ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শামসুদ্দোহা চৌধুরী, জাফর ইকবাল আয়নাল

পলাশীর যুদ্ধ ॥ ইতিহাসের প্রহসন

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ১ জুলাই ২০১৬

পলাশীর যুদ্ধ ॥ ইতিহাসের প্রহসন

মুর্শিদাবাদ। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর স্বপ্নের নগরী। রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর থেকে মুর্শিদ কুলি খাঁ তার রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন মুর্শিদাবাদে। বুড়িগঙ্গার তীর থেকে সুবে বাংলার রাজধানী সরে গেল ভাগিরথী তীরে মুর্শিদাবাদে। পরবর্তীতে এই স্বপ্ন নগরীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলো সুবে বাংলার মসনদ। বাংলাবিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাবদের সুরক্ষিত বাসভবন হিরাঝিল, মতিঝিল, হাজার দুয়ারির রহস্যঘেরা স্বপ্নীল প্রাসাদ। অদূরে স্বচ্ছ সলিলা ভাগিরথী। ভাগিরথীর ছোট্ট ঢেউ নূপুরসম শব্দে আছড়ে পড়ে মুর্শিদাবাদে। হীরাঝিলের স্বপ্নীল প্রাসাদে হাজারও মোমের ক্ষীণ শিখার মৌন আর্তনাদে গম্ভীর প্রাসাদ। হাজার দুয়ারী প্রাসাদের দ্বারে দ্বারে দাঁড়ানো নাঙ্গা তরবারী হাতে সশস্ত্র প্রহরী। চারদিকে সুনসান নীরবতা ভেঙ্গে দরবারের শিকল টানা ঘণ্টা বেজে উঠে। সশস্ত্র প্রহরীর নাঙ্গা তরবারী ঝিলিক দিয়ে ওঠে। নকীবের ফরমানে গমগম করে ওঠে মুর্শিদাবাদের দরবার। রাজকীয় ফরমান হাতে কে এলো আবার? বাংলার আনাচে কানাচে দুর্বৃত্তদলের পাশবিক অত্যাচারে শান্ত সুশীতল বাংলায় নেমে আসছে দুর্যোগের ঘনঘটা। আলিবর্দি খাঁর সাজানো বাগানে কী ঢুকলো সাপ? ভাগিরথীর প্রমোদ নৌকায় বাঈজিদের নূপুরের নিক্কন কী যাবে থেমে? ওস্তাদের কণ্ঠের দরবারী কানাড়ায়, এস্রাজের মধুর ঝঙ্কারে হাজার দুয়ারী প্রাসাদের রঙমহলে সুরের মূর্ছনা তুললেও সে সুরে যেন নেমে আসছে অন্ধকার। ভাগিরথীর তীরে নৌজাহাজে অবস্থানরত ভীনদেশী নাবিকদের চক্ষুস্থির। ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে বৃত্তাবদ্ধসমৃদ্ধ নগরী মুর্শিদাবাদ। রাত যত গভীর হয় জগৎশেঠের প্রাসাদের গুপ্তকোঠায় ফিসফিস গুঞ্জনের ধ্বনী গুমরে গুমরে ওঠে। অশ^শকটে দীর্ঘ কালো পর্দা টেনে রওনা হয় বিশ^াস ঘাতকের দল। জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, রায়দুর্লভ, জানকীরামের রাত্রিকালে আনাগোনা আরও নিবিড় হয়। ওরা যে কোন মূল্যে পতন ঘটাতে চায় নবাবের। বাংলার জগৎশেঠের কাড়ি কাড়ি মোহরের লোভে আসে শকুনির দল। যে কোন কিছুর বিনিময়ে বিশ^াসঘাতকের দল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার গলায় গোলামীর জিঞ্জির পরাতে চায়। এদিকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর তীর থেকে আসা বেনিয়াগোষ্ঠীর চোখে ধাঁধাঁ করে রঙ্গীন স্বপ্ন। বণিকের দ- থেকে যদি রাজদ- হাতে নেয়া যায়, তো ভাগ্যের চাকা মুহূর্তেই যাবে পাল্টে। বণিক হবে রাজা, বাংলার ভাগ্যবিধাতা। নেটিভদের কিছু খোরপোষ পেনশন দিয়ে নির্বাসনে পাঠিয়ে একদিন সাহেবরা হয়ে যাবে সম্রাট। নেটিভরা বাধ্য হয়ে সেলাম না ঠুকে যাবে কোথায়? ষড়যন্ত্রের জটাজালে ফেললে তারাই বাধ্য হবে বেনিয়াদের সিংহাসনে বসাতে। এমনি এক সময়। ঘোর অমাবিশার ক্ষণ চলছে। চিন্তামগ্ন মুর্শিদাবাদের নবাব। উৎকণ্ঠিত নবাবের কাছে বিশ^স্ত বন্ধুর বড় অভাব। সময় ১৭৫৭ সাল। বাংলা বিহার উড়িষ্যার ভাগ্যাকাশে সত্যিই ছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। বেদনাহত সম্রাটকে কে দেবে আশা-ভরসা, কে দেবে দিক-নির্দেশনা। ক্লাইভের খঞ্জর মুর্শিদাবাদের রাজপথে রক্তের নহর বহালো। বিশ^াসঘাতকদের পাশবিক উল্লাসের অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল হীরাঝিল, মতিঝিল, হাজার দুয়ারী প্রাসাদ। মুর্শিদাবাদের নবাব ॥ পূর্বকথা ১৫৭৬ সালের যুদ্ধে রাজমহলে বাংলার সুলতান দাউদ খান কররানী মোগলদের কাছে পরাজিত হন। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গভূমে সে সময় থেকেই মোগলদের অভিযান শুরু। ১৫৭৬ সালের যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত হলে মূলত বাংলা বারো ভূঁইয়ার অধীনে চলে যায়। স্বাধীনভাবেই বারো ভূঁইয়ারা দেশ চালাতেন। মোগলদের অভিযান কিন্তু থেমে থাকেনি। ১৬০৮ খ্রিঃ মসনদে আলা মূসা খাঁ মোগল সুবেদার ইসলাম খানের নিকট পরাজিত হলে মোগলদের বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন পূরণ হয়। নতুন রাজধানী হয় জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা। ঢাকাকে কেন্দ্র করে মোগল সুবেদারদের চলতে থাকে সুবে বাংলার প্রশাসন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় পর্যন্ত মোগলরা সাম্রাজ্যের অধিকর্তা হিসেবে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করলেও সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬০৮-১৭০৭) মৃত্যুর পর পরবর্তী মোগল সম্রাটদের অযোগ্যতা ও দুর্বল শাসনের জন্যে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। বিশাল মোগল সাম্রাজ্যের চারদিকে জ্বলে উঠে বিদ্রোহের দাবানল। দুর্বল মোগল সম্রাটদের পক্ষে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দমন করা কোনক্রমেই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রায় শত বৎসর বাংলাদেশ মোগলদের অধিকারে ছিল। মোগলদের দুর্বল শাসকদের সুযোগে বাংালাদেশে স্বাধীন শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়। সুবাদার মুর্শিদ কুলি খাঁ (১৭১৭-২৭) বাংলাদেশে স্বাধীন রাজত্ব কায়েম করেন। মুর্শিদ কুলি খাঁর উত্তরাধিকারী সুজাউদ্দীন (১৭২৭-৩৯) সরফরাজ খান (১৭৩৯-৪০) আলিবর্দি খাঁ (১৭৪০-৫৬) ও সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৬-৫৭) নামমাত্র মোগল সম্রাটদের আনুগত্য স্বীকার করতেন। তারাই বাংলার নবাব বা মুর্শিদাবাদের নবাব হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। মুর্শিদাবাদ নবাবদের উদার পৃষ্ঠপোষকতার পুরোপুরি সুযোগ গ্রহণ করে হিন্দু সম্প্রদায়। সুলতানী যুগে বা তা পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলায় সুলতানদের উদার পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম রেনেসাঁর উদ্ভব হয়েছিল। স্থাপত্য, শিল্পকলায়, শিক্ষাদীক্ষায়, অর্থনীতিতে মুসলিমদের এক শক্ত ভিত রচিত হয়েছিল। মুসলিম সুলতানগণ শুধু মুসলমানদেরই পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। সুলতানদের উদার মনোভাবের জন্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও রাজ্যের প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। হিন্দুদের প্রশাসনে যোগ দেয়ার বিষয়টি আরও ত্বরান্বিত হয় নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর সময়ে। মুর্শিদ কুলি খাঁ যখন নবাব হিসেবে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত সে সময় থেকেই তার প্রশাসনে হিন্দু আমলাদের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। মোগল আমলে বহু জায়গীর ও জমিদারী মুসলমানদের করায়ত্ত ছিল। বড় বড় জায়গীরদার ও জমিদারদের অধিকাংশ মুসলমান ছিলেন। কয়েকজন মুসলমান জমিদার রাজস্ব আদায় করতে অসমর্র্থ হওয়ায় তিনি তাদের জমিদারী কেড়ে নেন এবং হিন্দুদের বন্দোবস্ত দেন। এরূপ মাহমুদপুর (নদীয়া-যশোহর) ও জালালপুর পরগনার কয়েকটি মুসলমান জমিদারী রামজীবনকে দেয়া হয়। সোনারগাঁওয়ের ঈসা খাঁনের বংশধরদেরও কয়েকটি পরগনা হারাতে হয়। মুর্শিদ কুলি খাঁন তাদের জমিদারী আলাপশাহী ও মোমেনশাহী পরগনাদ্বয় কেড়ে নেন এবং দুজন রাজস্ব কর্মচারীকে উক্ত জমিদারী বন্দোবস্ত দেন। সিরাজউদ্দৌলা মানিক চাঁদ ও নন্দকুমারকে যথাক্রমে কলকাতা ও হুগলির ফৌজদার পদে নিয়োগ করেন। প্রশাসনে হিন্দু আমলাদের প্রাধান্য কালক্রমে নবাবকে এক ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। সে ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বের হতে পারেননি। জগৎশেঠ ॥ ইতিহাসের খলনায়ক জগৎশেঠ বাংলার ইতিহাসে এক খলনায়ক। যুবক নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বিপাকে ও বিপদে ফেলার জন্য জগৎশেঠ বাংলা ও বাঙালীর ইতিহাসে এক কলঙ্কিত খলনায়ক হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে। ধনাঢ্য ব্যক্তি ও নবাবদের ব্যাংকার জগৎশেঠ তার অর্থের মায়াজালে শুধু মুর্শিদাবাদের নবাবদেরই গ্রাস করেননি ইংরেজদের কাছেও জগৎশেঠ প্রিয়পাত্র ছিলেন। সে সময় শুধু নবাবদের লেনদেনের কাজ করেই জগৎশেঠ বছরে ৪০ লাখ টাকা মুনাফা করতেন। রবার্ট ওমের ভাষায়Ñ মকসুদাবাদে, মুর্শিদাবাদে এক হিন্দু পরিবার ছিল এবং ওই পরিবারের প্রধান ছিলেন জগৎশেঠ। জগৎশেঠ সামান্য অবস্থা হইতে সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ ব্যাংকার হয়েছিলেন, সাম্রাজ্যের বহুস্থানে তার দালাল ছিল এবং ঐ সকল দালালদের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের শাসনকার্যের বিষয়-আশয়ের অনেক তথ্য অবগত হতেন। বাংলাদেশে তার প্রভাব উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর সমকক্ষ ছিল। তিনি জমিদার ও ইজারাদারদের রাজস্বের জামিন হতেন, এমনকি দেশের যে কোন অর্থ সঙ্কটে তাহার সাহায্যের প্রয়োজন হতোÑ এই বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়া সম্ভব হয়েছিল মুর্শিদাবাদের নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যই। নবাবের এই উদার পৃষ্ঠপোষকতাই একদিন নবাবের জন্য কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল। মুসলমানদের শাসনকে হিন্দু অমাত্যরা কখনও সুনজরে দেখত না। ব্যবসা বাণিজ্যের কারণে ইংরেজদের সাথে হিন্দুদের সু-সম্পর্ক সাম্রাজ্য গ্রাসের এক ধরনের হীন চিন্তা-ভাবনার জন্ম হয়েছিল। রবার্ট ওম আরও লিখেছেনÑ ‘হিন্দু রাজা ও জমিদারগণ মুসলমানদের শাসনে খুবই অসন্তুষ্ট ছিল এবং এ শাসনের অবসানের জন্যে সুযোগ অন্বেষণ করিতে ছিল।’ রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জীবন কাহিনী রচয়িতা রাজীবলোচন লিখেছেনÑ ‘হিন্দু জমিদার ও প্রধানগণ সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলন।’ এভাবেই চারদিক থেকেই ষড়যন্ত্রের নেটওর্য়াক সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছিল এবং প্রাসাদের ভিতরেও চলছিল এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড় থেকে আসা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেনিয়াগোষ্ঠীও ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেয়ে খুব সতর্কতার সাথেই নবাবের ধ্বংস সাধনে অগ্রসর হচ্ছিল। সুচতুর ইংরেজ ॥ বাণিজ্যের ছত্রছায়ায় রাজতৈতিক কার্যকলাপ সুচতুর ইংরেজ। কূটকৌশল এবং হিংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজদের ব্যবসাকে প্রসারিত করা এবং তার সাথে প্রচুর অর্থ আয়ের যাবতীয় কলাকৌশলই ছিল এদেশে আসা গুটিকয়েক ইংরেজের নখদর্পণে। ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে শাহ সুজা মাত্র তিন হাজার টাকা বাৎসরিক করের মাধ্যমে ইংরেজদের বাংলার সর্বত্র বাণিজ্য করার অধিকার দিয়েছিলেন। শাহ সুজার দেয়া এই বিশাল প্রাপ্তিতে ইংরেজরা শুধু রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছই হয়নি। কূটকৌশলী এবং স্বার্থান্বেষী ইংরেজ বাণিজ্যের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কুঠির পাশাপাশি সেখানে গোপনে দুর্গ নির্মাণ ও অস্ত্রশস্ত্রের মজুদও আরম্ভ করেছিল। ইংরেজদের এসব কার্যকলাপের খবর দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে পৌঁছলে তার নির্দেশে ইংরেজদের সুযোগ-সুবিধা অনেকাংশে রহিত করা হয়। সুবেদার শায়েস্তা খাঁন তো ইংরেজদের কোণঠাসা করেই রেখেছিলেন। কিন্তু সব দিন তো আর সমান যায় না। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজদের বাণিজ্যের দুয়ার ফের খুলে যায়। ঘটনাটি ছিল এরকমÑ দিল্লীর সম্রাট ফররুখশিয়র হ্যামিল্টন নামক এক ইংরেজ চিকিৎসকের চিকিৎসায় যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়ে ইংরেজ চিকিৎসককে পুরস্কৃত করতে চেয়েছিলেন। সুচতুর ধুরন্ধর ইংরেজ হ্যামিল্টন নিজের আর্থিক সুবিধার কথা না ভেবে স্বজাতির বাণিজ্যের জন্যে বিশেষ সুবিধা প্রার্থনা করেছিলেন। চিকিৎসকের অনুরোধই বহাল হলো। বার্ষিক মাত্র তিন হাজার টাকার বিনিময়ে ইংরেজরা বাংলাদেশে অবাধ বাণিজ্যের সুবিধা লাভ করল। বাণিজ্যের ঐশ^র্য ইংরেজদের মুঠোবন্দী হবার ফলে তাদের চোখে রঙ্গিন স্বপ্ন জাগে মুর্শিদাবাদের মসনদের দিকে। মুসলমান শাসকদের রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক অদূরদর্শিতা এবং অপরিপক্ব কূটনীতির সুযোগে ইংরেজ বেনিয়াদের এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মাথা গলানোর সুযোগ করে দেয়। ইংরেজদের বন্ধু হয়ে ওঠে হিন্দু জমিদারগণ। নবাব আলিবর্দি খাঁর রাজত্বকালে গোলন্দাজ বাহিনীর এক ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল স্কট ইংল্যান্ডে চিঠি লিখেছিলেনÑ ‘যদি ইউরোপীয় সৈন্যগণ ভালোভাবে অভিযান শুরু করে এবং হিন্দুদিগকে নানাভাবে উৎসাহিত করা যায় তবে হিন্দুরা ইংরেজদের সাথে যোগ দেবে।’ ইংরেজরা বাণিজ্যের আবরণে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে অস্ত্রের ভা-ারও গড়ে তুলেছিল। এক সময় তারা এমন প্রতাপশালী হয়ে ওঠে এবং কালক্রমে কলকাতার সার্বভৌমত্বই দাবি করে বসে। এ সমস্ত ঘটনা একের পর এক নবাব আলিবর্দি খাঁর চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছিল। কিন্তু বৃদ্ধ নবাব আলিবর্দি খাঁ প্রতিরোধ করার সময় ও সুযোগ পাননি। এর কিছুদিন পর নবাব আলিবদি খাঁর দেহাবসান হয়। চক্রান্তের বেড়াজাল বাড়তে থাকে। মুর্শিদাবাদের মসনদ নিয়ে ভিতরে বাহিরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে এক জঘন্য চক্রান্তে মেতে উঠে রাজকর্মকর্তা, রাজকর্মচারী, জমিদার এবং নবারের নিকটস্থ কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। ষড়যন্ত্র ॥ ক্লাইভের ভাষায় ঘরপব রসঢ়ড়ৎঃধহঃ এধসব (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) পলাশী ষড়যন্ত্রের বীজবপন করা হয়। ফোর্ট সেন্ট কাউন্সিলের নির্দেশনামায় নির্দেশ দেয়া হয়। শুধু কলকাতা পুনরুদ্বার ও বিপুল ক্ষতিপূরণ আদায় করলে চলবে না, নবাবের উগ্রতায় বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিবর্গ যারা নবাব হতে অভিলাষী তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্যে গোপন নির্দেশ দেয়া হয়। রবার্ট ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গবর্নর হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তার পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল ফরাসীদের বাংলা থেকে বিতরণ এবং পলাশী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। শক্রভাবাপন্ন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পদচ্যুত করে একজন অনুগত বংশবদ ব্যক্তিকে নবাবী পদ-প্রদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোর্ট অব ডিরেক্টরকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। কোর্র্টের উত্তরের অপেক্ষা না করে তিনি ১৭৫৭ সালের মার্চে চন্দননগরের ফরাসী উপনিবেশ দখল করে নেন। অপেক্ষায় থাকেন তার শেষ শত্রু নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে কিভাবে উৎখাত করা যায়। তিনি বুঝতে পারলেন নবাবের বিরুদ্ধে দরবারে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। জগৎশেঠ ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি। ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল এবং দরবারের অস্তুষ্ট অমাত্যদের মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদনের জন্যে উমিচাঁদকে কাজে লাগালেন। ১৭৫৭ সালের ১৯ মে সম্পাদিত গোপন চুক্তি ছিল এর ফল। ক্লাইভ মীরবখশি মীরজাফর আলী খানকে অভ্যুত্থানের নেতা নির্বাচিত করেন। নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, প্রাসাদের ভেতরে আলিবর্দি খানের প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলার এক বছরের শাসনকাল মূলত ছিল খুবই কন্টকাকীর্ণ। সাম্রাজ্যের চারিদিকের হিন্দু অমাত্যদের ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি হীরাঝিল, মতিঝিল প্রাসাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনরা সিরাজের বিরুদ্ধে জঘন্য ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেছিল। বিশেষ করে আলিবর্দি খানের উত্তরাধিকারী সিরাজউদ্দৌলাকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন আলিবর্দি খাঁর মেয়ে ঘষেটি বেগমের পছন্দ ছিল না। ঘষেটি বেগম চেয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব হবে তার পুত্র। আলিবর্দি খাঁর ইচ্ছার কাছে পরাজিত ঘষেটি বেগম ভিতরে ভিতরে ফুঁসছিলেন। সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদের মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর মুর্শিদাবাদের অপূর্ব সুন্দর ইমারতে বসবাসরত ঘষেটি বেগমের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। তিনি অবিলম্বে মতিঝিল প্রাসাদের ধন সম্পদ দাবি করলেন। ঘষেটি বেগম বেঁকে বসলেন। এবং প্রতিরোধেরও হুমকি দিলেন কিন্তু ঘষেটি বেগমের প্রেমিক মীর নজর আলী ১৫ লাখ টাকার হীরা-জহরত নিয়ে বেনারসে পলায়ন করেন। অবশেষে ঘষেটি বেগমকে আত্মসমর্úণ করতে হলো। ঘষেটি বেগম এ অবমাননা ভুলতে পারেননি। নবাব মীরজাফরকে সরিয়ে বখশি পদে মীরমর্দানকে নিয়োগ দেন। মোহনলালকে দিউয়ান খানার পেশকার পদে উন্নীত করেন। নিজ পদ থেকে বিতাড়িত এবং বিত্ত-বৈভব হারিয়ে ক্ষোভের আগুনে জ্বলছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। আর এদিকে ইংরেজদেরও নবাব পছন্দ করতে পারেননি; কারণ দিল্লীর সম্রাটের দেয়া ফরমান ইংরেজরা যথাযথভাবে কার্যকরী করেনি, যার ফলে নবাবের শুল্ক আদায় এবং রাজকোষে অর্থের পরিমাণ অনেক কমে আসে। ষড়যন্ত্র বাইরে ষড়যন্ত্র শুধু প্রাসাদের ভিতরেই ছিল না। প্রাসাদের সীমানা ছাড়িয়েও ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল সবখানে। তার সঙ্গে মেতে উঠলো নবাবের নিয়োগকৃত বিভিন্ন প্রদেশের রাজস্ব সংগ্রহকারী। নবাবের অসৎ রাজকর্মচারীরা রাষ্ট্রের টাকা আত্মসাতের মহোৎসবে মেতে ওঠে। বিভিন্ন উপায়ে তহবিল তসরুপ করে তারা পালিয়ে গেল ইংরেজদের আশ্রয়ে কলকাতায়। জাহাঙ্গীরনগরের দিওয়ান রাজা রাজবল্লভ জাহাঙ্গীরনগরের রাজকোষ থেকে তিন কোটি ত্রিশ লাখ টাকা আত্মসাত করে এবং তার অর্থ-সম্পদ পরিবার-পরিজনসহ কলকাতার ইংরেজদের কাছে আশ্রয় নেন। নবাব এ সংবাদ পেয়ে রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসসহ আত্মসাতকৃত টাকা ফেরত দেয়ার জন্য গবর্নর ড্রেককে নির্দেশ দেন। গর্ভনর ড্রেক নবাবের আদেশ অমান্য করার পাশাপাশি নবাবের প্রেরিত দূতকে অপমান করেন। এ অবাধ্যতার কারণে ১৭৫৬ সালের ৪ জুন নবাব ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠি দখল করেন। ২০ জুন কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নেন। ৩৯ জন ইংরেজ বন্দীকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কারাগারে ১৮ জন ইংরেজ বন্দীর মৃত্যু হয়। ১০ অক্টোবর ১৭৫৬ সালে পূর্ণিয়ার মনিহারী নামক এক স্থানে যুদ্ধে শওকতজংকে পরাজিত ও নিহত করেন। এর ফলে নবাবের একজন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অপসারিত হলো। কলকাতা পতনের খবর পেয়ে মাদ্রাজ থেকে রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে ১৪ ডিসেম্বর ১৭৫৬ সালে ত্রিশটি নৌবহর ভাগীরথী নদীতে প্রবেশ করে। ১৭৫৭ সালের ২ জুন ক্লাইভ অতিসহজেই কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন। পরবর্তী অভিযানে নবাব ইংরেজদের সাথে আলীনগরের সন্ধি করে মারাত্মক ভুল করে বসেন। ইংরেজরা পুনরায় বাণিজ্যের সুবিধাসহ ফোর্ট ইউলিয়াম দুর্গ পুনর্নির্মাণে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করে। যুদ্ধের বিবরণ চুক্তিস্বাক্ষর সত্ত্বেও পরিকল্পিত ‘বিপ্লব’ বাস্তবায়নের জন্য ইংরেজদের সিলেক্ট কমিটি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। সরাসরি মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হবে না মীরজাফরের নিকট অভিযান পরিচালনার কৌশল জানার জন্য আরও অপেক্ষা করবেÑ এ নিয়ে ১১ জুন সিলেক্ট কমিটি ধীর ও সতর্ক চিন্তাভাবন করতে থাকে। সিলেক্ট কমিটিতে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহীত হয়Ñ ‘বর্তমান সন্ধিক্ষণে সবচেয়ে সুবিধাজনক কাজ হবে মীরজাফরের পক্ষে বিপ্লব বাস্তবায়ন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা, কেননা বিলম্ব হয়ে গেলে ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে যাবে এবং সম্পূর্ণ পরিকল্পনা ভ-ুল হয়ে যাবে। সম্মিলিত দেশীয় শক্তির বিরুদ্ধে তখন ব্রিটিশদের একা থাকতে হবে মাঠে। তদানুসারে ১৩ জুন ক্লাইভ- মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। কাটোয়া পৌঁছেন ক্লাইভ ১৯ জুন। স্থানটি আগের দিনই কর্নেল কুট দখল করে নিয়েছিলেন। ২১ জুন ক্লাইভ সমর পরিষদের সভা ডাকেন এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন বরং মীরজাফরের চূড়ান্ত চিঠির অপেক্ষায় থাকেন। সেই প্রতীক্ষিত বার্তাটি পেয়ে যান ক্লাইভ ২২ জুন। ২২ জুন ক্লাইভ তার বাহিনী নিয়ে পলাশীর পথে যাত্রা করেন। দুপুর রাত্রের পর পলাশী এসে উপস্থিত হন। সিরাজউদ্দৌলা তার বিশাল বাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা দেন এবং শক্রকে মোকাবেলা করার জন্য পলাশীতে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৮টায় যুদ্ধ আরম্ভ হয়। মীর মর্দান, মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদী, নবসিং হাজারী প্রমুখের অধীনে নবাব বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালান। অন্যদিকে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ রায়ের অধীনে নবাবের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্য ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ও পরিস্থিতি অবলোকন করে। বেশ কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পরও চূড়ান্ত কিছু ঘটেনি। এমন প্রতিরোধ ক্লাইভও আশা করেনি এবং এই মর্মে জানা যায় যে, দিনে যথাসম্ভব তীব্র যুদ্ধ চালিয়ে ক্লাইভ রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বেলা তিনটার দিকে কামানের এক নিক্ষিপ্ত গোলায় মীরমর্দানের আকস্মিক মৃত্যুতে হতভম্ভ নবাব মীরজাফরকে ডেকে পাঠান। বাংলার স্বাধীনতার ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য মীরজাফরের কাছে আকুল অনুরোধ করেন। মীরজাফর নবাবকে ওই দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করতে নির্দেশ দেন এবং এ খবরটি গোপনে ক্লাইভের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পরামর্শমতো নবাবের সেনাদল পিছু হটতে থাকলে ইংরেজ সৈন্যরা নতুন উদ্যমে প্রচ- আক্রমণ চালায় ফলে নবাবের বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যায়। অপরাহ্ণ ৫টার দিকে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা শুরু করে। জনউড নামক একজন ব্রিটিশ সৈন্য পলাশী যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। তার ভাষায়Ñ এটাই ছিল সেই বিশিষ্ট ও চূড়ান্ত যুদ্ধ, যেখানে কোন ব্যাপক আক্রমণ ছাড়াই যুদ্ধজয় ও রাজ্য জয় করা যায়। পলাশীর যুদ্ধে নবাবের পরাজয় ছিল সামরিক নয়, সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক। নবাব যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন এবং পরদিন সকালে মুর্শিদাবাদে পৌঁছেন। মুর্শিদাবাদে ফিরে নবাব তার সৈন্যদলকে একত্রিত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। বেগম লুৎফুন্নেছা ও কন্যাকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ হতে রাজমহলের দিকে যাত্রা করেন। কিন্তু রাজমহলের নিকটে মীরজাফরের জামাতা মীরকাশিমের হাতে ধরা পড়েন এবং মুর্শিদাবাদে নিহত হন। মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শেষকথা ২৩ জুনের যুদ্ধে বাংলার নবাব তো পরাজিত হননি, পরাজিত হয়েছিলেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার জনগণ। সাত সমুদ্র পার হতে আসা যে বেনিয়াগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসেছিল বাণিজ্যের জন্য, এ দেশের কিছু বিশ^াসঘাতকের জন্য সেই বেনিয়াগোষ্ঠীই হয়ে গেল রাজা। কালক্রমে সারা ভারতবর্ষই একদিন পদানত করেছিল তারা। গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ বাঙালী পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখির মতোই ছটফট করছিল। হায় পলাশী, রাক্ষুসী পলাশীকে নিয়ে বাঙালী কেঁদে বুক ভাসিয়েছে কিন্তু ফেরাতে পারেনি বাংলা বিহার উড়িষ্যার এবং মুর্শিদাবাদের সেই ঝলমল দরবার। পলাশী থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত নয় কি?
×