ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহতরা জরুরী সেবা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন

ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেন্টার স্থাপন উদ্যোগ থেমে গেছে

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১ জুলাই ২০১৬

ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেন্টার স্থাপন উদ্যোগ থেমে গেছে

নিখিল মানখিন ॥ দেশের প্রতিটি মহাসড়কের আশপাশে ‘ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ সেন্টার স্থাপনের সরকারী উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ কার্যক্রমের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান স্বয়ং স্বাস্থ্য অধিদফতরও এ বিষয়ে নতুন কিছু বলতে পারছে না। দাতাদের টাকায় এ বিষয়ে কয়েকটি সেমিনারের আয়োজন এবং কার্যক্রম বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অথচ দেশের সর্বত্র সড়ক দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মহাসড়কের আশপাশে ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেন্টার না থাকায় দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত রোগীরা দ্রুত চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। সড়ক দুর্ঘটনা যে প্রকারেই হয়ে থাকুক, আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের দায়িত্ব স্বাস্থ্য সেক্টরের উপরেই গিয়ে পড়ে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা ও স্বাস্থ্য সেক্টরের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১১ সালে সরকার ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক কার্যক্রম : ২০১১-২০’ কার্যক্রম গ্রহণ করে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আটটি মন্ত্রণালয় ও কয়েকটি বেসরকারী সংস্থা সমন্বিতভাবে এটি বাস্তবায়নে কাজ করবে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও মৃত্যুর হার শতকরা ৫০ ভাগে কমিয়ে আনাসহ আহতদের যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে দেশের প্রতিটি মহাসড়কের আশপাশে ‘ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার সেন্টার’ স্থাপন করার উদ্যোগ নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ সব সেন্টারে সার্জারিসহ বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করবেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোড সেফটি এ্যান্ড ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে ইনজুরি ও মৃত্যুর হার শতকরা ৫০ ভাগে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করা হবে। এ কার্যক্রম সফল হলে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ৫০ লাখ মৃত্যু এবং ৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১৩ লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। দুর্ঘটনার শিকার হয় আড়াই থেকে ৫ কোটি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। যার মধ্যে শতকরা ৪৬ ভাগ পথচারী, সাইকেল ও মোটরসাইকেল আরোহী। শতকরা ৪৮ ভাগ মোটরযান যাত্রী। কম ও মধ্য আয়ের দেশসমূহে শতকরা ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। যাদের মধ্যে নিবন্ধনকৃত গাড়ির সংখ্যা শতকরা ৪৮ ভাগ। বাংলাদেশেও সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র ভয়াবহ। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মতে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় এফআইআরের সংখ্যা প্রতি বছর ৫ হাজারের বেশি। ২০০১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর গড় হার শতকরা ১৪ ভাগের বেশি। সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে দেশের প্রতি বছর ৩ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা ক্ষতি হয়, যা দেশে জিডিপির শতকরা ১.৫ ভাগ। আর এই ক্ষতির পরিমাণ দেশে সড়ক ও জনপথ বিভাগের বাৎসরিক বাজের প্রায় ৩ গুণ। প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের বড় অংশ যথাযথ ও সঠিক সময়ে চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে মারা যায়। সরকারী হিসাবে, ২০১২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২ হাজার ৫৩৮। ওই বছর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৬৩৬। ২০১৩ সালে দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ২৯। নিহত হন ১ হাজার ৯৫৭। আর ২০১৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ২ হাজার ৬৭। সড়ক দুর্ঘটনা যে প্রকারই হয়ে থাকুক, আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের দায়িত্ব স্বাস্থ্য সেক্টরের উপরেই গিয়ে পড়ে। ১১ কর্মকৌশলের বিষয়টি উল্লেখ করে রোড সেফটি এ্যান্ড ইনজুরি প্রিভেনশন প্রোগ্রামের ফোকাল পয়েন্ট ডাঃ এ কে এম জাফর উল্লাহ জনকণ্ঠকে জানান, এ কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক ব্যবহারের আচরণগত পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হবে। যানবাহনের জন্য নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো তৈরির ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে। পাঠ্যবইয়ে সড়ক ব্যবহারের নিরাপদ উপায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ত্রুটিমুক্ত যানবাহন চলাচলে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এ সংক্রান্ত প্রচলিত আইন সংশোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের দ্রুত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রেরণের উদ্যোগ নেয়া হবে। মহাসড়ক সংলগ্ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ট্রমা সেন্টারে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের সেবার যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। দুর্ঘটনার শিকার মারাত্মক পঙ্গুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। সর্বোপরি এ কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় ও যোগাযোগ নিবিড় করা হবে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানায়, ‘ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ সেন্টার স্থাপনের বিষয়টি অনেক আগেই ধামাচাপা পড়ে গেছে। দাতাদের কাছ থেকে অর্থ পাওয়া গেলে বাস্তবায়নের বিষয়টি উত্তোলন করা হয়। দাতাদের টাকায় একের পর এক সেমিনার-কর্মশালা হয়। অর্থ ফুরিয়ে গেলেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও বন্ধ হয়ে যায়। ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক কার্যক্রম : ২০১১-২০’ কার্যক্রমের একটি অংশ ছিল ‘ট্রমাটিক ও ক্রিটিক্যাল কেয়ার’ সেন্টার নির্মাণ। সড়ক নিরাপত্তা দশক কার্যক্রমটিই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। আর ৮ মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করানোর বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় হচ্ছে না। এ বিষয়ে একেক মন্ত্রণালয় ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছে। এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
×