। এগুলো বিটিআই বিক্রি করে দিয়েছে। আর আন্ডারগ্রাউন্ড বেজমেন্ট দোতলা। সেখানে ভবনের বাসিন্দাদের কারপার্কিং। পার্কিং ব্যবস্থাপক জানান, সব মিলিয়ে দুটি বেজমেন্টে ২৩৪ কার পার্কিং করা যায়। এছাড়া ভবনের বেজমেন্টের ওপরে আরেকটি বাণিজ্যিক কারপার্কিং রয়েছে। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময় ভবনের ফ্ল্যাটগুলো ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর ২০১৪ সালে ভবনগুলোর প্রথম তলা থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বিটিআইসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করে। ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, রাত পৌনে তিনটা। তারা যথারীতি দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ সময় সেহ্রি খাওয়ার জন্য কয়েক ফ্ল্যাটের লোকজন মাত্র জেগে উঠেছেন। আবার অনেকে জেগে উঠছেন। অনেক ফ্ল্যাট থেকে রান্নাবান্নার হাঁড়িপাতিলের শব্দ আসছিল। রাত পৌনে তিনটার দিকে প্রথম ভবনের পেছনে থাকা ভবনের পাঁচতলা থেকে ধোঁয়া দেখা যায়। দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই পুরো পাঁচতলায় আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময় ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়া হয়। চোখের পলকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কাপড় পোড়ার গন্ধ আসতে থাকে। এ সময় আগুন আগুন চিৎকারে পুরো প্লাজার বাসিন্দারা জেগে যান। তারা যে যার মতো নিচে নামতে থাকেন। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস্) মেজর একেএম শাকিল নেওয়াজের সঙ্গে কথা হয় একটি ভবনের অষ্টম তলার এ-এইচ নম্বর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসানের। মাহমুদুল হাসানকে মেজর শাকিল নেওয়াজ ভবনের বাসিন্দাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে অথবা জোর করে হলেও উপরের দিকে প্রয়োজনে ভবনগুলোর ছাদে আশ্রয় নেয়ার পরামর্শ দেন। মাহমুদুল হাসান বলছিলেন, পুরো ভবনে ১১৭ পরিবার বাস করে। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় শ’ লোকের বসবাস। আগুন আতঙ্কে তারা সবাই নিচের দিকে নামতে থাকে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় তাদের বোঝানোর কোন সময় ছিল না। তাই লোকজনের নিচে নামার সিঁড়ির গেট বন্ধ করে লিফট বন্ধ করে দেয়া হয়। লোকজন উপায়ান্তর না দেখে অনেকটা বাধ্য হয়েই উপরের দিকে যেতে থাকেন। অনেকেই পূর্বপরিচিত উপরের দিকে থাকা ফ্ল্যাটে আশ্রয় নেন। আবার অনেকেই ছাদের তালা খুলে ছাদে আশ্রয় নেন। মেজর শাকিল নেওয়াজ জানান, ঘটনার সময় রাস্তা ফাঁকা ছিল। মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছে। পৌঁছেই তারা কাজ শুরু করে। প্রথমে যেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হয় এবং বেশি আগুন জ্বলছিল সেখানে প্রচুর পানি দেয়া হয়। কিন্তু ভবনটির উত্তর পাশে মাত্র তিন থেকে চার ফুট যাওয়ার জায়গা। আর দক্ষিণ দিকে সাত থেকে আট ফুট রাস্তা। ফলে বড় গাড়ি সেখানে প্রবেশ করানো সম্ভব হয়নি। ভবনের সিঁড়ির পাশে থাকা প্রায় ১৫ ফুট চওড়া জায়গায় গাড়ি রেখে সেখান থেকে পানির পাইপ টেনে নিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়। ভবনের জরুরী সিঁড়ি থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় সরু। এছাড়া ভবনে পানির মজুদ বা সরবরাহের ব্যবস্থা অপ্রতুল। সব মিলিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ২৮ ইউনিট কাজ করে। ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। আগুনের কারণে ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ফাটল ধরেছে। আগুন লাগার প্রকৃত কারণও জানা যায়নি। তবে বাণিজ্যিক কোন ফ্লোর থেকে আগুন লেগেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। মেজর শাকিল বলছিলেন, ভবনটি বসবাসের জন্য কতটা নিরাপদ সে বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন। এ বিষয়ে রাজউক ও বুয়েট বিশেষজ্ঞরা সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। সকাল পাঁচটা ৫০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তার পরও থেমে থেমে অনেক জায়গায় ছোট ছোট আগুনের কু-লী দেখা গেছে। দুপুর একটার দিকে ফায়ার সার্ভিস আনুষ্ঠানিকভাবে ভবনের অগ্নিনির্বাপণ শেষ বলে ঘোষণা করে। সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনটির আন্ডারগ্রাউন্ডে দুটি গাড়ি পার্কিংয়ের বেজমেন্ট। তার ওপর আরেকটি বাণিজ্যিক গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। প্রথম তলায় প্লাজাটির তৈরিকারক প্রতিষ্ঠান বিটিআইয়ের নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হোম ডেকর নামে বিশাল শোরুম। দ্বিতীয় তলায় ক্লাউড-৯ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কয়েকটি শোরুম। তৃতীয় তলায় হাতিল ফার্নিচারসহ নামীদামী ব্র্র্যান্ডের শোরুম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের উপসামগ্রী, প্রসাধনী আর সিরামিকের একটি শোরুম ছিল। ভবনের দেয়াল ভেঙ্গে পাইপ ভেতরে প্রবেশ করিয়ে আগুন নেভাতে হয়েছে। পঞ্চম তলায় থাকা সিরামিকসহ বডি স্প্রে, এয়ার ফ্রেশনারসহ অন্য সামগ্রীর কয়েকটি শোরুমেও একই ভাবে দেয়াল ফুটো করে পানি দিয়ে আগুন নেভাতে হয়েছে। দুপুর একটা পর্যন্ত পঞ্চম তলায় ফায়ার সার্ভিসকে হোস পাইপের মাধ্যমে ভেঙ্গে ফেলা দেয়ালের ফুটো দিয়ে ভেতরে আগুন নেভাতে দেখা গেছে। আর ভবনের প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। এমন ফাটল দেখা দেয়ায় ভবনের বাসিন্দারা আতঙ্কে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ফ্ল্যাট ছাড়ছেন। বাসিন্দারা বলছিলেন, যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে আগামী এক সপ্তাহেও ভবনের পানি, বিদ্যুত ও গ্যাস সংযোগ স্থাপিত হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। ফলে সেখানে থাকা প্রায় অসম্ভব। এজন্য তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আগুনের কারণে এবারের ঈদের আনন্দ তাদের জন্য মাটি হয়ে গেছে। ভবনটিতে কর্মকর্তাদের অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ঈদ উপলক্ষে মঙ্গলবার প্রায় সারারাত দামী দামী ফার্নিচার প্রথম ভবনটিতে প্রবেশ করানো হয়। সেখান থেকেই আগুন লাগার আশঙ্কা বেশি। বিটিআই কোম্পানির মালিকপক্ষের কোন বক্তব্য মেলেনি। বাড্ডা থানার ট্রাফিক পরিদর্শক জাফর উল্লাহ বলছিলেন, আগুন লাগার কারণে সকালে তেমন যানজট হয়নি। তবে সকাল ছয়টা থেকে নয়টা পর্যন্ত প্রগতি সরণি থেকে বিশ্বরোডে যাওয়ার রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ফলে কিছুটা যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। দুপুর দেড়টার দিকে যানজট কমে যায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খান বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেক কষ্ট হয়েছে। সেখানে পানিস্বল্পতা ছিল, ভবনের ফটকে তালা দেয়া ছিল। তালা ভেঙ্গে ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে হয়েছে ফায়ারম্যানদের। এছাড়া ভবনগুলোয় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট রাস্তা নেই। আগুনের ঘটনা সম্পর্কে তৌহিদুল ইসলাম নামে একজনের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তিনিও তৌহিদুল ইসলামকে ভবন থেকে কাউকে নিচে না নামার পরামর্শ দেন। ভবনের বাসিন্দারা পরামর্শ শোনার ফলে হতাহতের কোন ঘটনা ঘটেনি। ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আরও বলেন, সরকারী নিয়ম অনুযায়ী ভবনের সঙ্গে থাকা সড়কের দৈর্ঘ্য ৯ ফুট রাখতে বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ ও কাজ করতে ১৫ ফুট সড়ক লাগে। কিন্তু নগরীর অধিকাংশ সড়কের দৈর্ঘ্য ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়। ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মোজাম্মেল হক বলছেন, ভবনগুলো অপরিকল্পিতভাবে তৈরি। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সমস্যা হয়েছে। ভবনের ভেতরে অগ্নিনির্বাপণের তেমন কোন ব্যবস্থাই নেই। পানি সরবরাহও যথেষ্ট নয়। যে কারণে আশপাশের বাড়ি, পাশের ঝিল, খাল থেকে পানি সরবরাহ করতে হয়েছে।
×