ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

টুটুল মাহফুজ

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গন্ডি বাঁধতে পারেনি তাদের

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ১ জুলাই ২০১৬

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গন্ডি বাঁধতে পারেনি তাদের

স্কুল থেকে পালানোর দুটো কারণ হতে পারে। এক, স্কুলের শিক্ষা আর ভাল লাগে না বা স্কুলে পড়তে আগ্রহ তৈরি করা যাচ্ছে না। দুই, নতুন স্কুল তৈরি করা! পৃথিবীর ইতিহাসে স্কুল পালানো মহান ব্যক্তিত্বদের সংখ্যা কোন কালেই কম ছিল না। কি কারণে স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহান প্রতিভাধর ব্যক্তিরা থাকতে পারে না এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। অনেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না অথবা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসকে অপূর্ণ বা কম মনে করে। আবার কেউ এই বিশ্ব নামের উন্মুক্ত শিক্ষাঙ্গনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। তাই শৃঙ্খলার আলয় থেকে বের হয়ে যায় স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে। প্রমথ চৌধুরীর ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’ এ কথাটি মনে করে দেয় বার বার। স্কুল পালানো স্বশিক্ষিত লোকেরা এমনই মহীরুহে পরিণত হন যে তাদেরকে ঘিরে স্কুল গড়ে ওঠে। উইন্সটন চার্চিল স্কুলে মারামারি আর দাঙ্গাবাজির জন্য কুখ্যাত ছিলেন উইন্সটন চার্চিল। পড়ার চেয়ে মারপিটের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন স্কুলে। স্কুল কোন মতে শেষ করেই মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হয়ে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অতি সাধারণ একজন প্রতিবেদকের কাজ করেছিলেন এবং জার্মান সেনাদের হাতে আটকও হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই স্কুল পালানো ছেলেটিই ইংল্যান্ডের ক্রান্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তার অসাধারণ নেতৃত্ব ও অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্বের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড জার্মানির মোকাবেলা করতে পেরেছিল এবং ব্রিটেনের মান বাঁচিয়েছিল। চার্চিলই একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। জর্জ ওয়াশিংটন স্কুল শেষ করতে পারেননি জর্জ ওয়াশিংটন। বাবার মৃত্যুর পর পড়াশোনা শেষ না করেই স্কুল থেকে ইস্তফা দেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আমেরিকানরা পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে তাদের জাতির জনক ওয়াশিংটনকে যিনি আসলে স্কুল শেষ করতে পারেননি! আব্রাহাম লিংকন মোটাদাগে তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত লোক। ছোটবেলায় যে স্কুলে তিনি পড়তে যেতেন সেখানে আশপাশের আট দশ কিলোমিটারের মধ্যে লিংকনই ছিল একমাত্র ছাত্র। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ঐ অর্থে বেশি করতে পারেননি। বেশিরভাগই নিজে নিজে শিখেছেন। তিনি আইনজীবী হয়েছিলেন, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন যিনি দাসপ্রথার উচ্ছেদ করেছিলেন এবং আমেরিকার আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিলেন। আমেরিকার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ভূমিকা খুব কমই! ইন্ধিরা গান্ধী বেশিরভাগ সময়ই বাসায় গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেছিলেন। আর তার প্রধান শিক্ষক ছিলেন তার বাবা জওহরলাল নেহরু। মেয়ের কাছে লেখা নেহরুর চিঠিগুলো বিশ্বের যে কোন প্রান্তে থাকা প্রত্যেকটি শিশুর জন্য অবশ্য পাঠ্য বিষয় হতে পারে। ইন্ধিরা পরবর্তীতে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আবার অক্সফোর্ডেও পড়তে যান। কিন্তু কোনটাতেই পড়া শেষ করতে পারেননি। কিন্তু ইন্ধিরা গান্ধী ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। বিল গেটস মাত্র বিশ বছর বয়সে পড়াশোনা শেষ না করেই হার্ভার্ড থেকে বের হয়ে আসেন বিল গেটস। তার সহযোগী পল অ্যালেন ও ড্রপআউট। দু’জনে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন মাইক্রোসফট্। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছেন। জেন অস্টিন অস্টিন মাত্র এগারো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেন। কারণ তার পরিবার তার লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছিল না। কিন্তু এই মেয়েটিই পরবর্তীতে ইংরেজী সাহিত্যের সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন হতে পেরেছিলেন। মার্ক টুয়েন মার্ক টুয়েন মাত্র ১২ বছর বয়সে স্কুল থেকে ইস্তফা দেন। কারণ পরিবারে সাহায্য করার জন্য তখন থেকেই একজন প্রিন্টারের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। তিনি পরবর্তীতে সর্বকালের একজন সেরা লেখক হতে পেরেছিলেন। চার্লস ডিকেন্স চার্লস ডিকেন্সও স্কুল ছাড়েন মাত্র বারো বছর বয়সে। ঋণদায়গ্রস্ত পিতা জেলে যাওয়ার কারণে পরিবারের ভার এসে পড়ে এই ছোট্ট ছেলের কাঁধে। এ কারণে আর স্কুল শেষ করতে পারেননি। তিনি বিশ্বের সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিক হয়েছিলেন। জীবদ্দশাতে ও মৃত্যুর পর তার মতো জনপ্রিয়তা খুব কম লেখকই পেয়েছিলেন। উইলিয়াম শেক্সপীয়র গ্রামার স্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা ছাড়া আর তেমন আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার সৌভাগ্য হয়নি তার। লন্ডনের নাটকের মঞ্চ আর জীবনের মঞ্চেই সব শিক্ষা সমাপ্ত করেছেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব তাকে ইংরেজী সাহিত্যের সেরা নাট্যকার, সেরা কবি হতে বিরত রাখতে পারেনি। কার্লাইলের ভাষায় তাকে বলা যায়, ‘তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চেয়েও বড়’। লিও টলস্টয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে পারেননি রাশিয়ান এই ভদ্রলোক। ‘ওয়ার এ্যান্ড পিস’ ও ‘আনা কারেনিনা’র লেখক টলস্টয় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে সমাদৃত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোথাও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে পারেননি। দেশে স্কুল শেষ করেননি। আবার বিলেত গিয়েও পড়াশোনা শেষ না করে চলে আসেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা নির্দ্বিধায়। তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অনুপস্থিতি এক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দাঁড়ায়নি। ক্রিস্টোফার কলম্বাস মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই সাগরের পথে নেমে যান আর আনুষ্ঠানিক পড়াশোনার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু চল্লিশের কোঠাতেই আমেরিকা আবিষ্কার করে ফেলেন। জর্জ ইস্টম্যান পরিবারকে সাহায্য করার জন্য মাত্র ১৬ বছর বয়সেই স্কুল ছেড়ে দেন। ত্রিশ বছরের দিকে ক্যামেরার রুল ফিল্ম আবিষ্কার করে ফেলেন। ৩৮ বছর বয়সে ইস্টম্যান কোডাক প্রতিষ্ঠা করেন। আজ সারাবিশ্বে কোডাক একটি জনপ্রিয় নাম। টমাস আলভা এডিসন স্কুল পালানোদের মধ্যে এডিসনের নাম ব্যাপক আলোচিত। তাকে স্কুল থেকে অনেকটা বেরই করে দেয়া হয়। তার আজগুবি সব প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত শিক্ষকরা তাকে বিদায় করাতেই সমাধান খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু মমতাময়ী মায়ের আশ্রয়ে তার পড়াশোনা চলে। বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হয়েছিলেন এডিসন যারা অসংখ্য আবিষ্কারের মধ্যে ইলেকট্রিক বাতি, গ্রামোফোন উল্লেখযোগ্য। বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ফ্রাংকলিন মাত্র ১০ বছর বয়সেই স্কুল ছাড়েন। ভাইয়ের প্রিন্টিং কারখানায় কাজ শুরু করে দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করা শুরু করেন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ লেখক, কূটনীতিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক এবং রাজনীতিবিদ। এই বহুমুখী প্রতিভার বিকাশে স্কুল পড়া শেষ না করা কোন ভূমিকা রাখেনি। গৌতম আদানি ভারতের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। দু’বছরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া আর তেমন পড়াশোনা করতে পারেননি আদানি। ধীরুভাই আম্বানি আম্বানি কোনমতে স্কুল শেষ করতে পেরেছিলেন। এর পড়ে আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তার প্রতিষ্ঠিত রিলায়েন্স গ্রুপ ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রিচার্ড ব্রানসন্ এই ব্রিটিশ বিলিয়নার মাত্র ১৬ বছর বয়সেই পড়াশোনা ছেড়ে দেন ব্যবসা শুরু করার জন্য। খ্যাতিমান ধনকুবেরদের মধ্যে তার নাম উপরের দিকেই আসে। তাছাড়া তার ব্লগে লেখা অনুপ্রেরণাদায়ী লেখাপত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিশ্বজোড়া পাঠক মহলে। স্মৃতি ইরানি স্কুল নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উঠে আসলে ভারতের নবনিযুক্ত মন্ত্রী মানব সম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে নিয়ে। কংগ্রেস তাকে নিয়ে সমালোচনা করে যে সে একজন গ্র্যাজুয়েটও নয় সে কিভাবে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চালাবে? তিনি অনুরোধ করেন তাকে যেন তার কাজের দ্বারা মূল্যায়ন করেন তার সার্টিফিকেট দিয়ে নয়। এ সূত্রেই টাইমস অব ইন্ডিয়া বিশ্বসেরা ব্যক্তিত্বদের কথা এনেছে যারা কোন ধরনের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা অল্প আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়েই জীবনে সফলতার চূড়ায় পৌঁছেছিলেন। ওয়াল্ট ডিজনি মিকি মাউসের স্রষ্টা ওয়াল্ট ডিজনি এইটথ্ গ্রেডেই পড়াশোনার ইস্তফা দেন। ডিজনি ল্যান্ড তৈরি করেন যা আজ বিশ্বজোড়া পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। অসংখ্য সফল সিনেমার পরিচালক, এ্যানিমেশনকে নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ার অগ্রদূত ওয়াল্ট ডিজনির বড় হওয়ার পথে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব বাধা হিসেবে দাঁড়ায়নি।
×