ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষার্থী যখন গিনিপিগ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১ জুলাই ২০১৬

শিক্ষার্থী যখন গিনিপিগ

পিঠে ঝুলছে ব্যাগ। ওজন যার পাঁচ থেকে দশ কেজি। তা-ই নিয়ে সাতসকালে শিশুরা ছুটছে স্কুলে। ক্লাসের পড়া, নোট নেয়া পর্ব শেষ হতে হতেই ছুটির ঘণ্টা। তারপর ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে কুঁজো হয়ে ছোটা কোচিংয়ে। সেখান থেকে ক্লান্তি শ্রান্তি মেখে বিকেলে বাড়ি ফিরে কোনরকমে মুখে সামান্য গুঁজে চেয়ার-টেবিলে বসে যাওয়া স্কুল এবং কোচিংয়ের পড়া ও লেখা সম্পন্ন করার জন্য। কারও বা গৃহশিক্ষক আসেন এ সময়ে। নিত্যদিনের এই কর্মসূচীতে বিনোদন নেই। নেই খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা, সঙ্গীত ও আর্ট শেখার নেই সুযোগ ও সময়। পড়া আর পরীক্ষা দিতে দিতেই রবীন্দ্রনাথের সেই তোতা পাখি হয়ে ওঠা শিশুগুলোকে বসতে হয় বোর্ড আরোপিত সমাপনী পরীক্ষায়। আর এ জন্য জীবনমরণ পণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। সঙ্গে ঝাঁপ মারেন অভিভাবক। মানে মা-বাবা। ‘পড়, পড় আর পড়’ শব্দনাদ শুনতে শুনতে শিশুরা বড় হতে থাকে আর পিঠের বোঝার ওজনও বাড়তে থাকে। কাজ বা চাকরি-বাকরি না পেলে নিদেনপক্ষে মুটেগিরি বা কুলিগিরি করার কাজের প্রশিক্ষণও বুঝি হয়ে যায় এই ফাঁকে। পাঠ্যপুস্তক, গাইডবুক আর খাতাপত্রের ভার বইতে বইতে প্রাথমিক থেকে কোমলমতি শিশুটি মাধ্যমিকে পৌঁছে। এই গন্তব্যে যাবার পথে পথে পরীক্ষা আর পরীক্ষার কতশত বহর যে টেনে নিতে হয়, তার হদিস কে রাখে! পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতে ক্লান্তিকর শিশুর মতো তার অভিভাবকরাও ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েন ক্রমাগত। সে এক নিরন্তর পেরেশানি। শিক্ষার্থীকে যত পার পড়া গেলাও। ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে যত পার পড়াকে ধারণ করাও। ঠাঁই হোক আর না হোক মগজের কোষে। মুখস্থ করতে পারা না পারার ওপর নির্ভর করে শিশুর পাস ফেল। তার মধ্যে আরেক উৎপাত সৃজনশীল। আর এর জন্য বাজার ভর্তি রয়েছে গাইড বই। এর দাপটে মূল বই উধাও যেন। এসব গ্রন্থের দামও চড়া। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতা তলায় গিয়ে ঠেকেছে, সৃজনশীল প্রশ্নের জন্য সৃজনশীল গাইড বই আর কোচিং সেন্টারই ভরসা। গ্রামীণ স্কুলগুলোর হাল হকিকত আরও করুণ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’। শিক্ষা নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভেতর যতই মতভেদ থাকুক না কেন, তারা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারেন না। শিক্ষারও উন্নয়ন ও সংস্কার চাইলে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন জরুরী। বঙ্গবন্ধুর সময়কালে প্রণীত ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষানীতি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ নীতি। কিন্তু তাকে পাশ কাটিয়ে গেছে পরবর্তী সব সরকার। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারও। পরীক্ষা আর পরীক্ষার অহেতুক মারণঘাতী যন্ত্রণা থেকে শিশু শিক্ষার্থীদের রেহাই না দেয়ার অর্থই হচ্ছে কোচিং ব্যবসার প্রসার ঘটানো। কোচিংনির্ভর হবার যে শিক্ষানীতি তা সুশিক্ষিত হওয়ার পথে অন্তরায় বৈকি! যে কারণে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অথচ শিক্ষার মান বাড়ছে না। তাদের শিক্ষার্থী নয়। বরং বাড়িয়ে ফেলা হয়েছে মূলত পরীক্ষার্থী। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষার কারণে শিশু কিশোরদের নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সৃজনশীলতা। এর মধ্যে কর্তৃপক্ষের বিচক্ষণতার অভাব প্রকাশ পেলেও তা যে কোচিংবান্ধব এবং এই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণের সহায়ক, তা সবারই জানা। কোমলমতিদের ‘গিনিপিগ’ বানানোর এই ‘মহতী’ উদ্যোগ কল্যাণ বয়ে আনছে না। শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশকে রুদ্ধ করার প্রক্রিয়া আদৌ বন্ধ হবে কিনা কেউ জানে না। ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুশিক্ষিত হওয়ার পথে এই অন্তরায়গুলো কবে দূর হবে কেউ জানে না। শিক্ষার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বিকশিত হোক। অর্থহীন পরীক্ষা, কোচিং গাইড বই বন্ধ হোক- এই প্রত্যাশা।
×