ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মিতু হত্যার সঙ্গে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট জড়িত!

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১ জুলাই ২০১৬

মিতু হত্যার সঙ্গে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট জড়িত!

শংকর কুমার দে ॥ এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু খুনের ঘটনায় বড় ধরনের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট জড়িত। মিতু খুনের প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য পর্দার অন্তরালে কলকাঠি নাড়ছে এই সিন্ডিকেট। এমনকি স্ত্রী মিতু খুনের ঘটনায় স্বামী বাবুল আক্তারকেও ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে অদৃশ্য চক্রটি। বাবুল আক্তারের শ্বশুর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেনও এমন অভিযোগ করে মেয়ে হত্যার বিচার চেয়েছেন। তবে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য বলেছেন, মামলার তদন্ত সঠিক পথেই এগুচ্ছে। তদন্ত ভিন্নখাতে ঘুরিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে মিতু হত্যাকা-ের তদন্তের বিষয়ে দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু খুনের ‘মটিভ কি’ সেই বিষয়টি পরিষ্কার করে বলছে না তদন্তকারীরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্ত্রী মিতু হত্যার মামলায় পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা এবং তদন্দ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে তাঁর পরিবার। তাঁর শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, তদন্ত অন্যদিকে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে এখন মনে করছেন তাঁরা। মোশাররফ হোসেন আরও বলেছেন, “আমার মেয়ে হত্যার বিচার আমি চাই। আমার মেয়ে কোন চাকরি বা ব্যবসা করত না। কিন্তু পুলিশের তদন্তকারীরা হত্যাকা-ের তদন্তের মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে বা এড়িয়ে যাচ্ছে। তদন্ত ডাইভার্ট করা হচ্ছে বা অন্যদিকে নেয়া হচ্ছে। কেন এটা করা হচ্ছে, সেটাই আমাদের প্রশ্ন। স্ত্রী মাহমুদা খানমের হত্যাকা-ের পর থেকে বাবুল আক্তার দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় তাঁর শ্বশুর বাড়িতে থাকছেন। তাঁর শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেছেন, জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে বাবুল আক্তার তাঁর সাথে কোন কথা বলেননি। তিনি পত্রিকায় দেখেছেন যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় বাবুল আক্তারের কাছ থেকে জোর করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। এসব খবর সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণা নেই। কিন্তু বাবুল আক্তার স্ত্রী হত্যায় জড়িত থাকতে পারেন, এটা তাঁরা বিশ্বাস করেন না বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। মোশাররফ হোসেন আরও বলেছেন, হত্যাকা-ের মূল বিষয়ে সঠিক তদন্ত চান। গত শুক্রবার বাবুল আকতারকে গোয়েন্দা পুলিশের দফতরে নিয়ে প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। এরপর নানান প্রশ্ন উঠলেও পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও পরিষ্কার কোন বক্তব্য দেয়া হয়নি। তবে সংবাদ মাধ্যমে বাবুল আকতারের পুলিশে থাকা না থাকার বিষয়েও নানান ধরনের খবর প্রকাশ হচ্ছে। জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটাতে মুখ খুলছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, পর্দার অন্তরালে প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কলকাঠি নাড়ানো অদৃশ্য তৎপরতার কারণে বেকায়দায় পড়তে পারেন এসপি বাবুল আক্তার। মিতু হত্যাকা-ের তদন্তে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তিনটি বিষয়ের মধ্যে প্রথমত পরকীয়া ও দাম্পত্য কলহ, দ্বিতীয়ত চোরাচালান বিশেষ করে সোনা চোরাচালান ও তৃতীয়ত অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে এক জঙ্গী নিহত হওয়ার ঘটনা। এরমধ্যে পরকীয়া ও দাম্পত্য কলহকেও একটি কারণ হিসেবে ধরে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে, যা বাবুল আক্তার ও তার শ্বশুর মোশারফ হোসেনও বিশ্বাস করছেন না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশের জন্য তদন্তের বিষয়ে সমন্বয় করার জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। তদন্তে সমন্বয়হীনতার কারণে খুনের বিষয়ে নানা জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি হচ্ছে। এই ধরনের কথা বলেছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন কর্মকর্তারা। এই খুনের ঘটনা নিয়ে যেভাবে সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি হচ্ছে তাতে সরকার ও পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষায় সন্দেহের অবসান ঘটাতে খুব দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন বলে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। প্রথমে তদন্তে জঙ্গী বিষয়ে সন্দেহ করা হয় ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল হত্যাকা-ের কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘অব্যাহতভাবে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে যে অভিযান চলছে, জঙ্গীদের দমন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের পুলিশ ফোর্স যেভাবে বীরত্বের সঙ্গে কাজ করছে, তাদের বিভ্রান্ত করার জন্য এই পরিকল্পিত হত্যাকা-টি হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। এ ছাড়াও পুলিশের অনেক কর্মকর্তাই মনে করছেন, জঙ্গীবিরোধী অভিযানে বাবুল আক্তারের সাহসী ভূমিকার কারণে তাঁর স্ত্রী টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। এসপি বাবুল আক্তারও জঙ্গীদের প্রতি ইঙ্গিত করে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আপনাদের তো বলেছিলাম, ওরা আমার ক্ষতি করবে। ওরা আমার ক্ষতি করেছে।’ জঙ্গীরাই তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করেছে বলে জানিয়েছিলেন। পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী মিতু হত্যাকা-ের পর পরই দেশব্যাপী জঙ্গী বিরোধী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনাসহ চট্টগ্রামে শিবিরের ক্যাডার গ্রেফতার হয়। তারপর এক পর্যায়ে জঙ্গী ও শিবির বিরোধী অভিযানে ভাটা পড়ে তদন্তের নতুন মোড় নেয়। সোনা চোরাচালান ॥ জঙ্গীদের টার্গেটে পরিণত হয়ে স্ত্রী খুনের ঘটনাটি যখন উবে যায় তখন তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ধারণা দেয়া হয়, বাবুল আক্তার চোরাচালান বিশেষ করে বড় ধরনের সোনার চোরাচালান উদ্ধার করে চোরাচালানি চক্রের রোষানলে পড়েছেন। এ কারণে বাবুল আক্তারকে খুন করতে না পেরে তার স্ত্রীকে খুন করে তাকে স্ত্রী হত্যাকা-ে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে কিনা সেই বিষয়টিও তদন্তের সামনে আনা হয়। কিন্তু তদন্ত বেশিদূর অগ্রসর না হতেই আবার গ্রেফতার হয়ে যায় কয়েকজন খুনী। এর মধ্যে ওয়াসিম ও আনোয়ার খুনের দায়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান, ভোলাসহ আরও দুই খুনী গ্রেফতারের পর তদন্তের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। কিন্তু গত ২৪ জুন রাতে ডিবি কার্যালয়ে নেয়ার পর তিনজন ডিআইজি পদমর্যাদার কর্মকর্তা বাবুলকে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বাবুলকে বলা হয়, তাঁকে বাহিনী থেকে সরে যেতে হবে। নতুবা তাঁকে স্ত্রী মাহমুদা মিতু হত্যা মামলায় আসামি হতে হবে। বাবুল বাহিনী থেকে সরে যাওয়ার বিষয়ে সম্মতি দেন। সে সময়ই তাঁর পদত্যাগপত্রে সই নেয়া হয়। তবে এখনও পদত্যাগপত্রটি উর্ধতন কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছেন কিনা সেই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। বাবুল আক্তারকে বাড়ি থেকে রাতের গভীরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, পদত্যাগপত্রে সই রাখা, তার নিরাপত্তার দায়িত্বে পুলিশ প্রত্যাহার, তাকে গাড়িতে আনা-নেয়া বন্ধ, অনেকটা নজরবন্দীর মতো তার বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রবাহে তদন্ত ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এ বিষয়গুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। ফাঁসানোর জন্যই কি পরকীয়া প্রেম প্রশ্ন ॥ বাবুল আক্তারকে ফাঁসানোর জন্যই কি পরকীয়া প্রেমের বিষয়টি সামনে আনা হচ্ছে এমন অভিযোগ করছেন তার শ্বশুরবাড়ির পরিবার। পরকীয়া প্রেম থাকলে দাম্পত্য কলহ সৃষ্টি হতে পারে, যা পরিবারের কেউ না কেউ না জানবেই। যে যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়েছে তার নাম ও পরিচয় উদ্ধার করতে হবে। এমনকি মোবাইল ফোনে কথা বলা বা কোথাও না কোথাও দেখা করেছেন বা মিলিত হয়েছেন ইত্যাদির মতো প্রমাণ হাজির করতে হবে। এমনকি শ্বশুরালয় বা পিত্রালয়ের কেউ না কেউ এই বিষয়গুলো জেনে যাবেই। কিন্তু এসব তো কেউই বলছেন না। প্রশ্ন উঠেছে ॥ তবে তদন্তের সামনে প্রশ্ন উঠেছে বাবুল আক্তারের মতো একজন দক্ষ ও নিষ্ঠাবান পুলিশ অফিসার তার স্ত্রী মিতুকে হত্যার জন্য সোর্স মুসাকেই ব্যবহার করবেন? এছাড়া পরকীয়ার কারণে যদি স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্য হয় তাহলে তাকে হত্যা করতে হবে কেন? সংসার না করলেই তো পারতেন। সর্বোপরি এ দাম্পত্য কলহের বিষয় গোপন থাকার কোন সুযোগ নেই। কেউ না জানলেও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন অবশ্যই জানতেন। কিন্তু তারা কি এসব কখনও শুনেছেন? আক্ষেপ করে মিতুর মা বললেন, আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট- আমার মেয়েটা চলে গেল। এরপর তোরা আমার জামাইকে (এসপি বাবুল) প্যাঁচাইলি কেন? বাবুল একটা ফেরেস্তা। এখন আমার জামাইকে নিয়ে ওরা আজেবাজে কথা বলছে। আমার ছেলে নেই, ওকে আমরা ছেলের মতো দেখি। ১৪ বছর ওর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। কোনদিনও অশান্তি হয়নি। বাবুলের শাশুড়ি বলেন, বিশ্বাস করি না বাবুল আমার মেয়েকে খুন করেছে বা নির্দেশ দিয়েছে। প্রসঙ্গত গত ৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা। হত্যাকা-ের পর বাবুল বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন।
×